এই ডকুমেন্টেশনের প্রয়োজন ছিল
ছবি: অভিযান
পরিচালনা: পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়
অভিনয়ে: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, যিশু সেনগুপ্ত, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, দেবশঙ্কর হালদার, পাওলি দাম, রুদ্রনীল ঘোষ, বাসবদত্তা চট্টোপাধ্যায়, ডলি বসু, সোহিনী সেনগুপ্ত, ত্রিধা চৌধুরী, তুহিনা দাস, কৌশিক (কিউ) মুখোপাধ্যায়, দুলাল লাহিড়ী, বিশ্বনাথ বসু, সোহিনী সরকার, সমদর্শী দত্ত, অভিজিৎ (রানা) গুহ, সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভাশিস মুখোপাধ্যায়, নীল মুখোপাধ্যায়, তনুশ্রী চক্রবর্তী
দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ২৮ মিনিট
RBN রেটিং: ৩.৫/৫
দুটি সত্বা। তার একটি অবশ্যই শিল্পী সত্বা। দ্বিতীয়টি হলো পেশাদার অভিনেতার। প্রথমটা তাঁর অস্তিত্বের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। আর দ্বিতীয়টা অনেকটা পোশাকের মতো, কিংবা মেকআপের মতো। অভিনয়ের পর সেটা ছেড়ে ফেলতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তবে এই সত্বাই তাঁর সংসার চালিয়েছে, তাঁকে তারকা বানিয়েছে। কিন্তু তারকা মানেই তাকে দূরের আকাশের নক্ষত্র হতে হবে এমনটা কোনওদিনই বিশ্বাস করেননি সৌমিত্র। তাঁর কাছে স্টার মানে নিজের শর্তে মানুষের কাছাকাছি থেকেই ওই তারকার তকমাটা গায়ে জড়িয়ে নেওয়া। সেই তারকার এমন নানা উপলব্ধির কথাই উঠে এল ‘অভিযান’-এ। তাঁর দীর্ঘ ষাট বছরের ফিল্ম কেরিয়ারকে মাত্র আড়াই ঘন্টায় রিলবন্দী করেছেন পরিচালক। সহজ কাজ ছিল না। হয়তো আরও অনেক কিছু বলা যেত। হয়তো অনেকটাই না বলা রয়ে গেল। তবু যেটুকু বলা হলো আপামর বাঙালির প্রিয় অভিনেতাকে জানার ও চেনার জন্য তাও বড় কম নয়।
চিকিৎসক সঞ্জয় সেন (পরমব্রত) বিদেশে থাকেন। তার ইচ্ছে সৌমিত্রকে নিয়ে একটি ছবি করার। যেমন তেমন ছবি নয়, সৌমিত্রের জীবনের গল্প নিয়ে তৈরি হবে সেই ছবি। সেখানে নিজের কথা বলবেন সৌমিত্র নিজেই। প্রথম অবস্থায় এরকম প্রস্তাবে সৌমিত্র রাজি হননি। তার কারণ সঞ্জয়ের অভিজ্ঞতার অভাব। কিন্তু আচমকা নাতি রণদীপ বসুর দুর্ঘটনা তাঁকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দেয়। রণদীপ সুস্থ হয়ে উঠবেন একদিন, কিন্তু তাঁকে নিজের সম্পর্কে এত কথা বলার, এত কনফেশন করার জন্য তিনি থাকবেন তো?
সৌমিত্র রাজি হলেন সঞ্জয়ের প্রস্তাবে। শুরু হলো একের পর এক প্রশ্নোত্তর পর্ব। পেঁয়াজের খোসার মতো পরতে-পরতে খুলতে থাকল মানুষ সৌমিত্রের নানা অনুভূতি, আবেগ ও উপলব্ধি। এত গভীরভাবে জীবনকে জানা ও ব্যাখ্যা করা হয়তো তাঁর মতো কিংবদন্তি মানুষের পক্ষেই সম্ভব ছিল। স্মৃতিচারণে বারবার উঠে এল পুরোনো নানা ছবির দৃশ্যের পুনর্নির্মাণ। ফিরে এল তাঁর ছোটবেলা, শক্তি-সুনীল-সন্দীপনদের সঙ্গে কফিহাউসের আড্ডা, সক্রিয় রাজনীতি, শিশির ভাদুড়ির (দেবশঙ্কর) কাছে অভিনয়ের হাতেখড়ি, রাজনীতি ও নাটকের মধ্যে দোলাচল, নিজের নাটকের দল ‘ছায়ানট’, বান্ধবী দীপার সঙ্গে স্বপ্ন দেখা, নির্মাল্য আচার্যের সঙ্গে ‘এক্ষণ’ পত্রিকার সম্পাদনা, সত্যজিৎ রায়ের (কিউ) ছবিতে ডাক পাওয়া। তারপর একে-একে এল ‘অপুর সংসার’, ‘চারুলতা’, ‘যদি জানতেম’, ‘আকাশকুসুম’, ‘সমাপ্তি’, ‘ঝিন্দের বন্দী’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ও তাঁর প্রিয় ছবি ‘অভিযান’-এর স্মৃতি।
আরও পড়ুন: কলকাতায় শ্যুটিং সারলেন পরেশ রাওয়াল, সত্যজিৎ রায়ের গল্প?
কাহিনী অসংখ্য। যে কোনও সাধারণ মানুষের জীবনেই এতরকম গল্প থাকে যে বলে শেষ করা যায় না। আর এ তো এক কিংবদন্তির জীবন, যিনি একাধারে মঞ্চশিল্পী, কবি, বড়পর্দার সফল অভিনেতা, আবৃত্তিকার, চিত্রশিল্পী, রাজনীতি সচেতন মানুষ এবং দার্শনিকও। তাঁর জীবন তো সহজ সরল হতে পারে না। হয়তো সেখানে প্রচুর চড়াই উৎরাই নেই, তবু অভাব নেই ঘটনাবলীর, অভাব নেই ভালোমন্দ স্মৃতির, অভাব নেই অভিজ্ঞতার। একদিকে নিজের শিল্পীসত্বাকে বাঁচিয়ে রেখেও ছোটবড় সবরকম ছবিতে কাজ করে যাওয়া। অন্যদিকে চোখের সামনে নাতির অসুস্থতা দেখেও প্রায় কিছুই করতে না পারা, কতটা মনের জোর থাকলে এরপরেও শেষবেলায় এসে একটার পর একটা কাজ করে যাওয়া যায়! পেরেছিলেন তিনি। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হয়েও জীবন বহুবার তাঁর পরীক্ষা নিয়েছে। কখনও জিতেছেন, কখনও হয়তো মেনে নিতে হয়েছে অন্য পক্ষের কথা। তবু জমি ছাড়েননি সৌমিত্র।
আরও পড়ুন: অরিন্দম শীলের ছবিতে পরমব্রত
এ ছবির দুটি ভাগ। একটি সৌমিত্রের নিজের কথায় তাঁর জীবনের উপলব্ধি ও অনুভূতি, অন্যটি পুরোনো দিনের স্মৃতির দৃশ্য। যে সমস্ত ছবির দৃশ্য মনে দাগ কেটে যায় তার মধ্যে ‘অপুর সংসার’, ‘চারুলতা’ ও ‘অভিযান’ অন্যতম। ভালো লাগে ‘ঝিন্দের বন্দী’ ছবির দৃশ্যে উত্তমকুমার (প্রসেনজিৎ) ও সৌমিত্রের ডুয়েল। উত্তমের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, ঘনিষ্ঠতা ও পরবর্তীতে বিরোধ এবং তার ফলাফল, সবই খুব যত্নের সঙ্গে ও নিরপেক্ষভাবে দেখিয়েছেন পরমব্রত। ভালো লাগে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবির শ্যুটিংয়ে শর্মিলার (ত্রিধা) সঙ্গে সৌমিত্রের কথোপকথন। তবে ‘সোনার কেল্লা’ ছবিতে সৌমিত্রের ভূমিকা আরও একটু বেশি হতে পারত, যেহেতু এটি বাঙালির সর্বকালের অন্যতম প্রিয় ছবির তালিকায় পড়ে। ট্রেনযাত্রায় জটায়ুর (অভিজিৎ) সংলাপে বেশ কিছু ভুল কানে লাগে।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরদিন ছোট্ট সৌমিত্র ও তাঁর ভাইবোনদের বাবা-মায়ের সঙ্গে ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’ গানের দৃশ্য মন ছুঁয়ে যায়। সত্যজিতের মৃত্যুতে সৌমিত্রের ভেঙে পড়ার দৃশ্যে যিশুর অভিব্যক্তি মনে রাখার মতো।
আরও পড়ুন: বাইপোলার ডিসঅর্ডার থেকে চরম অবসাদ, হোমসে ‘ডুবে’ গিয়েছিলেন জেরেমি
অভিনয়ের ক্ষেত্রে যদিও প্রায় সকলেই যথাযথ তবু কয়েকজনের নাম আলাদাভাবে উল্লেখ করতেই হয়। অবশ্যই যিশুর অভিনয়জীবনের সবচেয়ে কঠিন চরিত্রের মধ্যে এটি অন্যতম। এর আগে উত্তমকুমারের চরিত্রেও যিশুকে অভিনয় করতে দেখা গেছে। এ ছবিতে সৌমিত্রের ভূমিকায় তিনি যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছেন, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
এছাড়া অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় রুদ্রনীলের কথা। রবি ঘোষের চরিত্রে তিনি অনবদ্য। প্রায় প্রতিটি ফ্রেমে তিনি মূল অভিনেতাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন। শরীরী ভাষায় মূল অভিনেতার এত কাছাকাছি আর কেউ যেতে পারত বলে মনে হয় না।
আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি
একইরকম চমক দিয়েছেন সুচিত্রা সেনের ভূমিকায় পাওলি। ‘সাত পাকে বাঁধা’র দৃশ্য দেখে বুঝতে সময় লাগে যে সেটি আসল ছবির দৃশ্য নয়। এমনকি সেই বিখ্যাত পাঞ্জাবি ছেঁড়ার দৃশ্য বা পার্টির দৃশ্যে মিসেস সেনের খামখেয়ালিপনার অভিনয়েও তিনি অনবদ্য।
ভালো লেগেছে ছবি বিশ্বাসরূপী দুলাল লাহিড়ীকে। দুজনের চেহারায় কোনও মিল না থাকলেও সেই অভাব কিছুটা মিটিয়ে দিয়েছে সোমনাথ কুন্ডুর মেকআপ। বাকিটা অভিজ্ঞ অভিনেতার মতোই উতরে দিয়েছেন দুলাল। যিশুর ‘অভিযান’ ছবির নরসিংয়ের মেকআপও যেন আসল সৌমিত্রকেই ফিরিয়ে দেয়। ভালো লেগেছে ছোট্ট দৃশ্যে জহর রায়রূপী বিশ্বনাথকে। দীপা চট্টোপাধ্যায়ের ভূমিকায় বাসবদত্তা সার্থক। সৌমিত্রকন্যা পৌলমীর ভূমিকায় সোহিনী অসামান্য। আর যার কথা উল্লেখ না করলেই নয়, তিনি কিউ। সত্যজিতের ভূমিকায় যথেষ্ট ভালো লেগেছে তাঁকে। সংযত অভিনয়ে কোথাও তাল কাটতে দেননি তিনি।
সবশেষে এই ছবির রিসার্চ ও চিত্রনাট্যর জন্য শুভেন্দু সেন, পদ্মনাভ দাশগুপ্ত ও পরমব্রতর ধন্যবাদ প্রাপ্য। চিত্রগ্রহণ প্রশংসার দাবি রাখে। আড়াই ঘণ্টা সময়টা যদিও আজকের দিনের ছবির পক্ষে হয়তো কিছুটা বেশি, তবু এত বড় মাপের একটা জীবনকে ফ্রেমে বাঁধতে গেলে একটু সময় তো দিতেই হতো। সবথেকে বড় কথা কিংবদন্তি অভিনেতার জীবনের উপর এই ডকুমেন্টেশনের প্রয়োজন ছিল। মানুষ এবং অভিনেতা সৌমিত্রকে জানতে হলে এ ছবি দেখতেই হবে।