তিন মূর্তি ও পায়ের তলায় সরষে
বাংলা সাহিত্যে যতগুলো ‘দাদা’ চরিত্র সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে বোধহয় সর্বাধিক জনপ্রিয় সত্যজিৎ রায় সৃষ্ট ফেলুদা। আর ফেলুদা বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ঝকঝকে তারুণ্য, প্রখরবুদ্ধি, রসবোধ, সাহসিকতা, নিয়মানুবর্তিতা, কর্তব্যপরায়ণতা ও ক্ষুরধার বাকচাতুর্য গুণযুক্ত এক মানুয, যে কিনা ঘনাদা, টেনিদা’র মতোই কিশোরমনের একান্ত আপন অগ্রজপ্রতিম অথচ বন্ধুস্থানীয় একটি চরিত্র। কিন্তু শুধু কিশোরই বা বলি কি করে। নয়ন রহস্য-তে ফেলুদা বলেছে যে তপেশের লিপিবদ্ধ করা কাহিনী আদতে কিশোর উপন্যাস হলেও, তার পাঠক শুধুমাত্র কিশোর নয়। সঙ্গে তাদের ‘‘মা বাবা মাসি পিসি খুড়ো জ্যাঠা’’ও রয়েছেন। এটা বিন্দুমাত্র ভুল নয়।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি সত্যজিৎ বাঙালি পাঠকের সাথে ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি-র পরিচয় করিয়ে দেন, যার সূত্রপাত দার্জিলিংয়ের সবথেকে জনপ্রিয় স্থান ম্যাল-এ। সত্যজিৎপুত্র সন্দীপ ফেলুদার স্রষ্টার প্রসঙ্গে বলেন, “দার্জিলিং ওঁর অত্যন্ত প্রিয় ছিল।” তখন থেকেই ফেলুদা জনপ্রিয় এবং সেই জনপ্রিয়তা আজও অক্ষুণ্ণ।
স্বভাবতই, ফেলুদার গল্পের এই বিপুল জনপ্রিয়তার কারণগুলি সম্পর্কে পাঠক হিসাবে কৌতূহল জাগে। গল্পগুলির নামকরণ থেকেই উপলব্ধি করা যায় যে নানা উপাদানের মধ্যে দেশভ্রমণের আকর্ষণীয় অংশের অবদানও কম নেই ফেলুকাহিনীর জনপ্রিয়তার পেছনে।
দেবতার গ্রাস
ফেলু মিত্তিরের মামলা থেকে তপেশের লিপিবদ্ধ করা কাহিনীর সংখ্যা নেহত কম নয়। তবে তার জ্যাঠতুতো দাদার নির্দেশে তপেশ সেইগুলিই লিপিবদ্ধ করেছে যেখানে সে নিজে উপস্থিত এবং যেখানে স্বদেশ ও বিদেশ, দুপ্রকার ভ্রমণই রয়েছে। স্বদেশের মধ্যে আবার পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান, প্রাচীন শহর, গ্রাম, বাদ পড়েনি কিছুই। কিন্তু প্রদোষচন্দ্র মিত্রের কীর্তিকলাপই যদি গল্পের মুখ্য বিষয় হয়ে থাকে, তাহলে কেন পঁয়ত্রিশটি কাহিনীর মধ্যে প্রায় চব্বিশটির একটি বড় অংশজুড়ে ভ্রমণ সংক্রান্ত তথ্য থাকবে? এমনকি ফেলুদার এহেন সাবধানবানী, “আমাদের কাঠমাণ্ডু অ্যাডভেঞ্চার সম্বন্ধে যখন লিখবি, তখন খেয়াল রাখিস যে ফেলু মিত্তিরের গোয়েন্দাকাহিনী যেন নেপালের ট্যুরিস্ট গাইড না হয়ে পড়ে,” (যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডু) শোনার পরেও, তপেশের ভ্রমণবৃত্তান্ত কিন্তু থেমে থাকেনি। বিভিন্ন গল্পে প্রকাশিত ফেলুদার মতামত থেকেই এই বিযয়টি পরিস্কার। কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক।
১. প্রাচীন সভ্যতা বলতে তো ওই একটি বাকি আছে। মিশর, ইরাক, মেসপটেমিয়া—এ সব তো বহুকাল আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সৌভাগ্যক্রমে এই সিকিমের মঠগুলোতে সেই পুরনো সভ্যতার কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। (গ্যাংটকে গণ্ডগোল)
২. আপাতত আপনাকে অ্যাডভাইস দিচ্ছি—চোখ-কান সজাগ রেখে মনপ্রাণ ভরে দেখে নিন । প্রাচীন শহরের এমন চেহারা আপনি ভারতবর্ষের কোথাও পাবেন না। এক পেতে পারেন কাশীর দশাশ্বমেধে, কিন্তু তার মেজাজ একেবারে আলাদা।(যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডু, দরবার স্কোয়ার সম্পর্কে জটায়ুকে বলছে ফেলুদা)
তাশি গাঁওয়ে একদিন
৩. ও বলে বাংলা দেশটা ভারতবর্ষের কটি দেশে হওয়াতে এখানে একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটেছে—বাংলার উত্তরে হিমালয় আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। এটা ভারতবর্ষের আর কোন প্রদেশে নেই। এটা নাকি একটা ‘অ্যাক্সিডেন্ট অফ জিওগ্রাফি’। এত বৈচিত্র্য আর কোন একটা প্রদেশে পাবি না বলে ফেলুদা। শষ্যশ্যামলাও পাবি, রুক্ষতাও পাবি, সুন্দরবনের মতো জঙ্গল পাবি, গঙ্গা পদ্মা মেঘনার মতো নদী পাবি, সমুদ্র পাবি, আবার উত্তরে হিমালয় আর কাঞ্চনজঙ্ঘাও পাবি। (দার্জিলিং জমজমাট)
৪. আর এত সুন্দর শহর ভারতবর্ষে কমই আছে। শহরের মাঝখান দিয়ে নদী বয়ে গেছে এরকম কটা জায়গা পাবেন আপনি? ব্রিজের একদিকে শহরের অর্ধেক, বাকি অর্ধেক অন্যদিকে। তাছাড়া নবাবি আমলের গন্ধটা এখনও যায়নি।চারিদিকে তাদের কীর্তির চিহ্ন ছড়ানো। তার উপর সেপাই বিদ্রোহের চিহ্ন।(শকুন্তলার কণ্ঠহার)
৫. কিন্তু কৈলাসের মন্দির বা সাঁচীর স্তূপ বা এলিফ্যান্টার গুহা—এসব একটা বই দুটো নেই। সুতরাং সে যুগের আর্ট দেশে যা আছে তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। যারা তাকে নষ্ট করতে চায় তারা ক্রিমিনাল। (কৈলাসে কেলেঙ্কারী)
কিশোর এবং শিশুমনের গড়ন সম্বন্ধে ফেলুদা যে অত্যন্ত সচেতন তার প্রমাণ পাওয়া যায় জয় বাবা ফেলুনাথ গল্পে রুকুর প্রসঙ্গে। আর ফেলুদার মতামত তো আদতে তার স্রষ্টারই মতামত। তাই একথা বলা খুব একটা অসঙ্গত হবে না যে ফেলুস্রষ্টা সত্যজিৎ খুব সচেতনভাবেই গোয়েন্দা এবং ভ্রমণ কাহিনীর প্রধান যে গুণ, অর্থাৎ অ্যাডভেঞ্চারধর্মীতা, তাকেই অবলম্বন করে কিশোরমনে সঞ্চারিত করেতে চেয়েছেন প্রাচীনতার মহিমা অনুভব করার শক্তিকে। এর পাশাপাশি নৈসর্গিক সৌন্দর্যকে এবং মনুষ্যসৃষ্ট সৌন্দর্যকে উপভোগ এবং রক্ষা করার আগ্রহ এবং কর্তব্যকেও।
গোয়েন্দাগল্পের মধ্যে ভ্রমণ কাহিনীর এরূপ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অনুপ্রবেশ ঘটানোর ক্ষেত্রটিতে সত্যজিৎ যে সফল তা বলাই বাহুল্য। দেশভ্রমণের তথ্য সক্রান্ত ফেলুদার গোয়েন্দাগিরির গল্পগুলো পড়লে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য নজরে আসে যেগুলি ছবির পর ছবি ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করে।
কোনও জায়গায় বেড়াতে যাবার আগে সেটা সম্পর্কে জেনে নেওয়া ফেলুদার স্বভাব। কারণ “কতগুলো তথ্য জানা থাকলে দেখতে আরো ভালো লাগবে।” সেই জন্য ফেলুদার গল্পগুলিতে বিভিন্ন ধরনের গাইড বুকের নাম এবং তার প্রসঙ্গ বারবার এসেছে, যেমন ‘বাংলার ভ্রমণ’, ‘এ গাইড টু দ্য কেভস অফ ইলোরা’, ‘লাইফ অ্যান্ড ওয়ার্ক ইন বীরভূম’, স্বেন হেদিনের ভ্রমণকাহিনী ইত্যাদি।
রহস্য সমাধান করতে গিয়ে কোনও স্থানে যাওয়া বা ছুটি কাটাতে গিয়ে কোনও রহস্যের জালে জড়িয়ে পরা—যে কোনও ক্ষেত্রেই সেই স্থানটির ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক বিবরণ ফেলুস্রষ্টা দিয়েছেন নিখুঁতভাবে। যেমন গ্যাংটকে গণ্ডগোল-এ সত্যজিৎ লিখেছেন, “গ্যাংটক থেকে ষোলো মাইল দূরে ১৪,০০০ ফুট হাইটে নাথুলা। নাথুলাতে চিন আর ভারতের মধ্যে সীমারেখা। এদিকে ভারতীয় সৈন্য, আর ওদিকে পঞ্চাশ গজের মধ্যে চিনা সৈন্য।”
এ কেমন জীবন
কিন্তু এ তো গেল ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কিত খবরাখবর। এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে স্থানিয় ইতিহাসও। ফেলুদা বলছে, “দার্জিলিং-এর মতো সিমলাও নাকি সাহেবদেরই তৈরি। ১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দে লেফটেনান্ট রস বলে একজন সাহেব নাকি সিমলায় এসে নিজেদের থাকার জন্য একটা কাঠের বাড়ি তৈরি করে। সেই থেকে শুরু হয় সিমলায় সাহেবদের বসবাস।” পলাশ বাগানের কারণে ঐতিহাসিক শহর পলাশীর নামকরণের কথা আছে ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা গল্পে।
বাদশাহী আংটি, কৈলাসে কেলেঙ্কারী, ও নয়ন রহস্য, এই তিনটি গল্প যেন প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্য-ভাস্কর্যশৈলী সম্পর্কিত ঝকঝকে প্রবন্ধ। কৈলাসে কেলেঙ্কারী-তে সিধুজ্যাঠার মতে “এলোরা হল ভারতের সেরা আর্টের ডিপো! পাহাড়ের গা থেকে কেটে বার করা কৈলাসের মন্দির—যা দেখে মুখের কথা আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে যায়। আর তা ছাড়া পাহাড়ের গায়ে লাইন করে দেড় মাইল জায়গা জুড়ে আরও তেত্রিশটা গুহা—হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন—তার প্রত্যেকটা মূর্তি কারুকার্য ঠাসা।” ফেলুদার উপদেশ অনুযায়ী আর্ট ছেড়ে ইঞ্জিনিয়ারিংটাও যার দ্রষ্টব্য বিষয়।
শব্দ যখন ছবি আঁকে
ফেলুকাহিনী যে কতটা ট্রাভেল গাইডের কাজ করে তা গল্পগুলি পড়লেই জানা যায়। যেসব জায়গায় ফেলু রহস্য সমাধানে গেছে, অত্যন্ত সচেতনভাবে সেগুলিতে যাতায়াতের উপায় এবং উপযুক্ত সময় বলে দিয়েছে তোপসে। যেমন হত্যাপুরী-তে, “কলকাতা থেকে জগন্নাথ এক্সপ্রেস এসে গেছে সাতটায়। পুরী এক্সপ্রেস এক ঘন্টা লেট।” গ্যাংটক যাবার প্রসঙ্গে সত্যজিৎ লিখছেন, “বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে যেতে লাগবে প্রায় ছ–সাত ঘন্টা। রাস্তা খারাপ থাকলে আরো বেশী লাগতে পারে। তবে ভরসা এই যে আজ সবে চোদ্দই এপ্রিল; মনে হয় এখনও তেমন বর্ষা নামেনি।”
যে কোনও ভ্রমণকাহিনিতে যেমন করে বেড়াতে গিয়ে থাকার জন্য হোটেলের তালিকা দেওয়া থাকে, ফেলুদার গল্পেও তার অন্যথা হয়নি। কাঞ্চনজঙ্ঘা, হিমলোক, স্নোভিউ এরকম বেশ কিছু হোটেলের যেমন উল্লেখ আছে, তেমনই আছে গেস্ট হাউস, বাংলো, এসবেরও তথ্য।
আবার যে কোনও স্থানের জনগোষ্ঠীর পরিচয়পর্ব তুলে ধরার সময় তাদের জীবনযাত্রার ধরণ, পোষাক-পরিচ্ছদ, বাসস্থান, খাদ্যাভ্যাস প্রতিটি জিনিসের প্রতিই নজর দিয়েছেন সত্যজিৎ। ধর্মীয় রীতিনীতি, সংস্কার কিছুই এড়িয়ে যায় নি। অনিষ্টকারী প্রেতাত্মাদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্য তিব্বতী চারকোনা সাদা নিশান, ঠোঁটের দুপাশ থেকে ঝোলা সরু গোঁফওয়ালা লামা, তিব্বতী জোব্বা পরিহিত দশ-বারো বছরের শিক্ষার্থী, চিনে প্যাটার্নের ছাতাওয়ালা ফুলের টব সাজানো কাঠের বারান্দাওয়ালা দোতলা দোকান বাড়ির সারি, বাদ পড়েনি কোনও প্রসঙ্গই৷
আর রসনার পরিতৃপ্তি না হলে যেন বাঙালির ভ্রমণ চরিতার্থ হয় না। বিশ্বনাথের পাশের কচৌরি গলিতে হনুমান হালুইকরের দোকানে মাটির ভাঁড় থেকে রাবড়ি খেতে খেতে লালমোহনবাবুর উক্তিই তার প্রমাণ—“রাবড়ির আবিষ্কারটা টেলিফোন–টেলিগ্রাফ আবিষ্কারের চেয়ে কিসে কম মশাই?” যদিও সময়াভাবে হংকং-এ স্নেক সুপ খাওয়ার অভিজ্ঞতা আর হয়ে ওঠেনি তিন মুর্তির, তবে “তরল পদার্থে ভাসমান মাংসপিণ্ড” তিব্বতী খাবার মোমো বা লক্ষ্ণৌ-এর ভুনা পেঁড়া—তোপসে জটায়ুর সাথে পাঠককেও উৎসাহিত করে তোলে রসাস্বাদনের জন্য।
যে আগুন নেভে না
“দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/একটি ধানের শিষের উপর একটি শিশির বিন্দু”-র আক্ষেপ যাতে না থাকে তার আয়োজনও ফেলু-জটায়ু-তোপসের কাহিনীতে বিরাজমান। কলকাতার নিকটবর্তী এবং দূরবর্তী কয়েকটি জেলাতেও ফেলুদার গোয়েন্দাগিরির জন্য ডাক পড়েছিল। কখনও আবার সে নিজেই ছুটে গিয়েছিল। ফেলুদা সিরিজ়ের শেষ গল্প রবার্টসনের রুবি বীরভুমের পটভূমিকায় লেখা। অন্যান্য গোয়েন্দাগল্পের তুলনায় সত্যজিতের ফেলুদা যে আসলে অনেক বেশী বাঙালি তার প্রমাণ এই গল্পটি। বাঙালি ঐতিহ্যের প্রতীক সব কিছুই এ গল্পে রয়েছে—আড়াইশো বছরের পুরনো রাধাবিনোদের টেরাকোটার মন্দির, জয়দেবের জন্মস্থান কেন্দুলির বিরাট বাউলের মেলা, সাধক বামাখ্যাপার সাধনাস্থান তারাপীঠ, দুবরাজপুরের মামা-ভাগনে পাহাড়, বক্রেশ্বরের হট স্প্রিং, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন, এবং সাঁওতাল উপজাতির জীবনযাত্রা।
ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা ও গোঁসাইপুর সরগরম—এই দুটি গল্প শান্ত গ্রামীন পরিবেশের পটভূমিকাতে নির্মিত। “আর সবচেয়ে বড় কথা—পাড়াগাঁয়ে শীতকালের সকাল–সন্ধ্যেতে মাথার উপর কেমন ধোঁয়া জমে থাকে দেখেছিস? গাছগুলোর গুঁড়ি আর মাথার উপর খালি দেখা যায়। আর সন্ধ্যেটা নামে ঝপ করে, আর তারপরেই কনকনে ঠাণ্ডা,” আর, “নাঃ এ সব কতকাল দেখিনি,” ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা-তে ফেলু বর্ণিত এ দৃশ্য তোপসে কেন যে কোনও ভ্রমণ পিপাসুকেই আকৃষ্ট করে।
ফেলুদার গুরুই যখন শার্লক হোমস আর লন্ডন এবং নিউইর্য়ক এই দুই ‘জাঁদরেল শহর’ই যখন ফেলুস্রষ্টারও পছন্দের স্থান, তখন লন্ডনে ফেলুদা গল্পটি রচিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক। জনবহুল ব্যাস্ততম শহরটির বিখ্যাত স্থান, তার নিয়মশৃঙ্খলা, পরিবেশ পরিস্থিতি, আবহাওয়া, জনজীবন, যোগাযোগ ব্যাবস্থা, সমস্যা, সমস্তই গল্পের ছোট্ট পরিসরে পরিবেশন করেছেন সত্যজিৎ। মাদাম ত্যুসো, বিগবেন, চেম্বার অফ হররস প্রভৃতি দর্শনীয় স্থানগুলিকে দেখলেও গোয়েন্দা হিসেবে ফেলুদার লন্ডন আসা সার্থক হয়েছে ২২১বি বেকার স্ট্রিটে যাবার পর। কারণ ফেলুদার মতে “গুরু, তুমি ছিলে বলেই আমরা আছি।”
আমার মুক্তি আলোয় আলোয়
উপসংহারে লীলা মজুমদারকে ধার করেই বলা যায়, “ফেলুদার গল্প যারা পড়েনি, তারা ঠকেছে! ভালো জিনিস উপভোগ না করতে পারার দুঃখ আর কিছুতে নেই।” একদিকে এক তরুণ গোয়েন্দার তিনটি অস্ত্রের (মস্তিষ্ক, স্নায়ু, মাংসপেশী) জোড়ে রহস্যের পর্দা উন্মোচনের মঞ্চ, তার কিশোর সাগরেদ তোপসের সহজাত কৌতূহল, রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনীকার জটায়ু্র উদার সরল মনের হাস্যরস উদ্রেককারী কীর্তিকলাপ—এই তিনের মেলবন্ধন—আর অন্যদিকে “দেশে দেশে কত না নগর, রাজধানী/মানুষের কত কীর্তি, কত নদী, গিরি–সিন্ধু-মরু,” বিশাল বিশ্বের এই আয়োজনকে দুই মলাটের ভিতরে পাওয়ার আনন্দ, একসঙ্গে এত প্রাপ্তি আর কোনও গল্পকথকের কলমে বেরোয়নি।