পরিচালকের সততা আশা জাগায়
ছবি: কারণ গ্রিস আমাদের দেশ না অথবা ব্লু ব্ল্যাক ও ট্রান্সপারেন্ট হোয়াইট
পরিচালনা: সুদীপ্ত লাহা
অভিনয়ে: অনিন্দ্য সেনগুপ্ত, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, তনুশ্রী চক্রবর্তী, গৌরব চট্টোপাধ্যায়, রাজেশ্বরী পাল, কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়, পার্থ সারথি
দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৫৮ মিনিট
RBN রেটিং ★★★★★★☆☆☆☆
‘আর্ট ফর আর্টস সেক’, বিখ্যাত এক ফরাসি স্লোগান, যা বলে প্রকৃত অর্থে শিল্প শুধুমাত্র তার নিজের কারণেই স্বয়ংসম্পূর্ণ। কোনওরকম বাহ্যিক কারণ, তা সে সামাজিক, নৈতিক, শিক্ষাগত বা রাজনৈতিক যাই হোক না কেন, কোনওকিছুর ওপরেই শিল্প নির্ভরশীল নয়। অর্থাৎ শিল্পকে শুধুমাত্র শিল্পীর ভাব প্রকাশের মাধ্যম, সৌন্দর্যবোধ কিংবা কল্পনাশক্তির বিন্যাস হিসেবেই দেখা উচিত, বাস্তব দুনিয়ায় তার উপযোগিতা সেই শিল্পের মান নির্ণয় করে না। অনেকটা এই সুরেই বাঁধা রয়েছে সুদীপ্তর প্রথম ছবি।
অভিনব নামকরণ এই ছবির প্রতি আকর্ষণের অন্যতম কারণ হয়ে উঠতে পারে যে কোনও সিরিয়াস ছবির দর্শকের কাছে। প্রথমেই প্রশ্ন জাগবে, গ্রিস আমাদের দেশ না কেন বলা হচ্ছে, তার মানে গ্রিস কি এই ছবির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ, নাকি শুধুই গিমিক? এই প্রশ্নে আসার আগে ছোট্ট করে ছবির প্রেক্ষাপট বলে দেওয়া যাক।
সুদীপ্ত (অনিন্দ্য) একজন ফিল্ম পরিচালক। সে একটু অন্য ধরনের ছবি বানাতে চাইলেও প্রযোজক পায় না। ফলে একটি বাজারচলতি থ্রিলার ছবি পরিচালনার কাজে সে আপাতত নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে। তার বর্তমান ছবির শুট চলছে তারই দিদি মুনার (তনুশ্রী) বাড়িতে। সেখানে থাকেন দিদির এক আত্মীয় দুর্গাবাবু (কমলেশ্বর)। তিনি এক নীরব চিত্রশিল্পী। কোনওরকম প্রচার ছাড়াই নিজের খুশিতে একের পর এক ক্যানভাস ভরিয়ে চলেন তিনি। সুদীপ্ত বুঝতে পারে না নিজের শিল্পের প্রদর্শন না করেও কীভাবে একজন শিল্পী এত নিশ্চিন্ত থাকতে পারে।
এই ছবির মূল বক্তব্য দুর্গাবাবুর চরিত্রের দর্শন যা সক্রেটিক প্যারাডক্সের কথা বলে। অর্থাৎ শুরুতেই স্বীকার করা ‘I know that I know nothing’। অর্থাৎ আমি জানি যে আমি কিছুই জানি না। যে সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা মনে করি কোনও শিল্পের সার্থকতা শুধুমাত্র অন্যের ভ্যালিডেশন বা বৈধতার বিচারের ওপর নির্ভর করে, সেই জায়গাতেই সক্রেটিসের প্রাচীন মতকে বিশ্বাস করে ধরে রাখা খুব সহজ কাজ নয়। অথচ এই চরিত্রটি সেটাই করছে দিনের পর দিন। লোকে তাকে পাগল বলছে, ব্যঙ্গ করছে, অথচ সে তার বিশ্বাস থেকে নড়ছে না। ছবির শেষ পর্যন্ত দেখলে এই জেদের জিতও কোথাও যেন দর্শককে স্বস্তি দেয় যে অন্তত একজন শিল্পী নিজের জায়গায় অনড় থেকে গেলেন ভেবে।
ছবির চিত্রনাট্যে বেশ কিছু দুর্বলতা রয়েছে। কাটবিহীন লম্বা-লম্বা শট কিছু জায়গায় চোখের জন্য ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে। কথোপকথনের মধ্যেও স্বাভাবিকতার অভাব এবং অপ্রয়োজনীয় প্রচুর মুহূর্ত রয়েছে যেগুলো বাদ দিলে ছবিটি আরও গোছানো হতে পারত। তবে সুদীপ্তর প্রথম ছবি হিসেবে বিষয় ভাবনা প্রশংসাযোগ্য। এই সময়ে দাঁড়িয়ে চেনা ছকের বাইরে কিছু ভাবতে পারা যথেষ্ট সাহসের পরিচয় দেয়।
আরও পড়ুন: সৌরভের বায়োপিকে তৃতীয়বার অভিনেতা বদল
কমলেশ্বরের বয়ানে বেশ কিছু সংলাপ শুনতে ভালো লাগে, কারণ কোথাও তাঁর দার্শনিক তত্ত্বের কথা জ্ঞানের মতো শোনায় না। গভীর কোনও কথা হালকাভাবে বলার পরেই যখন সেই চরিত্রটি ছেলেমানুষী করে লজেন্সের খোঁজ করে, অদ্ভুত এক বৈপরীত্য চরিত্রটিকে অনন্য করে তোলে। ছবিতে দীর্ঘ কথোপকথন রয়েছে, যা হয়তো কিছুটা ক্লান্তিকর লাগবে। তবে আবার একইসঙ্গে কিছু জায়গায় অনেকটা কথার পরে একটা সম্পূর্ণ বিপরীত সংলাপে যে ছোট-ছোট কমিক রিলিফ দেওয়া হয়েছে সেটা দেখতে মন্দ লাগে না।
পরিচালক ছবিটিকে আবহ সঙ্গীতহীন রেখেছেন কারণ তিনি বিশ্বাস করেন বাইরে থেকে কোনও প্রভাব বিস্তার করে দর্শকের মনকে প্রভাবিত করা উচিত নয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে নীরবতার একটা বিশেষ ভূমিকা ছবিতে থাকা উচিত ছিল। প্রথম অর্ধে প্রায় বিশেষ কিছুই ঘটে না, ফলে সাধারণ দর্শক কিছুটা হতাশ হবেন। কিন্তু সুদীপ্তর ছবিতে আগাগোড়া যা রয়েছে তা হলো সততা। ছবির ট্রেলার দেখলে বোঝা যায় এই ছবি অন্যরকম, অন্য কথা বলে। অ্যান্টিকালার থিওরি দিয়ে যেভাবে অন্ধকারকে বোঝানো হয়েছে তার প্রতিচ্ছবি রয়েছে গোটা ছবি জুড়েই।
হয়তো পরিচালক যে বিষয়কে ছবিতে ধরতে চেয়েছেন তার সমস্ত স্তরকে ঠিকঠাক বিশ্লেষণ করা যায়নি। কিন্তু সেটা প্রথম ছবিতেই খুব মুন্সিয়ানার সঙ্গে হবে এমনটা আশা করাও যায় না। ছবির নির্মাণে ত্রুটি থাকলেও পরিচালকের ভাবনা ও প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। প্রথম পরিচালনা বলেই হয়তো আগাগোড়া ছবির নির্মাণে তাঁর স্বতঃস্ফূর্ততা লক্ষ্যণীয়।
অভিনেতারা প্রত্যেকেই আশানুরূপ অভিনয় করেছেন। যেমনটা দরকার ছিল তেমন। তার মধ্যে অত্যন্ত উজ্জ্বল কমলেশ্বর এবং অনিন্দ্য। সুদীপ্ত চরিত্রের অস্থিরতা অনিন্দ্য বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরেছেন। দুর্গাবাবুর চরিত্রের সারল্য এবং গভীরতা দুইই কমলেশ্বরের মধ্যে দিয়ে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। বিভ্রান্তিহীন এই চরিত্র অনেকটা মুক্ত হাওয়ার মতো যা নিজের বিশ্বাসের কথা সহজভাবে বলতে পারে। এরকম মানুষ বর্তমান সময়ে ক্রমেই কমে আসছে।
বিষয় ভাবনার দিক থেকে অভিনব হলেও গতি এবং অন্যধারার নির্মাণের কারণে ছবিটি দর্শক টানতে কতটা সক্ষম হবে সে নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তবে সময় এবং সুযোগ পেলে পরিচালকের ছবির ধার আরও বাড়বে আশা করা যায়।