পরাবাস্তবতার নিষ্ঠুর উপহাস

ছবি: ঝরা পালক

পরিচালনা: শায়ন্তন মুখোপাধ্যায়

অভিনয়ে: ব্রাত্য বসু, রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়া আহসান, দেবশঙ্কর হালদার, কৌশিক সেন, পদ্মনাভ দাশগুপ্ত, বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবদূত ঘোষ, শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়, সোমা চক্রবর্তী, তনিকা বসু, পবন কানোড়িয়া

দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৩২ মিনিট

RBN রেটিং: ৩.৫/৫

‘ভালোবাসিয়াছি আমি অস্তচাঁদ, ক্লান্ত শেষপ্রহরের শশী!
অঘোর ঘুমের ঘোরে ঢলে যবে কালো নদী-ঢেউয়ের কলসী,
নিঝ্ঝুম বিছানার পরে
মেঘবৌ’র খোঁপাখসা জোছনাফুল চুপে চুপে ঝরে,
চেয়ে থাকি চোখ তুলে’-যেন মোর পলাতকা প্রিয়া
মেঘের ঘোমটা তুলে’ প্রেত-চাঁদে সচকিতে ওঠে শিহরিয়া!’ 

আজন্ম প্রচারবিমুখ, স্বভাব-একাকী ও নির্জনতাপ্রেমী কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে ছবি করার ভাবনা এই প্রথম। বাংলা ছবির এত বছরের ইতিহাসে কবি–সাহিত্যিকদের প্রভাব থাকলেও জীবনানন্দকে নিয়ে বা তাঁর দর্শনের ওপর ভিত্তি করে কোনও ছবি করার দুঃসাহস আজ অবধি কোনও পরিচালক দেখাননি। সেটাই করে দেখালেন শায়ন্তন। দুঃসাহস বলা এই কারণে, জীবনানন্দের ব্যাক্তিগত জীবন সে যুগের আর পাঁচটা নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালির মতো হয়েও অসাধারণ। সেই অসাধারণত্ব উঠে এসেছে তাঁর সেই সময়ের রচনায়, আর তা জীবনযাত্রাকে নির্ভর করেই এবং কোনও আড়াল না রেখে। আগাগোড়াই তাঁর সমস্ত লেখায় পরাবাস্তবতা বা সুরিয়ালিজ়মের প্রভাব ছিল অপরিসীম। বলা ভালো এটিই ছিল তাঁর নিজস্ব ধারা। অথচ সেই সময়ের নিরিখে সে লেখাকে বোঝার বা মূল্যায়ন করার মতো মানুষ গোটা বাংলায় খুব একটা পাওয়া যায়নি। যথার্থভাবেই ছবিতে কমলকুমার মজুমদারের ভূমিকায় দেবদূতের উক্তি মনে থেকে যায়, সময়ের আগে জন্মালে এমনই হয়ে থাকে বোধহয়।



বিভিন্ন সময় ও ভাবনার ভিত্তিতে নানা কালার টোনে গল্পের মুহূর্তগুলিকে বন্দী করেছেন শায়ন্তন। হ্যাঁ, মুহূর্ত বলাই ভালো। এ ছবির গল্পের অংশরা ওই মুহূর্তের হাত ধরে টুকরো কোলাজ হয়ে ছুঁয়ে যায় দর্শককে। আবার কখনও নাড়িয়ে দিয়ে যায় ভেতরের কোথাও একটা। জীবনানন্দের ব্যক্তি জীবনের নানা ঘটনা ছিন্ন পাতার মতো উড়ে আসে ছবির এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। প্রেক্ষাপটে রয়েছে সুরঞ্জনা। নায়িকা সুরঞ্জনা। যাকে একলা ঘরে বসে খুঁজে বেড়ায় সোমেন পালিত, হয়তো সে মনে-মনে আওড়ায় ‘ফিরে এসো সুরঞ্জনা, নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে’। তারপর একদিন অবসাদে নিজেকে শেষ করে দেয়। কিন্তু সুরঞ্জনা ফেরে না। থাকে শুধু অন্ধকার। 

আরও পড়ুন: বেহিসেবী জীবনযাপন, আজ স্মৃতির অতলে সৌমিত্র

ব্রাত্য এ ছবিতে দ্বৈত চরিত্রে রয়েছেন। জীবনানন্দের পরিণত বয়সের চরিত্র ছাড়াও তাঁকে দেখা যায় শিল্পী সোমেনের ভূমিকায়, যে চরিত্রের ভাঙাগড়া অনেকটা কবির মতোই নিদারুণ কিন্তু অস্পষ্ট। জীবনানন্দের কমবয়সী চরিত্রে অভিনয় করেছেন রাহুল। দুজনেই কোথাও যেন নিজেদের ছাপিয়ে গিয়েছেন। মিশে গিয়েছেন কবির রূপকল্পে। কবির স্ত্রী লাবণ্যপ্রভার চরিত্রে রয়েছেন জয়া। তিনি রয়েছেন সুরঞ্জনা ও কবির অন্যান্য বহু নায়িকার ইমেজারি রূপেও।

নিষ্ঠুর উপহাস

এছাড়াও সমালোচক সজনীকান্ত দাস (দেবশঙ্কর), লেখক বুদ্ধদেব বসু (কৌশিক), প্রেমেন্দ্র মিত্র (বিপ্লব), কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (পদ্মনাভ), বাবা সত্যানন্দ দাশগুপ্ত, (শান্তিলাল), সিগনেট প্রেসের দিলীপ কুমার গুপ্ত (পবন) ও কবির সম্পর্কিত বোন শোভনার (তনিকা) চরিত্রেরা এসেছে বিভিন্ন দৃশ্যে।

সজনীকান্ত ও সমসাময়িক লেখক কবিদের কড়া সমালোচনা জীবনানন্দকে যেভাবে বিদ্ধ করেছিল সেই যন্ত্রণা ফুটে ওঠে কবির হতাশাগ্রস্ত চোখে, কিংবা নিস্ফল আক্রোশে, অথবা হঠাৎ আসা ট্রামের শব্দে। ট্রাম এই ছবিতে খুব নিষ্ঠুরভাবে প্রতিবার কী যেন পিষে দিয়ে যায়। হয়তো তা কবির অন্তরাত্মা, কিংবা কবিতার স্বপ্ন। সারা পৃথিবীর ওপর কোনও অজানা অভিমানে নাকি আক্রোশে রাশি-রাশি লেখা লিখেও জীবনানন্দ তাকে ট্রাঙ্কবন্দী করে রেখেছিলেন, আজকের এই আত্মপ্রচারের যুগে তার কারণ খোঁজা হয়তো খানিক অবান্তরই। সময়ের আগে জন্মানোর যন্ত্রণাই হয়তো ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়ে ফেলেছিল তাঁর সৃষ্টিশীল সত্ত্বাকে। স্ত্রীর সঙ্গে বনিনবনার অভাব ও কঠিন দারিদ্র্যও অন্তরে ক্ষতবিক্ষত করেছে তাঁকে। অথচ লাবণ্য তাঁর সাধ্যমতো উৎসাহ যুগিয়েছেন কবিকে। সমসাময়িকের দরবারে কোনওদিনই আদৃত হয়ে উঠতে পারলেন না কবি, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক জীবনানন্দ। তাঁর লেখায় উঠে আসা রক্তমাংসের গন্ধ, সামাজিক অবক্ষয়, মানসিক ভাঙন, নিঃসঙ্গতা ও যৌনতার বাস্তববোধ সে যুগের পাঠককে স্পর্শ করতে পারল না। অথচ মৃত্যুর পর তিনিই হলেন বাঙালির প্রাণের কবি, বাংলার শ্রেষ্ঠ মৌলিক কবি। এ এক অদ্ভুত ট্র্যাজেডি! হয়তো কবির লেখনীর মতই জীবনের এক পরাবাস্তব রূপ। 

আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি

বলা বাহুল্য, পরাবাস্তবতার এই নিষ্ঠুর উপহাস সব ধরণের দর্শকের জন্য নয়। কারণ শুধু দেখার নয়, ‘ঝরা পালক’ অনুভব করার, চিন্তা করার ও চমকে ওঠার মতো ছবি। শায়ন্তন এ ছবি নির্মাণ করে যে সাহস দেখিয়েছেন তাতে ঘি ঢেলেছেন প্রায় সমস্ত অভিনেতারাই। সকলেই তাঁদের ভূমিকায় সুবিচার করেছেন। মনে থেকে যাবে ছবির চিত্রগ্রহণ, চিত্রনাট্য, বিভিন্ন দৃশ্যপটের কোলাজ এবং অবশ্যই শব্দ। এভাবেও গল্প গড়ে তোলা যায়, দেখালেন পরিচালক। আগুনের মতো প্রতিভা নিয়েও জ্বলে না উঠতে পারার আক্রোশ কীভাবে জ্বালিয়ে দিল একজন সৃষ্টিশীল মানুষকে, এই দেখনদারির যুগে দাঁড়িয়ে তাকে আত্মস্থ করা সহজ কাজ নয়।




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *