শেষ মোচড়ে বিরিয়ানি

ছবি: দ্বিতীয় পুরুষ

পরিচালনা: সৃজিত মুখোপাধ্যায়

অভিনয়ে: পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, গৌরব চক্রবর্তী, ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়, রাইমা সেন, ঋদ্ধিমা চক্রবর্তী, আবীর চট্টোপাধ্যায়, বাবুল সুপ্রিয়

দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ৯ মিনিট 

RBN রেটিং : ৪/৫

‘বাইশে শ্রাবণ’-এ তিনি ডাল ভাত আর বিরিয়ানির তফাৎটা শিখিয়েছিলেন। ‘দ্বিতীয় পুরুষ’-এ এসে বোঝা গেল সৃজিত জেনে গেছেন যে থ্রিলারপ্রেমী বাঙালি দর্শককে ২০২০-তে এসে আর ডাল ভাত দিয়ে খুশি করা যায় না। বিরিয়ানিটাই চাই। তবে সেটাও পরিবেশন করতে হবে এমনভাবে যা আগে কেউ ভাবেনি। প্রায় দমবন্ধ করে ছবির শেষটা দেখার পর প্রতিক্রিয়া বলতে এটাই। এর বেশি বলা যায় না। তাই শেষাংশকে একেবারেই গুপ্তধনের মতো মাটি চাপা দিয়ে বাকি বিষয় নিয়ে কথা বলা যাক। 




যেহেতু ‘বাইশে শ্রাবণ’-এর স্পিন অফ্‌ তাই আগের ছবিটা দেখা থাকলে ভালো। না থাকলেও ক্ষতি নেই। গল্পটা একেবারেই অভিজিৎ পাকড়াশির (পরমব্রত) নিজস্ব। আগের ছবির প্রবীর রায়চৌধুরীর (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) খুব একটা প্রভাব এই ছবিতে নেই। দু-একটা ফ্ল্যাশব্যাক দৃশ্য ছাড়া আর কোথাও তিনি ফিরে আসেন না। গল্পের একটু ভূমিকা করে নেয়া যেতেই পারে। 

প্রবীর রায়চৌধুরীর মৃত্যুর প্রায় আঠারো বছর আগে এ গল্পের শুরু। যদিও আসল শুরু তারও অনেক আগে। ক্রিমিনাল খোকার (ঋতব্রত) শৈশব কেমন ছিল তা দেখানো হয়নি। ছবির শুরু ১৯৯৩ সালে কিশোর বয়সী খোকার একের পর এক খুন ও গুন্ডামি দিয়ে। তার স্বভাবই হলো খুন করে তার শিকারের কপালে ছোরা দিয়ে নিজের নাম খোদাই করে রাখা। কিন্তু দুঁদে পুলিশ অফিসার প্রণব রায়চৌধুরীর (বাবুল) হাতে শেষমেশ ধরা পড়ে যায় খোকা। তারপর জেলের অন্ধকারে কেটে যায় খোকার জীবনের পঁচিশটা বছর। এর মধ্যে অভিজিতের সঙ্গে ঘটে গেছে প্রবীর রায়চৌধুরীর ঘটনা।

আরও পড়ুন: তিন মূর্তি ও পায়ের তলায় সরষে

বর্তমান অবস্থায় খোকা (অনির্বাণ) জেল থেকে পালায় এবং পালিয়েই সে আগের কায়দায় খুন করে পুলিশের নজরে আসে। কেস গিয়ে পড়ে সিরিয়াল কিলার স্পেশালিস্ট অভিজিতের আওতায়। কেসের সমাধান করতে অভিজিৎ সঙ্গী পায় রজতকে (গৌরব)। কিন্তু খোকার করা একের পর এক খুনের কোনও কুলকিনারা করতে পারে না তারা।

এদিকে অভিজিতের দাম্পত্যের অবস্থাও টালমাটাল। স্ত্রী অমৃতা তার উদাসীনতায় তিতিবিরক্ত। সে ডিভোর্সের কথাও ভাবছে। এমনকি পুরোনো বন্ধু সূর্যকে (আবীর) ডেকে দুঃখের কথাও জানাচ্ছে অমৃতা। অভিজিৎ এই সবকিছুর মাঝে পড়ে কিছুটা অসহায়। রজত আর অঙ্কিতার (ঋদ্ধিমা) প্রেম তাকে পুরোনো দিনের কথা মনে পড়িয়ে দেয়।

আরও পড়ুন: রক্তবরণ মুগ্ধকরণ

এসবের মাঝে খোকার খুনের প্যাটার্ন যেন বার বার অভিজিৎকে চ্যালেঞ্জ জানায়। কিছু একটা যেন সে বোঝাতে চাইছে, একটা কিছু বক্তব্য আছে তার। অভিজিতের সঙ্গে দর্শকও খুঁজে চলে খুনের মোটিভ। খোকার চিন্তাধারাকে অনুসরণ করে ঠিক রাস্তাতেই এগোয় অভিজিৎ। তা সত্বেও বড় দেরি হয়ে যায়। অনেক বড় মাশুল গুনতে হয় তাকে। আহত বাঘের মতো হিংস্র হয়ে ওঠে অভিজিৎ। এতদিন সে সবরকম চেষ্টা করছিল খোকাকে ধরার। তবু কোথাও যেন খামতি থেকে যাচ্ছিল। এবার এক প্রিয়জনকে হারিয়ে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে খোকাকে ধরতে চায় সে। অবশেষে মুখোমুখিও হয় দুজনে।

আর তারপরেই বিদ্যুতের মতো চমক। ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যে দর্শকাসনে পিন পতনের নৈঃশব্দ্য বলে দেয় কি সাংঘাতিকভাবে ধাক্কা খেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে সকলে। এত বড় ধাক্কা অতি বড় থ্রিলারবোদ্ধাও কল্পনা করতে পারবেন না। এবং সেটা এতটাই অপ্রত্যাশিত যে তা হজম করতে বেশ কিছুটা সময় লাগে দর্শকের। পরে ভেবে দেখলে কিছুটা যেন অবাস্তবও লাগে। বাংলায় এমন থ্রিলার আগে হয়নি, ভবিষ্যতে হবে কি না জানা নেই। তবে বাংলা ছবি যে প্রকৃত অর্থে সাহসী ও পরিণত হচ্ছে এ কথাও বলা যায় নির্দ্বিধায়।

আরও পড়ুন: যে মৃত্যু আজও রহস্য

সংলাপের মধ্যে দিয়ে সিরিয়াল কিলারের বিশেষত্ব, বর্ণনা ভালো লেগেছে। ভাল লাগে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘দারোগার দপ্তর’ থেকে নিয়ে উইলিয়াম জেমস হার্শেলের উল্লেখ, যা অবধারিতভাবে ফেলুদাকে মনে পড়ায়। আর সেই সঙ্গে অবাঙালি টানে কথা বলা বংদেরকেও ঠুকতে ভোলেননি সৃজিত। ছবির শেষ কথা তাই তর্কপ্রিয় সোশাল মিডিয়া পন্ডিত বাঙালিদের শিখিয়ে দিয়ে যায় ‘faw’ বলে কোনও উচ্চারণ বাংলায় নেই। যেটা আছে সেটা হলো ‘phaw’। 

অভিনয়ে অনির্বাণ ও পরমব্রত কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমিও ছেড়ে দেননি। দুজনেই যে যার জায়গায় অসামান্য। একদিকে যেমন খোকার মতো এক নিষ্ঠুর নির্মম খুনির চরিত্রকে কাল্ট করে তুললেন অনির্বাণ, তেমনই মাংসের দোকান না হয়েও একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি পুলিশ অফিসার কীভাবে জ্বলে উঠতে পারেন তা দেখিয়ে দিলেন পরমব্রত। অবাক হতে হয় ঋতব্রতকে দেখেও। অল্পবয়স্ক খোকার চরিত্রে তিনি অনবদ্য। বাস্তবে এখনও তাঁকে এতটা পরিণত দেখায় না যতটা পর্দায় মনে হলো। রাইমা তাঁর চরিত্রের প্রয়োজন পূরণ করেছেন। গৌরব তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ঠান্ডা মানুষের চরিত্রে মানিয়ে গিয়েছেন। ছোট চরিত্রে আবীর যথাযথ। ভালো লাগে ঋদ্ধিমাকেও। প্রণবের চরিত্রের প্রতি সুবিচার করেছেন বাবুল। 

আরও পড়ুন: পাকদণ্ডীর পথে পথে দেওরিয়াতাল

ছবির কাহিনী ও চিত্রনাট্য সৃজিত ও শুভঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের। এমন একটা গল্প বাংলায় লিখে ফেলার জন্য তাঁদের সাধুবাদ প্রাপ্য। অনুপম রায়ের সুরে সবকটা গানই শ্রুতিমধুর। বিশেষ করে ‘যে কটা দিন’-এর নতুন ভার্শনটা শুনতে ভালো লাগে।

থ্রিলার ছবিতে রোমান্টিক অ্যাঙ্গল থাকলে ঘেঁটে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় বেশিরভাগ সময়। এ ক্ষেত্রে তা কোনওভাবেই হয়নি। উল্টে দুটো ট্র্যাক সমান্তরালভাবে চলেছে সামঞ্জস্য রেখে। হুডানইট গোত্রের হলেও বহু দর্শক শুধুমাত্র শেষ মোচড়ে বিরিয়ানির স্বাদটা পাওয়ার জন্যই দ্বিতীবার ছবিটি দেখতে যাবেন। থ্রিলার ছবিতে আবারও নিজের হাতযশ প্রমাণ করলেন সৃজিত। সঙ্গে এটাও প্রমাণ করলেন বিরিয়ানির চেয়েও মাঝেমধ্যে ‘চিকেন চাউমিন আর চিলি ফিশ’টাই বেশি প্রিয় হয়ে ওঠে।

আরও একটা কথা। পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে—এমনকী সিঁড়িতে দাঁড়িয়েওছিলেন অনেকে—বাংলা ছবির প্রিমিয়র শেষ কবে দেখেছি মনে পড়ে না।

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *