স্বাভাবিক রসবোধ হারিয়ে বাঙালি কেমন যেন গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে: অঞ্জন দত্ত

মৃণাল সেনের জন্মশতবর্ষ শেষ হতে আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। সেই দিনকে সামনে রেখেই কাল মুক্তি পেতে চলেছে অঞ্জন দত্ত (Anjan Dutt) পরিচালিত ও অভিনীত তাঁর ব্যক্তিগত ট্রিবিউট ‘চালচিত্র এখন(Chalchitra Ekhon)। মৃণাল সেন এবং তাঁর নতুন ছবি নিয়ে একান্ত সাক্ষাৎকারে রেডিওবাংলানেট-এর সঙ্গে অঞ্জন ভাগ করে নিলেন তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত 

এই ছবি প্রসঙ্গে একটা কথা আপনি বারবার বলেছেন এবং সেটা ছবিতেও আছে যে রাজনৈতিক আদর্শ বা সামাজিক দিক থেকে আপনি এবং মৃণাল সেন দু’ধরনের মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। ওঁর মতো পরিচালক সেই সময় আপনার মতো আনকোরা একজন অভিনেতাকে নিজের বিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যেতে বাধা দেননি?  

অঞ্জন: আমি যখন ছবি করতে এলাম তখন নিজের মতামতটা বলতে শিখেছি. তার আগে যে সময় থিয়েটার পরিচালনা শুরু করি তখন আমার ২১-২২ বছর বয়স। সেই সময় যারা আমার কাজ দেখছেন তাদের সঙ্গেও আমার মতামতের পার্থক্য দেখা গেছে। আমরা এমন একটা সময় বড় হয়েছি যখন কেউ যদি দেখতেন এই ছেলেটি বা মেয়েটি যা বলছে সেটা জেনে বা পড়াশোনা করে বলছে, তাহলে তাকে চুপ করিয়ে দেওয়া হতো না। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হতো, সেটার জন্য আমিও ভুগেছি। ছবিতেও আছে সেটা। তা সত্ত্বেও, মৃণাল সেন আমার দেখা একমাত্র মানুষ যিনি নিজের বিশ্বাস, নিজের মতবাদের বাইরে থাকা মানুষকেও আপন করে নিতে পারতেন। আমাদের মধ্যে মত পার্থক্যটা ছিল ব্যক্তি এবং সমষ্টি নিয়ে। বর্তমান সময়ের থেকে তখন মানুষ অন্যকে বা অন্যের মতকে অনেক বেশি গ্রহণ করতে জানতেন। তবে সিনেমা জগতের মানুষের ক্ষেত্রে এই একাত্তর বছরের জীবনে আমি আজ পর্যন্ত এত উদারমনষ্ক মানুষ আর দেখিনি। আমি নিজেও সেটাই শিখেছি। আজ যদি কেউ আমার সামনে এসে বলেন মৃণাল সেনের ছবি আমার ভালো লাগে না তাহলে তাকে আমি তাড়িয়ে দেব না বা অশিক্ষিত বলব না। হয়তো তাকে বোঝাতে চেষ্টা করব। কিন্তু প্রত্যেকটা মানুষের স্বতন্ত্র পছন্দ থাকবেই। সেটার জন্য তাকে আমি যা খুশি বলতে পারি না। 



ছবিতে এক জায়গায় আপনি, মানে রঞ্জন বলছে, আমি তো কমিউনিস্ট নই, তার মানে আপনি আমাকে ছবিতে নেবেন না। অর্থাৎ আপনি একসময় মনে করতেন রাজনৈতিক মতবাদ না মিললে উনি আপনাকে বাদ দিয়ে দিতে পারেন 

অঞ্জন: আমি সেরকমই ভাবতাম। এরপর নিশ্চয়ই উনি আমাকে আর প্রশ্রয় দেবেন না। কিন্তু কোথাও উনি আমাকে বললেন না যে আমি ভুল বা ওঁর সঙ্গে আমাকে একমত হতে হবে। আমি অবাক হয়ে গেছিলাম দেখে যে সেই সময়ে আমাকে সবাই যেখানে ভুল বলছে, আমার ক্রিটিক, আমার বস, আমার বাবা-মা পর্যন্ত আমাকে এত গুরুত্ব দিচ্ছেন না, সেখানে এই অচেনা লোকটি দিচ্ছে। সে আমার সিনেমার রোল নিয়ে কথা বলছে না, শুটিং নিয়ে কথা বলছে না, ছবি নিয়ে কথা বলছে না। উল্টে সে শুধু আমার কথা শুনছে। যে কথাগুলো আগে কেউ কোথাও শুনতে চায়নি। আমার বিশ্বাসের কথা এই লোকটা শুনতে চাইছে কেন! মৃণাল সেনকে এত ভালোবেসে ফেলার একটাই কারণ, নিজের মতামত চাপিয়ে না দিয়ে অন্যের কথা শোনার ওরকম আন্তরিকতা আমি আর কারও মধ্যে দেখিনি। আর একটা জিনিস, ওঁর বাড়িতে বা আশেপাশে কখনও কোনও স্তুতি করার লোককে দেখিনি। উনি পছন্দই করতেন না। 

‘খারিজ’ আর ‘চালচিত্র’, এই দুটো ছবির ক্ষেত্রেই উনুনের ধোঁয়ার প্রসঙ্গ আর সেই নিয়ে তৈরি হওয়া সমস্যা উঠে এসেছে। এগুলো নিশ্চয়ই সচেতনভাবেই এসেছে

অঞ্জন: তার কারণ ক্লাস ডিফারেন্স বোঝাতে সেই সময় ওই উনুনের ধোঁয়ার প্রয়োজন ছিল। ওঁর কাছে ফ্রিজিডেয়ার বা এয়ার কন্ডিশনার এগুলো সিনেমার ভাষার ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এগুলো কতটা নেসেসিটি আর কতটা লাক্সারি? কতটা জরুরি একটা কাজের লোক রাখা? একটা ছোট ছেলেকে দিয়ে আমি কাজ করাচ্ছি কেন? এগুলো নিয়ে উনি ভাবতেন। ওঁর বাড়িতে যে কাজের লোক ছিল না তেমন নয়। মৃণাল সেন (Mrinal Sen) কোনওদিন বাসন মাজেননি! কিন্তু নিজের বাড়িতে আছে বলে সেটাকে উনি জাস্টিফাই করছেন তেমনও নয়। উনি সেটা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। এই জন্যই উনি মৃণাল সেন। খেয়াল করে দেখবে, ‘খারিজ’-এ আমার চরিত্রের নাম কিন্তু অঞ্জন দত্ত নয়, অঞ্জন সেন। তাহলেই বুঝে দেখো কেন অঞ্জন সেন! 

আপনার নতুন ছবির প্রসঙ্গে আসি। অঞ্জন দত্ত ছবি করবেন মৃণাল সেনকে নিয়ে, যাঁদের মধ্যে এতদিনের সম্পর্ক, বোঝাপড়া, সেখানে তাঁর শতবর্ষে একটা ছবি তৈরি করতে কি প্রযোজক পেতে সমস্যা হতো? ছবিটা আপনি আর নীল (দত্ত) মিলে প্রযোজনা করলেন কেন? 

অঞ্জন: না-না, প্রযোজক পেতে কোনও সমস্যাই হতো না। আসলে ‘চালচিত্র এখন’ আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ছবি। এটা একেবারে নিজেদের মতো করেই বানাতে চেয়েছিলাম যেখানে কোনও তৃতীয় ব্যক্তির হস্তক্ষেপ থাকবে না। কারণ এই ছবির ভেতরের গল্প, মজা, এগুলো আমি জানি। আর কেউ সেটা ঠিক সেইভাবে বুঝবে না। 

আরও পড়ুন: আবারও কানে ‘মন্থন’

তার মানে আপনার মতো সিনিয়র পরিচালককেও প্রযোজকের হস্তক্ষেপ মেনে নিতে হয়? 

অঞ্জন: সে তো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। এই ছবিটা দর্শকের যেমনই লাগুক, আবার আমার পরের ছবিতেই সে জিনিস হবে, এ আমি জানি। তাতে কিছু অস্বাভাবিকতা নেই। স্বয়ং মৃণাল সেনকেও এই জিনিস নিয়েই চলতে হয়েছে। সেই জন্যই উনি সবসময় বলতেন কম টাকায় ছবি বানাও। 

এটা কি খুব আফসোসের জায়গা নয় যে আপনার এই ট্রিবিউট উনি দেখে যেতে পারলেন না? ছবিটা দেখে কী বলতেন উনি? কী মনে হয়? 

অঞ্জন: এটা সত্যিই বারবার মনে হচ্ছে যদি মৃণালদাকে দেখাতে পারতাম। খুব মিস করছি ওঁকে। এটা আমার কর্তব্য ছিল। আমি শিওর উনি খুব খুশি হতেন, মজা পেতেন। তারপর এসে হয়তো গীতাদিকে (সেন) বা ছন্দাকে (দত্ত) বলতেন টাকাগুলো সব নষ্ট করল, না? বাঁদরগুলো সব টাকা নষ্ট করে দিল! খুব স্নেহের সঙ্গে বলতেন। আমি যে এই শহরে থেকে গিয়ে গান, অভিনয়, থিয়েটার, বা ছবি পরিচালনা করলাম, হাবিজাবি যাই করে থাকি না কেন, সেটা করতে পেরেছি তো সেই একজন মানুষের জন্যই। যিনি আমাকে এই শহরটা চেনালেন। এটা আমার করা দরকার ছিল। তবে এর মধ্যেও আমার প্রাপ্তি আর ভালোলাগা একটাই, ছবিটা মৃণালদার জন্মশতবার্ষিকীতে রিলিজ় করছে। ঠিক সময়ের মধ্যে, ১০০ বছর চলার মধ্যেই ছবিটা আমি তৈরি করতে পেরেছি। এটা খুব আনন্দের জায়গা। 

আরও পড়ুন: সত্যজিতের আরও দুটি ছবি সংরক্ষণের কাজ শুরু

শাওনকে (চক্রবর্তী) আপনার ভূমিকায়, মানে রঞ্জন হিসেবে কাস্ট করলেন কীভাবে? 

অঞ্জন: ও! সে এক বিরাট ব্যাপার! প্রায় ছ’সাত মাস লেগে গেছিল খুঁজতে। খুব কষ্ট হয়েছে খুঁজে বার করতে। কারণ আমি অভিনেতা খুঁজছিলাম। চেহারার মিল নয়। শুধু চেহারার মিল দিয়ে একটা চরিত্র তৈরি হয় না। সেটা হাবভাব বা ওইভাবে সংলাপ বলেও করা যায়। যে কারণে আমি নিজে মৃণালদার চরিত্রটা করেছি। কারণ আমি তো জানি উনি কীভাবে কথা বলতেন বা নির্দেশ দিতেন। মৃণাল সেনও অভিনেতা খোঁজেননি, উনি দেখেছিলেন একজন সাংবাদিককে যে অভিনয়টা করতে পারে। আমিও তো সেরকমই খুঁজেছি একজন শিক্ষিত ছাত্র, রিসার্চ স্কলার, যে পড়াশোনা করে, অভিনয় জানে, গান-টান করে এরকম কেউ। যার জন্য আমি আটকে গেলাম প্রেসিডেন্সি, যাদবপুর কিংবা জেএনইউতে। ওরকম জায়গা থেকে একজনকে আমার দরকার ছিল যে একটু উদ্ধত, পাকা, একটু ইংরেজি ঘেঁষা, গিটার বাজাতে জানবে, এরকম কাউকেই খুঁজছিলাম। শেষে শাওনকে যাদবপুরে পেলাম। আমি শুধু ওকে আর একটু রোগা হতে বলেছিলাম। আসলে আমি একদম খ্যাংরা কাঠির মতো রোগা ছিলাম। মৃণালদা কী রেগে যেতেন, গেঞ্জি পরলে খুব খারাপ দেখতে লাগত বলে। সেরকম রোগা শাওন হতে পারেনি। আমি ওকে আমার মতো হতে বলিনি। শুধু আমার মতো বইপত্র পড়তে বলেছিলাম। আর বলেছিলাম নিজের চিন্তাভাবনা নিয়ে গর্বিত হওয়া শুরু করো। আমি তোমাকে রেসপেক্ট করতে চাই। তুমি শুধু আমার ছবির অভিনেতা নও। আমার বাড়িতে আসছ, আমার ছবিতে কাজ করছ বলেই আমার বা ছন্দার সব কথার সঙ্গে তোমাকে সহমত হতে হবে এমন একেবারেই নয়। আমি ওকে বলেছিলাম উদ্ধত হয়ে উঠতে। কারণ আমি নিজে সেরকমই ছিলাম। কান্না ব্যাপারটাকে তখন আমি দুর্বলতা মনে করতাম। তখন শুধুমাত্র বৌদ্ধিক গুণকেই আমি গুরুত্ব দিতাম। বরং এখন অনেক বেশি করে বুঝি শুধু বুদ্ধি নয়, আবেগও দরকার। 

মৃণাল সেনের ছবির ভেতর একটা স্পষ্ট রাজনৈতিক মতামত থাকত। সে ব্যাপারে উনি খুব সোচ্চার ছিলেন। আপনার ছবিতে কখনও সেভাবে রাজনৈতিক মতামত উঠে আসে না। এর কোনও বিশেষ কারণ আছে? 

অঞ্জন: দেখো, আমি বরাবর ব্যক্তিস্বাতন্ত্রকে গুরুত্ব দিয়েছি আমার গানে, লেখায়, ছবিতে, সব জায়গায়। আমি রাজনৈতিক দিকটা নিয়ে কাজ করিনি। আর মৃণাল সেনের কাজে শুধু রাজনৈতিক কেন, ওঁর মতো মানবিকতার ছবি, ভালোবাসার ছবি ক’জন বানিয়েছে? ‘ভুবন সোম’-এর মতো প্রেমের গল্প ক’টা হয়েছে? ‘অন্তরীন’, সেও তো প্রেমের গল্প। রাজনীতি, ফেমিনিজ়ম এসব তো অনেক পরের ব্যাপার, ওঁর ভেতরে যে একটা অদ্ভুত মানবিক দিক ছিল সেটা আমকে আজও টানে। আমি এখনও ওঁর কাজ দেখে নতুন করে ভাবতে পারি। ‘ইন্টারভিউ’ যেমন একটা অন্য ধরনের ছবি। টিপিকাল পলিটিকাল ছবি বলতে যা বোঝায়, তা উনি কখনওই করেননি। ওরকম স্টাইলিশ, ফর্মের কায়দা এরকমও এ দেশে আর কেউ করেননি। গল্প ধরে ছবি করা, সেটা উনি কোনওদিন করেননি। আমি নিজেও এটা ওঁর থেকেই শিখেছি। ব্যোমকেশ সিসিরজ় বাদ দিলে আমার ছবিগুলোর মধ্যে নানারকম জিনিস উঠে এসেছে। নিটোল একটা গল্প বলতে হবে ছবির মাধ্যমে, এ আমিও বিশ্বাস করি না। বরং অনেকগুলো জিনিসের মধ্যে দিয়ে বক্তব্যটা উঠে আসুক। 

আরও পড়ুন: হাতাহাতির গল্প শোনালেন অপরাজিতা

সুপ্রভাতকে (দাস) কেকে মহাজনের চরিত্রে নিলেন। এরকম দাপুটে চরিত্রে ওকে আগে দেখা যায়নি

অঞ্জন: আমি মনে করি সুপ্রভাত খুব বড় অভিনেতা আর ওকে নতুন-নতুন চ্যালেঞ্জ দেওয়া যায়। আমি মহাজনকে যেভাবে দেখেছি সেটাই ওকে বলেছিলাম। যেরকম ওকে বলেছিলাম ও ঠিক সেটাই করে দেখিয়েছে। ওকে আমি ভীষণ বিশ্বাস করি, তাই জানতাম ও পারবে। আমি নিজে মৃণাল সেনকে যত না ভয় পেতাম, মহাজনকে তার চেয়ে বেশি ভয় পেতাম। ভালোবাসতামও অসম্ভব রকমের। মহাজনও আমাকে ভীষণ স্নেহ করত। একটা সময় ইংরেজিতে যাকে বলে বুলি, সেরকম করত। আবার ভালোওবাসত। ওঁর স্ত্রীর সঙ্গে এখনও আমার যোগাযোগ আছে। আমি তখন আল পাচিনোর বিরাট ভক্ত। সারাক্ষণ ওই নিয়েই আছি। আমাকে ও আল পাচিনো বলেই রাগাত। শেষে যখন দেখল গান গাই, তখন বলে কিনা তানসেন! আমার খুব মনখারাপ হয়েছিল শুনে। শেষে তানসেন বলল! অন্তত বব ডিলন তো বলতে পারত। তাতে বলে কিনা তুমি তো সেনের চ্যালা তাই তানসেন নাম দিলাম! এইরকম সব কাণ্ড করেছি আমরা। 

Anjan Dutt

শাওন ও (ডানদিকে) সুপ্রভাত

এই ছবির অন্যতম চরিত্র কলকাতা। মৃণাল সেনের কলকাতাকে দেখাতে গিয়ে ছবিটাকে পিরিয়ড পিস হিসেবে তৈরি করলেন না কেন? একটা শহরকে পাল্টে ফেলা কঠিন হতো বলে?

অঞ্জন: এই ব্যাপারে আমি আর নীল একমত ছিলাম কারণ এই গল্প তো এখনও প্রাসঙ্গিক। একজন বয়স্ক মানুষের সঙ্গে একটি ছেলের বন্ধুত্বের গল্প তো আজও এরকমই হবে। এই জন্যই প্রযোজক খুঁজিনি আমরা। প্রযোজক এই ছবিকে পিরিয়ড পিস বানিয়ে দিত। আমার কাছে বিশাল টাকা থাকলেও আমি এটাকে পিরিয়ড ছবি করতাম না। সেটা আমি চাইনি। এমন নয় যে খরচ কিছু কম হয়েছে। যে পুরোনো পাখাওয়ালা ট্রাম ব্যবহার করেছি, সেটার পেছনে বিরাট খরচ হয়েছে। এছাড়া অ্যাম্বাসেডর গাড়ি, টু-সি ক্যামেরা এগুলো জোগাড় করতে খরচ তো হয়েছেই। কিন্তু একজন রাস্তায় হাঁটছে যখন পিছন দিয়ে একটা নতুন গাড়ি চলে যাচ্ছে এটা নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে চাইনি। কারণ মৃণাল সেন আজও একইরকম প্রযোজ্য। তাই ছবিটা টাইমলেস থাকাই ভালো। 



মৃণাল সেনের শতবর্ষে আপনি এই ছবিটা করলেন, আরও দুটো ছবি হয়েছে ওঁর ওপরে। এর বাইরে আর কোনও কাজ হয়নি। কোথাও গিয়ে কি মৃণাল সেনকে নিয়ে উদযাপন বা উচ্ছ্বাস কিছুটা কম মনে হচ্ছে? 

অঞ্জন: আমার মনে হয় উল্টোটা। মৃণাল সেনকে নিয়ে উদযাপন বেশিই হচ্ছে। এতটা হবে আমিও আশা করিনি। সত্যজিৎ রায়ের শতবার্ষিকী কোভিডের মধ্যে পড়ায় খুব বেশি কিছু হতে পারেনি। একটাই ছবি হয়েছিল ওঁর জীবনের ওপর। সেখানে মৃণাল সেনকে নিয়ে তিনটে সিনেমা হয়েছে। আমি করেছি, কৌশিক (গঙ্গোপাধ্যায়) করেছে, সৃজিত (মুখোপাধ্যায়) করেছে। এছাড়া জেলায়-জেলায় ফেস্টিভাল, আমেরিকায় চারটে, এখানে অজস্র অনুষ্ঠান, আলোচনা, ওঁর ওপর বই বেরোলো। কতগুলো অনুষ্ঠানে তো আমিই গেলাম। হ্যাঁ এটা বলা যায় যে সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে সব বয়সের মধ্যে একটা উন্মাদনা আছে, সেটা এই কারণে যে উনি ছোটদের জন্য অনেকগুলো ছবি করেছেন। ওঁর ডিটেকটিভ গল্প খুব জনপ্রিয়। এছাড়া উত্তমকুমারকে নিয়ে ছবি করেছেন, সেটা সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবেই দেখেছে। কিন্তু ওঁর ‘মহানগর’, ‘দেবী’, ‘অপরাজিত’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এগুলো কতজন দেখেছেন বা বুঝেছেন! মৃণাল সেন ডিটেকটিভ গল্প বা ছোটদের জন্য কিছু তৈরি করেননি বলেই সেরকম জনপ্রিয় নন। কিন্তু উনি যে ছবিগুলো করেছেন, সেগুলো সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে। জটিল মনস্তত্ত্ব এবং পরীক্ষামূলক ছবি করেছেন।

আরও পড়ুন: বাংলা ছবিতে রাহুল রায়

আর সেটাও করেছেন বেশ সাদামাঠাভাবেই

অঞ্জন: মৃণালদা একটা ছবি তৈরির সময় বাজারের কথা না ভেবে অনেক বেশি বেপরোয়াভাবে কাজ করেছেন। টাকার থেকেও সিনেমার ভাষা বা সিনেমার প্রয়োজনীয়তা যে বেশি সেটা আজকের দিনে বোঝা খুব দরকারি। এইসব (টাকার কথা) ভাবতে গিয়ে সিনেমাটাই পিছিয়ে পড়ছে। আর সবাই আজকাল কী অসম্ভব সিরিয়াস! কাজের মধ্যে কোনও মজা নেই। যার ছবি চলছে সে ভালো, যার চলছে না সে খারাপ, এটা কেমন কথা! কেউ খারাপ সিনেমা বানাবে না কেন? সবরকম ছবি হোক। কলকাতা একটা সেলিব্রেশনের শহর। সবাই আজকাল বড্ড বেশি সিরিয়াস। কেন কেউ বলতে পারবে না আমার সত্যজিৎ রায়কে ভালো লাগে না। কিংবা আমার অনিল চট্টোপাধ্যায়কে উত্তমকুমারের থেকে বেশি ভালো লাগে! বললেই সবাই রেগে যাবে কেন? অর্থাৎ বাঙালি পুজো করতে শুরু করেছে একজন কিংবদন্তি মানুষকে। রবীন্দ্রনাথের সব গান কারও ভালো নাই লাগতে পারে, তার জন্য তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে কেন? কারও যদি মাইকেল মধুসূদনকে রবীন্দ্রনাথের থেকে বেশি ভালো লাগে তাতে তো দোষের কিছু নেই। বাঙালির স্বাভাবিক রসবোধ হারিয়ে গিয়ে কেমন যেন গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে সবাই। এই জিনিসটা আমাকে খুব অবাক করে। বাঙালি কিন্তু এমন ছিল না!




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
1

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *