সাবাশ জিতু! ধন্যবাদ অনীক

ছবি: অপরাজিত

পরিচালনা: অনীক দত্ত

অভিনয়ে: জিতু কামাল, সায়নী ঘোষ, দেবাশিষ রায়, মহুল ব্রহ্ম, অনুষা বিশ্বনাথন, অনসূয়া মজুমদার, অঞ্জনা বসু, বরুণ চন্দ, মানসী সিংহ, পরান বন্দ্যোপাধ্যায়, ঋষভ বসু, আয়ুশ

দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ১৮ মিনিট

RBN রেটিং: ৪/৫

‘সোনার কেল্লা’য় উটের পিঠে চড়ার দৃশ্যে লালমোহনবাবুর উদ্দেশ্যে ফেলুদা প্রশ্ন করেছিল, ‘আপনার স্বপ্ন এখন কী বলছে?’ উত্তরে লালমোহনবাবু বলেছিলেন, ‘ঘোর বাস্তব।’ অনীক দত্তের ‘অপরাজিত’ ঠিক যেন এক বাস্তব স্বপ্ন। যে স্বপ্ন ১৯৫২ সালে দেখা শুরু করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। ভেবেছিলেন এমন একটি ছবি তৈরি করবেন যা বদলে দেবে বিশ্ব চলচ্চিত্রের ভাষা। সেই স্বপ্নকে ঘোর বাস্তবে রূপান্তরিত করতে তাঁকে প্রচুর কাঠখড় পোড়াতে হয়। কিন্তু কোনও বাধাই ‘ওরিয়েন্ট লংম্যান’কে আটকাতে পারেনি। ১৯৫৫ সালে মুক্তি পায় সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একই নামের উপন্যাসের প্ৰথম অংশ নিয়ে নির্মিত সেই ছবির নেপথ্যে থাকা কাহিনীগুলোকেই অনীক সাজিয়েছেন তাঁর ‘অপরাজিত’তে।



অনীকের চোখে সত্যজিৎ এখানে অপরাজিত। সত্যিই তিনি সার্থকনামা। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র গবেষক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখোমুখি বসে আকাশবাণীতে দেওয়া তাঁর সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে শুরু হয় ছবি। শান্তিনিকেতনের পাঠ শেষ করে অপরাজিত রায় (সত্যজিৎ) যোগ দেন এক বিজ্ঞাপন সংস্থায়। পাশ্চাত্য সিনেমা ও সঙ্গীতপ্রেমী অপরাজিত ততদিনে বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে তৈরি করে ফেলেছেন ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি। বহু বিদেশী ছবি দেখতে এবং দেখাতে থাকলেন সেখানে, নিজে শিখলেনও। কোনওদিন ছবি পরিচালনা করলে সেটা যে বিদেশী ছবির অনুপ্রেরণায় তৈরি হবে এমনই বিশ্বাস ছিল তাঁর।

এরই মধ্যে অফিসে এক সহকর্মীর উৎসাহে অপরাজিত এঁকে ফেলেন বিভূতিবরণ মুখোপাধ্যায়ের (বিভূতিভূষণ) ‘পথের পদাবলী’ (‘পথের পাঁচালী’) উপন্যাসের প্রথম অংশ ‘তালপাতার বাঁশি’ (‘আম আঁটির ভেঁপু’) বইটির প্রচ্ছদ। সেই প্রথম বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য রত্নের খোঁজ পেলেন অপরাজিত রায় ওরফে অপু (মানিক)। বারংবার বইটি পড়ে নিজের মতো করেই লিখে ফেললেন চিত্রনাট্য। কর্মসূত্রে লন্ডনে গিয়ে সেখানে ‘দ্য বাইসাইকেল রাইড’ (‘বাইসাইকেল থিভস’) ছবিটি দেখে উপলব্ধি করলেন, এমন ছবিই তো তিনি বানাতে চান। দেশে ফেরার পথে জাহাজেই শেষ করলেন চিত্রনাট্য লেখার কাজ। কাজে লাগালেন লন্ডন থেকে শিখে আসা স্টোরিবোর্ডের প্রশিক্ষণ। নাহ, কোনও বিদেশি গল্প নয়, তাঁর প্রথম পরিচালিত ছবি হবে ‘পথের পদাবলী’ (‘পথের পাঁচালী’।

আরও পড়ুন: নেপথ্যে গাইলেন জলি, স্টেজে দাঁড়িয়ে ঠোঁট মেলালেন রাহুল দেব বর্মণ

দেশে ফিরে বন্ধু সুবীর মিত্র (সুব্রত মিত্র), চন্দ্রগুপ্ত কিচলু (বংশী চন্দ্রগুপ্ত) ও আরও কয়েকজনকে নিয়ে নেমে পড়লেন পরিচালনার কাজে। কিন্তু পথের কাঁটা অর্থ। একাধিক প্রযোজকের সঙ্গে দেখা করে কোনও লাভ হলো না। তৎকালীন গাননির্ভর রোমান্টিক ছবির দর্শকদের সামনে এই আধাতথ্যচিত্র ধরণের ছবি চলবে না, এমন কথাই শুনতে হলো। ছবিতে কয়েকটি গান এবং নায়ক-নায়িকাকে যুক্ত করলে টাকা ঢালতে রাজি আছেন, বলেন কতিপয় প্রযোজক।

অবশেষে পাশে এসে দাঁড়ালেন স্ত্রী বিমলা রায় (বিজয়া রায়)। বিয়ের সমস্ত গয়না বন্ধক দিয়ে ছবি শুরু করার টাকা তুলে দিলেন স্বামীর হাতে। আসল লোকেশন খুঁজে বের করা এবং প্রাকৃতিক সময়কে কাজে লাগিয়ে শ্যুটিং করতে গিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়তে হয় পরিচালককে। অর্থের অভাবে বারবার বন্ধ হয়ে যেত শ্যুটিং। শেষে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিমান রায়ের (বিধান রায়) সাহায্যে, সরকারী অর্থানুকূল্যে শেষ হল ছবির কাজ। এরপর একাধিক বিশ্ব চলচ্চিত্র উৎসবে সাধুবাদ পাওয়ার গল্প প্রায় সকলেরই জানা। তবু যা জানা নয়, সেটাই দেখালেন অনীক।

নামভূমিকায় জিতু অনবদ্য। ট্রেলার দেখে আংশিক আভাস পাওয়া গেলেও ছবির পর্দায় জিতুকে দেখে তাক লেগে যায়। সত্যজিতের শরীরী ভাষা রন্ধ্রে-রন্ধ্রে আয়ত্ত করেছেন তিনি। হাত নাড়ানো, হাঁটাচলা, রুমালের কোন চিবানো, ক্যামেরার লেন্সে তাকানো, আরাম কেদারায় আধশোয়া এ কে? অপরাজিত নাকি সত্যজিৎ? একজন মানুষের পুঙ্খানুপুঙ্খ ম্যানারিজ়মকে রপ্ত করে তুলতে কী পরিমাণ একাগ্রতা দরকার, দেখিয়ে দিলেন জিতু। তবে ১০০ ভাগ সত্যজিৎ হয়ে ওঠার পিছনে অর্ধেক অবদান জিতুর হলে, বাকিটা চন্দ্রাশিস রায়ের। এরকম ব্যারিটোন কণ্ঠস্বর ছাড়া কি সত্যজিৎ মানায়!

আরও পড়ুন: গার্হস্থ্য হিংসার শিকার, তবুও ঔজ্জ্বল্যে অম্লান

সত্যজিৎ নিজে বলেছিলেন দ্বিতীয় ইন্দির ঠাকুরণ তিনি আর পাবেন না। পাননি অনীকও। আর এখানেই আবারও চমকে দিলেন তিনি। এক পুরুষ অভিনেতাকে (হরবাবু) সোমনাথ কুন্ডুর মেকআপের সাহায্যে বানিয়ে ফেললেন অবিকল সত্যজিতের ইন্দির ঠাকুরণ (ছবিতে ইন্দিরা)। 

অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বিমলার চরিত্রে পরিমিত অভিনয় করেছেন সায়নী। গোটা ছবি জুড়ে অপরাজিত ও বিমলার রসায়ন দেখতে ভালো লাগে। 

সূর্য শঙ্করের (রবিশঙ্কর) ভূমিকায় ঋষভকে ভীষণ ভালো মানিয়েছে। জওহরলাল নেহরুর চরিত্রে বরুণ চন্দের কন্ঠস্বর না শোনা পর্যন্ত বোঝা মুশকিল ছিল ইনি আসল নেহরু নন। তবে বিমান রায়ের ভূমিকায় পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অহেতুক কৌতুক একটু চোখে লাগল। চোখে লাগে এক জায়গায় বিভূতিবরণ এবং বিভূতিভূষণের নামের বানানে ত্রুটি।

আরও পড়ুন: শেষ যাত্রায় ব্রাত্য, পথ হেঁটেছিলেন মাত্র কয়েকজন

সুপ্রতিম ভোলের চিত্রগ্রহণ, অর্ঘ্যকমল মিত্রের সম্পাদনা এবং সর্বোপরি দেবজ্যোতি মিশ্রের আবহসৃজন, তাঁদের কর্মজীবনের অন্যতম সেরা কাজ হয়ে থাকবে। স্থিরচিত্রে সুব্রত মিত্রের নৈপূণ্য দেখে সত্যজিৎ তাঁর হাতে মিচেল তুলে দিয়েছিলেন। সেই প্রথম মুভি ক্যামেরায় হাত দিয়েছিলেন সুব্রত। পরবর্তীকালে বিশ্ব চলচ্চিত্রে বহুল ব্যবহৃত বাউন্স লাইটিংয়ের প্রবক্তাও তিনি, সত্যজিতের একাধিক ছবিতে যার মোলায়েম উপস্থিতি এক অদ্ভুত মুগ্ধতা তৈরি করে। ‘অপরাজিত’তে সুবীররূপী সুব্রতর ভূমিকায় দেবাশিস অনবদ্য।

ধন্যবাদ অনীক। সত্যজিতের প্রতি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন হয়েছে দেশে-বিদেশে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা ‘নায়ক’, ফেলুদা এবং গুপি-বাঘার কাজ নিয়েই সীমাবদ্ধ। সত্যজিৎ হয়ে ওঠার এই কাহিনীকে তথ্যচিত্রের পরিবর্তে গল্প হিসেবে বলা সত্যিই অভিনবত্বের দাবি রাখে। ‘অপরাজিত’ যেহেতু ‘পথের পদাবলী’ (‘পথের পাঁচালী’) তৈরীর নেপথ্য কাহিনী, তাই মূল ছবির বেশ কয়েকটি দৃশ্যের সুনিপুণ বিনির্মাণ করেছেন অনীক। মানিক ও উমার (অপু-দুর্গা) প্রথম রেললাইন দেখা, বৃষ্টিতে ভেজার মতো দৃশ্যগুলি পুরোনো-নতুনের তফাৎ ভুলিয়ে দেয়। এ জন্য প্রশংসার দাবিদার উমা ও মানিকের ভূমিকায় অনুষা ও আয়ুশ। চিনিবাস ময়রার পিছন-পিছন উমা-মানিকের যাওয়ার সময় পুকুরের জলে প্রতিবিম্বের দৃশ্যে করতালিতে ফেটে পড়ে প্রেক্ষাগৃহ। সর্বমঙ্গলার (সর্বজয়া) চরিত্রে অঞ্জনাকে বেশ ভালো লাগল।

আরও পড়ুন: বাইপোলার ডিসঅর্ডার থেকে চরম অবসাদ, হোমসে ‘ডুবে’ গিয়েছিলেন জেরেমি

বেশ কিছু দৃশ্যে হালকা সত্যজিতের ছোঁওয়া ভালো লাগে। সত্যজিতের পথ অনুসরণ করেই এ ছবিতে ননীবালা দেবীর (চুনিবালা) ভয়েসওভার করেছেন অনীক। যেমনটা সত্যজিৎ নিজে করেছিলেন তাঁর বেশ কিছু ছবিতে। পুনরাবৃত্তি ঘটল আরেক ইতিহাসেরও। কলকাতা দূরদর্শনের পক্ষ থেকে সত্যজিতের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন শমীক। অনীকের অপরাজিতর সাক্ষাৎকারেও ফিরে এলেন তিনি।

অত্যন্ত পরিমেয়, মার্জিত, মেদহীন এক চিত্রনাট্য লিখেছেন অনীক। এক ইতিহাস তৈরির পিছনের ইতিহাসের সাক্ষী হতে এই ছবি দেখা আবশ্যক।




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
11

Gargi

Travel freak, nature addict, music lover, and a dancer by passion. Crazy about wildlife when not hunting stories. Elocution and acting are my second calling. Hungry or not, always an over-zealous foodie

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *