অচেনা নয়, এই উত্তম প্রায় পুরোটাই চেনা
ছবি: অচেনা উত্তম
পরিচালনা: অতনু বসু
দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট
অভিনয়ে: শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়, দিতিপ্রিয়া রায়, সম্পূর্ণা লাহিড়ী, তীর্থরাজ বসু, বিশ্বনাথ বসু, প্রিয়াংশু চট্টোপাধ্যায়, রাতাশ্রী দত্ত, স্নেহা দাস, সায়ন্তনী রায়চৌধুরী।
RBN রেটিং: ২/৫
নায়ক আসে, নায়ক যায়। কিন্তু মহানায়ক থেকে যায় সারাজীবন আকাশের শ্রেষ্ঠ নক্ষত্র হয়ে। সাধারণ কেরানি থেকে বাংলা ছবির একমেবাদ্বিতীয়ম মেগাস্টার হয়ে ওঠার পথ মসৃণ ছিল না। সিনেমাপাড়ায় প্রথমদিকে তাঁকে ফ্লপমাস্টার জেনারেল, মাকাল ফল, এরকম বিভিন্ন নামে ডাকা হতো। তবু প্রতিভা যাঁর আছে, তাঁকে আটকে রাখবে কোন ভাগ্যদেবতা? সুচিত্রা সেনের বিপরীতে মুক্তি পেল উত্তমকুমারের অভিনয় জীবনের প্রথম সফল ছবি ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। শুধু সফল নয়, মারকাটারি হিট। এরপর আর সেভাবে তাঁকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক হিট ছবি দিতে-দিতে এই বাংলা ছবির ইন্ডাস্ট্রিই হয়ে উঠল তাঁর সংসার, ‘শশীবাবুর সংসার’। অতনুর ‘অচেনা উত্তম’-এর মোড়কে এই নক্ষত্রের জীবনযুদ্ধের বেশ কিছু অচেনা, অজানা কাহিনীই প্রত্যাশিত ছিল। সেই উত্তমকে কতটা পাওয়া গেল এই ছবিতে?
‘অচেনা উত্তম’ অন্য উত্তমকাহিনী বলতে ব্যর্থ। এই উত্তম কোনওভাবেই অচেনা নন। এই উত্তম প্রায় পুরোটাই চেনা। দীর্ঘদিন ধরে বহু পত্রিকায় বিভিন্ন অভিনেতার সাক্ষাৎকার এবং একগুচ্ছ মুচমুচে গসিপ নিয়ে এগিয়েছে ছবির চিত্রনাট্য। ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ ছবিতে অভিনয় করার সময় শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন উত্তম। তবু নিজেকে নিয়ে সচেতন না হয়ে সন্ধ্যাবেলা প্রযোজক দেবেশ ঘোষের পার্টিতে যোগ দিয়ে আকন্ঠ মদ্যপান করেন। এরপর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। সিনেমাপ্রেমী এই মানুষটি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের সঙ্গেই কাটিয়েছেন। কিন্তু অরুণ চট্টোপাধ্যায় কীভাবে উত্তমকুমার হলেন সেই কাহিনী অধরা থেকে গেল এই ছবিতে। এর থেকে সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ অনেক বেশি বাস্তবধর্মী ছিল, যা উত্তমকুমারের শ্রেষ্ঠ অভিনয় বলে বিবেচিত হয়।
আরও পড়ুন: নেপথ্যে গাইলেন জলি, স্টেজে দাঁড়িয়ে ঠোঁট মেলালেন রাহুল দেব বর্মণ
‘অচেনা উত্তম’ আসলে একদিকে উত্তম, সুচিত্রা, সুপ্রিয়া, সাবিত্রী আর অন্যদিকে উত্তম-গৌরীর যাপনের মেলবন্ধন। উত্তম-গৌরীর সুখী গৃহকোণে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে চেয়েছিলেন সুপ্রিয়া। বড় গিন্নীকে কোনওদিন সেভাবে অসম্মান না করলেও, কোথাও যেন এক অসম প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছিলেন সুপ্রিয়া। কিন্তু এ গল্প তো সকলেরই জানা।
অজানা উত্তমকে খুঁজে পাওয়া গেল ১৯৪৬ সালে কলকাতায় ব্রিটিশ বিরোধী গান লিখে মোর্চার নেতৃত্ব দিতে। এরপর ‘ছোটি সি মুলাকাত’-এর হাত ধরে হিন্দি ছবি প্রযোজনার ভুল সিদ্ধান্ত, বৈজয়ন্তিমালার মতো নৃত্যশিল্পীর সঙ্গে নাচের তালে পা মেলাতে গিয়ে দর্শকের কাছে হাস্যস্পদ হয়ে উঠেছিলেন উত্তম। তবু ভেঙে পড়েননি তিনি। মধ্যবয়সের কাছাকাছি পৌঁছেও শক্তি সামন্তের পরিচালনায় সুপারহিট দ্বিভাষিক ছবিতে অভিনয় করে গেছেন। ‘অচেনা উত্তম’ অনুযায়ী ব্যক্তিগত জীবনে কোথাও যেন বড্ড বেশি অসংযত হয়ে পড়েছিলেন উত্তম। কিন্তু কী সেই অসঙ্গতি, সেটা ছবিতে সে ভাবে পরিষ্কার বোঝা গেল না।
আরও পড়ুন: গার্হস্থ্য হিংসার শিকার, তবুও ঔজ্জ্বল্যে অম্লান
অভিনয়ের দিক থেকে শাশ্বতকে সাধুবাদ। ছবিতে নিজেকে উত্তমকুমার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টায় কসুর করেননি তিনি। সুচিত্রা সেনের ভূমিকায় চেষ্টা করেছেন ঋতুপর্ণাও। তবে কিছু ক্ষেত্রে তাঁর অভিনয় বেশ চড়া লাগে। গৌরীদেবীর চরিত্রে শ্রাবন্তী বেমানান। একাধিক দৃশ্যে তাঁর চুলের খয়েরি হাইলাইটস প্রেক্ষাগৃহে বসা দর্শকের বিরক্তির কারণ হলো। সুপ্রিয়ার চরিত্রে সায়ন্তনী ভীষণ ফ্যাকাসে অভিনয় করলেন। সুপ্রিয়ার সেই মোহময়ী অ্যাপিল সায়ন্তনীর চেহারা বা অভিব্যক্তি, কোথাওই ধরা পড়ল না। সাবিত্রীর চরিত্রে দিতিপ্রিয়া চেষ্টা করেছেন। তবে উত্তমকুমারের বয়স বাড়লেও, উত্তমের কল্পনায় সাবিত্রী কেন সেই কিশোরী থেকে গেলেন, সেটা বোঝা গেল না।
শর্মিলা ঠাকুরের চরিত্রে একটি ছোট দৃশ্যে অভিনয় করেছেন রাতাশ্রী। একঝাঁক তারকার মাঝে রাতাশ্রীর অভিনয় চোখে পড়ার মতো। পাশ থেকে তাঁকে অবিকল শর্মিলা ঠাকুরের মতোই দেখতে লাগছিল। এমনকি ‘নায়ক’ ছবিতে শর্মিলার সংলাপ বলা, শরীরীভাষা সবটাই বিশ্বাসযোগ্যভাবে ফুটিয়ে তুললেন তিনি। অল্পবয়সের উত্তম এবং গৌরীদেবীর চরিত্রে তীর্থরাজ ও স্নেহার অভিনয় সেভাবে দাগ কাটেনি। আর কোনওভাবেই সত্যজিতের সঙ্গে প্রিয়াংশুকে মেলানো যায় না। সত্যজিতের ব্যক্তিত্বের প্রায় কিছুই দেখা গেল না প্রিয়াংশুর অভিনয়ে। ‘ওগো বধূ সুন্দরী’র শেষ দৃশ্যের পুননির্মাণে সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়ের চরিত্রে সম্পূর্ণার অভিনয় অতিরঞ্জিত লাগল।
আরও পড়ুন: রেগে আগুন কমল মিত্র, সুবিধা হলো সত্যজিতের
ছবিতে রবীন্দ্রসংঙ্গীতের ব্যবহার অধিক। তবে শেষ দৃশ্যে উত্তমকুমার অভিনীত বহু ছায়াছবির নাম নিয়ে উপালী চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘ছদ্মবেশী গন্ধর্ব’ গানটি শুনতে ভালো লাগে।
উত্তমকুমারের জীবনী অবলম্বনে ছবির অভিনেতা-অভিনেত্রী নির্বাচনে পরিচালকের আরও অনেক বেশি যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন ছিল চিত্রনাট্য নির্মাণের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত রিসার্চ। যে গল্প আপামর বাঙালির জানা, যে গল্প ইতিমধ্যেই টেলিভিশন সিরিয়ালের দৌলতে দর্শককুল অনেকটাই জেনে গেছে, সেই জানা কাহিনীকে কেন বেছে নিলেন পরিচালক? সামান্য মাইনের কেরানি থেকে বাঙালির একমাত্র ম্যাটিনি আইডল হয়ে ওঠার সংগ্রাম, সেই জায়গায় টিকে থাকার পরিশ্রম, খ্যাতির আড়ালে থাকা ক্লান্তি, শেষজীবনে ভালো কাজ না পাওয়ার হতাশা, এর কোনওকিছুই পাওয়া গেল না ছবিতে। তবে কি মহানায়কের জীবনী হিসেবে থেকে যাবে শুধুই গসিপ? ছবির শেষে হয়তো বহু দর্শকের মনে থেকে যাবে এই প্রশ্নটা।