‘সবার উপরে লিঙ্গ সত্য’ আজও রূঢ় বাস্তব, মনে করেন রূপান্তরিত দুর্গা চারুলতা
RBN Web Desk: নারীশক্তির অন্যতম রূপ দুর্গার আবাহনে মহালয়ার দিন প্রতি বছর বিভিন্ন চ্যানেলে মহিষাসুরমর্দিনীর অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়। বিভিন্ন নায়িকাকে দুর্গার নানা রূপে অভিনয় করতে দেখা যায়। তবে এই প্রথমবার কোনও রূপান্তরিত নারীকে দুর্গার এক বিশেষ রূপে টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যাবে। বাংলায় তো বটেই, ভারতেও সম্ভবত এই প্রথম এরকম কিছু ঘটতে চলেছে। সোনার বাংলা চ্যানেলে মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানে দুর্গার রূপে অভিনয় করবেন বিশিষ্ট বাচিকশিল্পী চারুলতা প্রামানিক। চারুলতার আর এক পরিচয় তিনি রূপান্তরিত নারী। প্রতিষ্ঠিত বাচিক শিল্পী ঋতুরাজ থেকে বর্তমানে তিনি চারুলতা নামে পরিচিত।
দুর্গার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া নিঃসন্দেহে যে কোনও নৃত্যশিল্পীর কাছে অত্যন্ত গর্বের।
কেমন লেগেছিল এই কাজের প্রস্তাব পেয়ে?
“ভালো তো নিশ্চয়ই লেগেছিল, তবে অবাক হইনি। কারণ আমি শুরু থেকেই টিভি চ্যানেলে কাজ করেছি। যখন আমি ঋতুরাজ ছিলাম তখন থেকেই। শুরুটা হয় দূরদর্শন থেকে। তারপর রূপসী বাংলা, তারা, আকাশ আট, বিভিন্ন চ্যানেলে বাচিকশিল্পীরূপে বা সঞ্চালক হিসেবে কাজ করেছি। রূপান্তরের আগেও আমি এই সব চ্যানেলের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। তবে নাচ নিয়ে এটাই আমার প্রথম কাজ,” রেডিওবাংলানেট-কে জানালেন চারুলতা।
আরও পড়ুন: শেষ দৃশ্যে ভাঙা হোল্ডার, সত্যজিতের জয়জয়কার
শুরু থেকেই তাঁর নাচ ভালো লাগে বলে জানালেন চারুলতা। এর আগে বহু কোরিওগ্রাফির কাজ করলেও নিজে নাচের মাধ্যমে সামনে আসার সাহস তখনও তাঁর হয়নি। “এর আগে রথযাত্র্রার উপর একটা ডকুফিচার করেছিলাম। সাবর্ণ রায়চৌধুরীর বাড়ির মেজবউয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম তখন। তারপর মহালয়ার অনুষ্ঠানের জন্য মহাকালীর চরিত্র করার প্রস্তাব পাই। কাজটা করে খুব ভালো লেগেছে। আমরা সকলেই সংযুক্তাদি (বন্দ্যোপাধ্যায়) কাজ দেখেছি মহিষাসুরমর্দিনীতে। উনি খুব স্নেহ করেন আমাকে। উনিও আমার কাজ দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন,” বললেন চারুলতা।
নিজের শরীর পরিবর্তনের খুব একটা প্রয়োজন শুরুতে বোধ করেননি চারুলতা। তবে মঞ্চে পাঠ করার সময় যখন মধুবন্তী মৈত্র বা ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়কে সুন্দর করে সাজতে দেখতেন তখন কোথাও একটা কষ্ট অনুভব করতেন তখনকার ঋতুরাজ। সেখান থেকেই শরীর পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন আজকের চারুলতা।
আরও পড়ুন: বেহিসেবী জীবনযাপন, আজ স্মৃতির অতলে সৌমিত্র
“আমি সুজয়প্রসাদদাকে (চট্টোপাধ্যায়) সবসময় বলতাম ‘তোমার খুব সাহস এভাবে নিজের ইচ্ছেটাকে নিজের সাজের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারো।’ আমার সেই সাহস ছিল না। আসলে তুমি যে লিঙ্গের সেই লিঙ্গের বিপরীত সাজগোজ করা ও তাকে ক্যারি করার জন্য সাহস লাগে। সেটা তখন আমার ছিল না। তবে রূপান্তরের পর মনে হয়েছে বহু প্রান্তিক মানুষ যাঁরা নানা সৃষ্টিশীল কাজে জড়িয়ে আছেন, আমি তাঁদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারছি,” বললেন চারুলতা।
রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তাঁকে কখনও বিরূপ সমালোচনা শুনতে হয়নি বলে জানালেন চারুলতা। পরিবার ও বন্ধুদের সমর্থন তিনি সবসময়ই পেয়ে এসেছেন। তবে সবাই তাঁর মতো ভাগ্যবান নন, এটাও মেনে নিচ্ছেন তিনি। “প্রায় সব রূপান্তরকামীকেই নিজের ইচ্ছে প্রকাশের বিনিময়ে সমালোচনা শুনতে হয়। আসলে যতই হোক, বৃহত্তর দুনিয়ায় আজও সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে লিঙ্গ, এটাই বাস্তব,” বললেন চারুলতা
আরও পড়ুন: সব কান্নার শব্দ হয় না, বেজে উঠল পটদীপ
অত্যন্ত প্রগতিশীল এক পরিবারের সদস্য বলেই তাঁর দ্বিতীয় সত্বা নিয়ে কখনও তাঁকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়নি বলে জানালেন চারুলতা। বিদেশে কর্মরত বাবা, মিডিয়া দুনিয়ার সঙ্গে জড়িত মা ছোট থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুলের ইসলামের লেখার সঙ্গে তাঁকে পরিচিত করিয়েছেন। ফলে তাঁকে কোনওরকম সংকীর্ণতার মুখোমুখি হতে হয়নি। এছাড়াও বাচিকশিল্পী হিসেবে নিজেকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার পরেই রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। ফলে কোথাও কোনও বিরূপ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হননি চারুলতা।
আগামীদিনে রবীন্দ্রনাথের ‘চণ্ডালিকা’ নৃত্যনাট্য নিয়ে কাজ করতে চলেছেন তিনি। তাঁর মতে, “একই শরীরে দুরকম সত্বার বা একই জন্মে জন্মান্তরের কাহিনী হিসেবে ‘চিত্রাঙ্গদা’র কথা সকলেই বলেন। কিন্তু আমার মনে হয় ‘চণ্ডালিকা’ অনেক বেশি করে প্রান্তিক মানুষের কথা বলে। অস্পৃশ্যতা জিনিসটা যেভাবে একজন প্রান্তিক মানুষ অনুভব করেন, তাঁদের যেভাবে সকলের থেকে আলাদা করে রাখা হয় সেটা প্রকৃতির অভিব্যক্তির মধ্যে দিয়ে অনেক বেশি করে ফুটে ওঠে।”
এছাড়াও আগামী দিনে সংবাদ পাঠিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছেন চারুলতা। “তাসনুভা আনন শিশির বাংলাদেশের প্রথম রূপান্তরিত নারী সংবাদপাঠিকা। তাঁর কথা আমি জেনেছি কিছুদিন আগে। এখানে বহু চ্যানেল থেকে আমি সংবাদ পাঠিকা হিসেবে কাজ শুরু করার প্রস্তাব পেয়েছি। আগামী নারী দিবসে সেই কাজে পা রাখার ইচ্ছে আছে। কোন চ্যানেলের হয়ে করব সেটা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে এটা করতে পারলে প্রথম ভারতীয় রূপান্তরিত নারী হিসেবে একটা মাইলফলক ছুঁতে পারব আশা রাখি,” জানালেন চারুলতা।