রূঢ় বাস্তব, চমকে দেওয়া অভিনয়
ছবি: সমরেশ বসু-র প্রজাপতি
পরিচালনা: সুব্রত সেন
অভিনয়ে: সুব্রত দত্ত, মুমতাজ সরকার, ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়, শ্রীতমা দে, দেবরঞ্জন নাগ, কমলিকা বন্দোপাধ্যায়, শ্রাবন্তী ভট্টাচার্য
দৈর্ঘ্য: ১ঘণ্টা ৫১ মিনিট
RBN রেটিং ★★★★★★★☆☆☆
নিজের ইচ্ছেয় আমরা কেউই এই পৃথিবীতে আসি না। অন্যের ইচ্ছা এবং জৈবিক চাহিদার কারণে প্রতিটি শিশুর জন্ম হয়। নিজের জীবনকে মনের মতো করে না হলেও সুস্থভাবে গড়ে তোলার সুযোগ অনেক মানুষই পেয়ে থাকে। আবার অনেকেই তা পায় না। সবে পাপড়ি মেলতে থাকা ছোট-ছোট ইচ্ছে, আনন্দ, চাওয়া-পাওয়া, আশা আকাঙ্ক্ষাকে যদি অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেওয়া হয় তবে অচিরেই সেই গাছে গজিয়ে ওঠে বিষফল। ঠিক যেমনভাবে বেড়ে উঠেছিল সুখেন। নিজের ইচ্ছেয় সে তার জীবনটা সাজাতে পারেনি। বরং অন্যের হাতে চালিত এবং ব্যবহৃত হতে-হতে ক্রমশ তার বাইরেটা ধারাল হতে থাকলেও নিজের অজান্তেই ভেতরে মর্চে ধরে গিয়েছিল।
সমরেশ বসুর মূল উপন্যাস থেকে সুব্রত গল্পকে কিছুটা এগিয়ে নিয়ে এসেছেন নব্বইয়ের শেষবেলা থেকে নতুন শতকের শুরুর দিকে। বদলেছে গল্পের বাহ্যিক পোশাকআশাকও।
নব্বইয়ের শেষভাগে পশ্চিম বর্ধমানে কয়লাখনি ও সংলগ্ন শিল্পাঞ্চল দাপিয়ে বেড়ায় টুকু। এ সব সত্যি নাকি গল্প, তা বাংলার মানুষমাত্রেই জানে। শিল্পাঞ্চল তথা সরকারি টেন্ডার পাওয়ার রাজনীতি এক শ্রেণীর পয়সাওয়ালা কন্ট্রাক্টরের জন্ম দেয়, যারা আবার স্রেফ টাকার জোরে, নিজেদের স্বার্থে একদল গুন্ডা সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করে। তারা সমাজের নিম্ন-মধ্যবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে চোখ রাঙাবার সাহস রাখত বা আজও রাখে। ইউনিয়ন, পাল্টা ইউনিয়ন, অন্তর্ঘাত, দুর্নীতি ক্রমশ প্রজন্মের পর প্রজন্মকে পঙ্গু করে দিতে থাকে। একদল ক্ষমতাবান ধনী, সাধারণ মানুষকে ক্রমাগত শোষণ করে যায় এই ছিন্নমূল স্বঘোষিত বাহুবলীদের মাধ্যমে আর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
আরও পড়ুন: “আর ভালো লাগছে না”
খোকা বা টুকু (ঋতব্রত) যে যুবাবয়সে সুখেন (সুব্রত), শৈশব থেকে যা কিছু চেয়ে এসেছে, যাকে ভালোবেসেছে তাকেই তার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। অত্যাচারী সরকারি আমলা বাবা প্রায় নৃশংসভাবে শেষ করে দিয়েছিল তার মায়ের জীবন। সুখেন যাকে সব থেকে আপন বলে জানত। তারপর নিয়তি একে-একে কেড়ে নেয় স্কুলের বান্ধবী ও পরবর্তীকালে জিনাকেও। ক্রমশ প্রতারিত হয়ে, ধাক্কা খেয়ে খোকা বদলে যায় টুকু গুন্ডায়। যে রাজনৈতিক দাদাদের হয়ে সে কাজ করে, তারাই একসময় তাকে কুখ্যাত সুখেন বানিয়ে তোলে। তবু সে আত্মসম্মান বিসর্জন দেয় না, কোনও পার্টির রঙে নিজেকে রাঙায় না। নিজের কাছে সৎ থাকে। কারণ সুখেন আগাগোড়া আবেগপ্রবণ। সামান্য ভালোবাসা, একটু যত্ন পেলেও সে কৃতার্থ হয়ে যায়।
দয়ালদার ঠেকের আন্তরিকতা থেকে নিরাপদ মাস্টারের শিক্ষা, কিছুই ভোলে না সুখেন। এদের জন্য সে যথাসাধ্য করতে পারে। শিখা তার জীবনে সত্যিই আলোকশিখা হয়ে আসে। তবু ঘুণ ধরা সমাজের ষড়যন্ত্রে সুখেনের জীবনে সুখ অধরাই থেকে যায়। তার পরিণতি ছিল অবশ্যম্ভাবী। সুখেনরা এভাবেই শেষ হয়ে যায়। না হলে সমাজের মুখোশ খুলে যাবে অচিরেই।
আরও পড়ুন: ‘মাসুম’-এর সিক্যুয়েল করবেন শেখর?
এর আগে ১৯৯৩ সালে একই কাহিনি অবলম্বনে ‘প্রজাপতি’ নামে একটি ছবি হয়েছিল। তবে সে ছবির থেকে সুব্রতর ট্রিটমেন্ট একেবারে আলাদা। সুব্রতর ছবি সব অর্থেই ভীষণ পরিণত ও সমাজের অন্ধকার দিককে আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয়। বাস্তবধর্মী এই ছবিতে যেমন কোনও ফ্যান্টাসি নেই তেমনই নেই কোনও মিথ্যে আশ্বাসও। সুখেনের জীবন এক নিদারুণ পোয়েটিক জাস্টিস হয়ে দাঁড়ায়, যাকে ভাগ্যের পরিহাস ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। যেদিন সে অস্ত্র ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়, সেদিনই তার মৃত্যুর প্রহর গোনা শুরু হয়ে যায়। এ এক অদ্ভুত সমাপতন!
কিশোর সুখেন অর্থাৎ খোকার জীবনের একঘেয়ে বিকেল, মনখারাপ করা সন্ধ্যে আর দুর্বিষহ রাতের রোজনামচা তাকে ক্রমশ ভালো ছাত্র থেকে এক রুক্ষ ও বিদ্রোহী যুবকে বদলে দেয়। তবে পর্দায় সমান্তরালভাবে সুখেনের তিন বয়সের গল্প চলতে থাকায় যারা উপন্যাস পড়েনি তাদের ক্ষেত্রে হয়তো বুঝতে কিছুটা অসুবিধা হবে। আবার এই বিশেষ ট্রিটমেন্টই ছবিকে আরও বেশি স্বতন্ত্র করে তোলে।
আরও পড়ুন: সৌরভের বায়োপিকে অভিনেতা চূড়ান্ত?
ছবিতে তিন বয়সের তিন অভিনেতার অন্তর্ভেদী দৃষ্টির ব্যবহার মনে রাখার মতো। কিশোর অভিনেতাটির অসাধারণ সংযত অভিনয় মুগ্ধ করে। মুখ্য চরিত্রে প্রত্যেকে অনবদ্য। সদ্য যুবক চরিত্রে ঋতব্রত আবারও নিজের জাত চিনিয়ে দিলেন। এমনই সব ব্রহ্মাস্ত্র তিনি লুকিয়ে রাখেন নিজের আস্তিনে, প্রয়োজন শুধু ভালো চরিত্রের। পরিণত সুখেনের ভূমিকায় সুব্রতকে অসামান্য বললেও কম বলা হয়। তাঁর অভিনয়জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনয় হয়ে থাকবে সুখেন চরিত্রটি। বেশ কিছু দৃশ্যে তাঁর নিজেকে বিনির্মাণ করার ক্ষমতা অবাক করে। শিখার চরিত্রে মুমতাজ প্রশংসনীয় এবং দাপুটে। ভবিষ্যতে তাঁকে ভিন্ন ধারার চরিত্রে দেখার আশা রইল। শ্রীতমা বরাবরের মতোই এখানেও সপ্রতিভ এবং উজ্জ্বল। পার্শ্বচরিত্রে দেবরঞ্জন ও শ্রাবন্তী বেশ ভালো।
আরব চৌধুরীর আবহ সঙ্গীত শুনতে ভালো লাগে। তবে শিখার নাচের দৃশ্য ছাড়া অন্য জায়গায় গানের প্রয়োজন ছিল না। কিছু ছোট চরিত্রে অভিনেতাদের কাজ আরও ভালো হতে পারত।
‘সমরেশ বসু-র প্রজাপতি’ একান্তই বড়পর্দার ছবি। এ ছবিতে আজকের দিনের হাই-ডেফিনিশন মানের ঝকঝকে আবেদন না থাকলেও রয়েছে চমকে দেওয়া অভিনয় ও নির্মাণের জোর। যে অর্থে উপন্যাসটি নিষিদ্ধ হয়েছিল তা ছবিতে অনুপস্থিত। যেটুকু আছে তাকে এ যুগে আলাদাভাবে অশ্লীলতার তকমা দেওয়া যায় না। তবে ছবি শেষ হওয়ার পর বোঝা যায় অশ্লীলতার লেবেল লাগিয়ে মশলাদার ছবি বানানোর উদ্দেশ্য পরিচালকের ছিল না। তিনি সুখেনের বা সুখেনদের গল্প বলতে চেয়েছেন। এবং সফল হয়েছেন বলাই যায়। কারণ সোমবার দুপুরের রাধা স্টুডিও একেবারে ফাঁকা তো যায়ইনি, বরং বিভিন্ন বয়সী দর্শকের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। এমনকি ষাটোর্ধ যে শ্রেণীর দর্শককে প্রেক্ষাগৃহে খুব একটা দেখা যায় না তাদেরও পাওয়া গেল আশ্চর্যভাবে। বস্তুত ডিজিটাল মাধ্যমে দেখার জন্য এই ছবিকে ফেলে না রাখাই ভালো। বড়পর্দা ছাড়া সুখেনের জীবনকথার উপলব্ধি অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে।