ভালবাসার সন্ধানে, শেষ পর্যন্ত
ছবি: ফাইনালি ভালবাসা
পরিচালনা: অঞ্জন দত্ত
অভিনয়ে: রাইমা সেন, অরিন্দম শীল, অর্জুন চক্রবর্তী, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, সুপ্রভাত দাস, সৌরসেনী মৈত্র, সৌরভ দাস, অঞ্জন দত্ত
দৈর্ঘ্য: ১ ঘন্টা ৫৭ মিনিট
RBN রেটিং: ৩.৫/৫
পরিচালক বলেছিলেন, এটি ভালবাসার ভাল ছবি। ছবির শুরুতে সেটা বোঝা না গেলেও ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয় তাঁর বক্তব্য। তিনটি রোগের নামে ছবির তিনটি গল্প। নানারকম সম্পর্কের ওঠাপড়ায় ভালবাসার নানান সমীকরণ উঠে এসেছে ছবিতে। দু ঘণ্টার ছবি পুরোটাই বেশ টানটান, কিছু ছোটখাট অসঙ্গতি ছাড়া বেশ উপভোগ্য। আগে সেগুলো বলে নেওয়া যাক।
প্রতি গল্পে রোগের (ইনসমনিয়া, আরথ্রাইটিস, এইচআইভি পজ়িটিভ) উল্লেখটা আলাদাভাবে বলে দেওয়ার দরকার ছিল না। দর্শক এটুকু বোঝার ক্ষমতা রাখেন। একমাত্র এইচআইভি ছাড়া বাকি দু জায়গায় রোগের উল্লেখ একটু আরোপিত লাগল। অরিন্দমের সারাক্ষণ বিভিন্ন রঙের ফ্লোরাল প্রিন্টের শার্ট বেশ বিরক্তিকর। প্রথম গল্পের উদ্দেশ্যও তেমনভাবে বোঝা গেল না। ভালবাসার আধিক্যকে কিছুতেই অত্যাচার দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। সাপের বিষের ছোঁয়া তৃপ্তিদায়ক হতেই পারে, কিন্তু তাই খেয়ে পেট ভরানো যায় না। আর আধ বোতল ঘুমের ওষুধ খেয়েও কিভাবে কেউ জেগে থেকে মারা যেতে পারে তাও বোঝা গেল না। ঘুমের ওষুধ তো সায়নাইড নয় যে হাতে বোতল রেখেই মারা যেতে হবে। সল্লুর চরিত্রটি প্রথমে যেভাবে হিন্দি বলছিল তাতে মনে হয়েছিল সে বাংলা জানে না। পরে দেখা গেল সে বাংলা ও ইংরেজি বেশ ভালই জানে।
ইনসমনিয়া
প্রথম গল্পে বস ও তার স্ত্রী মালবিকার চরিত্রে রয়েছেন অরিন্দম শীল ও রাইমা সেন। অত্যাচারী ও অত্যাচারিতর মধ্যে কোনও রসায়ন থাকা উচিত নয়, তা ছিলও না। যে লোকটার সর্বক্ষণ সেক্রেটারির দরকার হয়, তাকে কোথাওই কোনও কাজ করতে দেখা গেল না। সেক্রেটারি বিবেকের চরিত্রে অর্জুন মানানসই। বাঙালির ভেতো, ভীতু অবতারে অর্জুন দক্ষতার সঙ্গে উতরে গেছেন। অরিন্দমের অভিনয় বরাবরই চরিত্রের সঙ্গে মানিয়ে যায়। এবারেও তার অন্যথা হয়নি। ‘ইউ আর নো মোর আ ভার্জিন’-এর রসিকতায় দর্শককে একটু হলেও চমকে দিলেন তিনি।
তিন মূর্তি ও পায়ের তলায় সরষে
চমকে দিলেন আরও একজন। তিনি সৌরভ দাস। বিবেকের বন্ধু সল্লুর চরিত্রে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করলেন সৌরভ। তার লিপে ‘তুম ভি অ্যায়সে হো’ গানটি আলাদা একটা আবহ তৈরী করে। ভালো লাগল বিবেক ও সল্লুর মুখোমুখি দৃশ্যে একটানা মেঘের ডাক ও বিদ্যুতের ঝলকানি। আগামী দিনে সৌরভের থেকে বাংলা ছবি আরও প্রাপ্তির আশায় রইল।
মালবিকার চরিত্রে রাইমা যথাযথ। কোথাও যেন বাস্তুশাপকে মনে করিয়ে দেয় মালবিকা। তবে রহস্যও রেখে গেল চরিত্রটি। কোথাওই যেন সে নিজের মুখোমুখি হল না। বিবেককে ঘুঁটি করে মালবিকা পালাতে চেয়েছিল, কিন্তু তার এতকাল পড়ে পড়ে মার খাওয়ার কারণটা ঠিক স্পষ্ট হল না। ৪৯৮এ-এর যুগে মার খাওয়া ও পালিয়ে যাওয়া ছাড়াও যে অন্য কিছু করা যায়, সেটা অঞ্জন সম্ভবত ভেবে দেখেননি, কেননা প্রথম দৃশ্যে মালবিকাকে দেখে পর্দানশীন মনে হয়নি।
আরথ্রাইটিস
আহিরির ভূমিকায় সৌরসেনী মৈত্র সম্ভবত এই ছবির উজ্জ্বলতম আবিস্কার। বড়লোকের বখে যাওয়া মেয়ে হলেও সে উন্নাসিক বা অভদ্র নয়, সে ট্রাম্পেটে জ্যাজ় বাজায়। ফোনে সারাক্ষণ এক অস্থির সম্পর্ক ও মায়ের সঙ্গে অশান্তিকে ব্যালান্স করতে করতে চলা আহিরিকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সৌরসেনী। উল্টোদিকে দীনেশবাবুর ভূমিকায় অঞ্জন তার নিজের মতই কিছুটা বিভ্রান্ত এক চরিত্র। শুরুতে অভিভাবকের মত ব্যবহার করলেও, পরে ছোট ছোট ঘটনায় বোঝা যায় ছেলেমানুষি ব্যাপারটা দীনেশের চরিত্রের বিশেষত্ব। পিঠের ব্যথায় কাতর দীনেশকে বার বার আহিরির সাহায্য নিতে দেখে মনে হয়েছিল, যে লোকটার এত বাড়াবাড়ি রকমের ব্যথা হয় সে একা একা স্প্রে লাগায় কি করে? পরে বোঝা যায় সেটা দীনেশের চাতুর্যের একটা নমুনামাত্র। বরং আহিরিকে অনেক বেশী পরিণত লাগে।
রক্তবরণ মুগ্ধকরণ
গল্প চলতে চলতে কোথাও যেন মনে হয় আজকের প্রজন্ম অনেক বেশী বুঝদার ও যে কোনও পরিস্থিতিতে মানিয়ে চলার ক্ষমতা রাখে। গল্পটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শুধু তারুণ্যের জয়গান শোনায় যেন। অভিনয়ে দুজনেই চরিত্রের প্রতি সুবিচার করেছেন।
এইচআইভি পজ়িটিভ
ছবির অন্যতম সম্পদ এই গল্পটি। এই গল্প নিয়ে নাটক হতে পারত, কবিতাও হতে পারত। ছবি হিসেবেও কিছু কিছু জায়গায় নাড়িয়ে দিয়ে গেছে জয় (অনির্বাণ) ও রজতের (সুপ্রভাত) কাহিনী। এই গল্পটির জন্য বিশেষভাবে ধন্যবাদ পরিচালককে। বাংলা ছবির সম্পদ হয়ে থাকবে এই গল্পটি। অনির্বাণ ও সুপ্রভাতের অভিনয় রসায়ণ দুর্দান্ত। এইচআইভি পজ়িটিভে আক্রান্ত এক মৃতপ্রায় রোগী, তার আনুষাঙ্গিক যা কিছু হতে পারে তা নির্মমভাবে দেখিয়েছেন অঞ্জন। পরিচালক ও অভিনেতা দুজনের এই সাহস প্রশংসার যোগ্য। যুগলবন্দীতে একে অপরের যোগ্য সঙ্গত করেছেন অনির্বাণ ও সুপ্রভাত। প্রতিদিন মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখতে দেখতে নিজের স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাওয়া, প্রতি মুহূর্তে কোনও না কোনও চরিত্রে একা একাই অভিনয় করে যাওয়া, যে অভিনয় অনির্বাণ সম্ভবত আগে কোথাও করেননি। প্রতিটা দৃশ্যে মুগ্ধ করলেন তিনি। কখনও জটায়ুরূপী সন্তোষ দত্ত তো কখনও রবার্ট ডি নিরোর ভূমিকায় কল্পনা করতে করতে নিজেকে উজাড় করলেন অনির্বাণ।
তাশি গাঁওয়ে একদিন
অবাক করলেন সুপ্রভাতও। একই চরিত্রে কাঠিন্য ও আবেগের বৈপরিত্যকে তিনি ফুটিয়ে তুললেন অনায়াসে। কম কথা বলেও একটি চরিত্রকে বাস্তব করে তোলার ক্ষমতা খুব বেশী অভিনেতার মধ্যে দেখা যায় না। দুজন পুরুষের ভালবাসায় সমকামিতাকে নানাভাবে দেখাবার সুযোগ থাকলেও শুধুমাত্র বন্ধুত্বের গভীরতাকে তুলে ধরে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন অঞ্জন।
‘ভালবাসা খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। অন্ধকারের মধ্যে দিয়েই প্রকৃত ভালবাসাকে ফিরে পাওয়া যায়।’ নিজের বলা কথাকেই ছবি দিয়ে প্রমাণ করলেন পরিচালক। সবশেষে বলা যায় ভালবাসার মাসে ভালবাসা খোঁজার যে প্রচেষ্টা তিনি করেছেন তা তার অনেক পুরনো কাজকে ছাপিয়ে গেছে। ডার্ক ও জটিল ছবির জন্য পরিচিত অঞ্জন ভালবাসার ছবির ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাবলীলভাবে নিজের বক্তব্যকে তুলে ধরেছেন ফাইনালি ভালবাসায়। ভবিষ্যতে তাঁর থেকে আরও এমন ভাল ছবির আশা রইল। নীল দত্তর সঙ্গীত ও আবহ ছবির সঙ্গে মানানসই।