যোগ্যতম হয়ে ওঠার শর্তে বেঁচে থাকার ভয়াবহ লড়াই

ছবি: জ়ম্বিস্তান

পরিচালনা: অভিরূপ ঘোষ

অভিনয়ে: তনুশ্রী চক্রবর্তী, রুদ্রনীল ঘোষ, রজতাভ দত্ত

দৈর্ঘ্য: ১ ঘন্টা ৩৪ মিনিট

RBN রেটিং: ৩/৫

যদি এমন হয় একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনি আবিষ্কার করলেন কোনও এক অজানা দুর্ঘটনার কবলে পড়ে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ মৃত কিংবা ব্যাধিগ্রস্ত আর আপনি একা সুস্থ ও সজাগ রয়েছেন? বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখলেন একটা গোটা জনপদের কেউ কোত্থাও নেই, শুধু আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ওত পেতে রয়েছে কিছু প্রেত। তারা আধামানুষ, আধাদানব। তারা সুযোগ খুঁজছে কীভাবে আপনার মতো সুস্থ জলজ্যান্ত একটা মানুষকে সামনে পেলে ছিঁড়ে খাবে। হতেই তো পারে এমন। ভেবেছেন কখনও এমন এক ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের কথা? হয়তো না। ভেবেছেন পরিচালক অভিরূপ ঘোষ তাঁর ‘জ়ম্বিস্তান’ ছবির মধ্যে দিয়ে।  




ছবির প্রথম দৃশ্যই এক অচেনা পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় দর্শককে, যেখানে আকিরা (তনুশ্রী) তার বাঁচার রসদ সংগ্রহ করতে কোনও এক রান্নাঘরে হানা দেয়। বোঝা যায় এভাবেই তাকে খাবার জোগাড় করতে হয় ইদানিং। কিন্তু আচমকাই প্রেত বা জ়ম্বিদের মুখোমুখি হতে হয় তাকে। তবে ঘাবড়ায় না আকিরা। অস্ত্র রয়েছে তার সঙ্গে। মূর্তিমান মৃত্যুর সঙ্গে বেঁচে থাকার ভয়াবহ লড়াইয়ে আকিরা অভ্যস্ত। এভাবেই তো বাঁচতে হবে তাকে। সুদূর বেঙ্গালুরু থেকে গাড়ি চালিয়ে পুরুলিয়া এসেছে সে সরকারি কিংবা সামরিক সেফ জ়োনের খোঁজে। পথে শেষ করেছে অজস্র জ়ম্বিকে। তাই এত সহজে হার মানবে না আকিরা।

গল্পের সময়কাল ২০৩০। মে মাসের ১৩ তারিখে হঠাৎই এক বায়োকেমিক্যাল বিস্ফোরণে ভয়ঙ্কর রশ্মির প্রতিক্রিয়ায় প্রায় সারা পৃথিবীর মানুষ জ়ম্বিতে পরিণত হয়। দিব্যি হেঁটেচলে বেড়ানো সুস্থ সবল মানুষ রশ্মির সংস্পর্শে আসার কয়েক মিনিটের মধ্যে বাহ্যিক জ্ঞানশূন্য ক্ষুধার্ত দানবে পরিণত হতে থাকে। বেঁচে যায় তারা, যারা বাড়ির ভেতরে ছিল। কিন্তু চারপাশে এত বুভুক্ষু প্রেতের আক্রমণে তারাই বা বাঁচবে কীভাবে? জ়ম্বিদের রক্ত বা লালার সংস্পর্শে আসার চার মিনিটের মধ্যে যে কোনও মানুষ জ়ম্বিতে পরিণত হবে। এই ধ্বংসলীলা ততদিন পর্যন্ত চলবে যতদিন না খাদ্যশূন্য হয়ে জ়ম্বিরা শেষ হয়ে যায়। আশার কথা এই যে এরা অমর নয় এবং সঠিক আঘাতে এদের মৃত্যু সম্ভব। 

আরও পড়ুন: নিজের বায়োপিকে থাকছেন না সৌমিত্র

আকিরার যাত্রাপথে সে মুখোমুখি হয় নানা ঘটনার, বেশ কিছু হিংস্র জ়ম্বির ও সমস্ত রকম প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে তখনও টিকে থাকা কয়েকজন মানুষের। আলাপ হয় মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে জুয়া খেলে যাওয়া অনিল চ্যাটার্জীর (রুদ্রনীল) সঙ্গে। দেখা মেলে ক্ষমতার জোরে চরম অরাজকতার বাতাবরণে রাজত্ব টিকিয়ে রাখা হরিদাসনগরের রাজা হরিদাস পালের (রজতাভ)। তিনি নরমাংসলোভী জ়ম্বি পোষেন, তাদের কুকুরের মত চেন দিয়ে বেঁধে রাখেন, আবার বেটোফেন শুনতে শুনতে চরম নিষ্ঠুরতার নানা নিদর্শন দিয়ে থাকেন। উঠে আসে নানা অপ্রীতিকর প্রসঙ্গ। ক্যানিবলিজ়ম, হারেম প্রথা, যৌনদাসীর প্রসঙ্গ মনে করিয়ে দেয় মানুষের আদিম ইতিহাসের কথা। সভ্যতার প্রথম সূত্র উঠে আসে বিনিময় প্রথার অব্যর্থ ব্যবহারে। নরখাদকদের থেকে বাঁচতে প্রয়োজন আগ্নেয়াস্ত্রের। তাই সেই আগ্নেয়াস্ত্রের যোগান পেতে বিনিময়ে দিতে হতে পারে যা খুশি। গাছের আম থেকে গ্যাস সিলিন্ডার, দামি মদ, পুরোনো রেকর্ড থেকে জলজ্যান্ত একটি মেয়ে, সবই বিনিময়যোগ্য।

আবার এই প্রথার উদাহরণস্বরূপ দেখা যায় বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের এক করুণ অথচ হাস্যকর রূপ, যেখানে একটি মেয়ের জীবনের চেয়ে দামী একটি গরু। কারণ গরু হলো মায়ের সমান। আর কে না জানে গরুর মূত্রে আজকাল ক্যানসারও সেরে যায়! সভ্যতার শেষভাগে প্রাথমিক কিছু ব্যবস্থা করে কয়েকটা মানুষ দলগত হয়ে বাঁচতে চাইছে, তবু ধর্মভাব তাদের আচ্ছন্ন করে রাখে, বর্তমান পরিস্থিতির বিচারে পরিচালকের দৃষ্টিভঙ্গি প্রশংসনীয়।

আরও পড়ুন: প্রকাশিত হলো পূর্ণাঙ্গ ‘শ্যামা’র অ্যালবাম

একঘেয়ে থ্রিলার ও সম্পর্কের কাহিনীর ভিড়ে ‘জ়ম্বিস্তান’ এক অন্যরকম স্বাদবদল। যেন ভাতের বদলে লুচি খাওয়া নয়, বরং চেনা খাবারের বদলে এক সম্পূর্ণ বিজাতীয় খাদ্যের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া। কল্পকথা হলেও মানব সভ্যতার ভয়ঙ্কর পরিণতি দর্শককে ভাবতে বাধ্য করবে, এই লাগামহীন ছুটে চলার শেষ কোথায়?

ত্রুটি আছে। সব ছবিতেই কমবেশি থাকে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা বিষয় নির্বাচন। বাঙালি দর্শককে চেনা ছবির ভিড়ের থেকে বার করে নিয়ে এসে এক অন্য দুনিয়ার সঙ্গে পরিচয় করানোর সাহস দেখানো চাট্টিখানি কথা নয়, যেখানে নামী দামী পরিচালকরাও বাঁধা গতের থেকে বেরোতে পারেন না। জ়ম্বি নিয়ে বিদেশে, বিশেষ করে হলিউডে প্রচুর কাজ হলেও এই প্রেক্ষাপটের সঙ্গে বাংলা ছবির পরিচয় এই প্রথম। বাংলা ছবিতে এক নতুন জঁরকে নিয়ে আসার জন্য অভিরূপের সাধুবাদ প্রাপ্য।

আরও পড়ুন: মুক্তি পেল ‘ব্যাড ট্রিপ’-এর তৃতীয় মিউজ়িক ভিডিও

কিছু খটকা থেকে গেছে। ছোটখাটো সামঞ্জস্যের অভাবকে আমল না দিলেও, হরিদাসের জন্য নিয়ে যাওয়া সুরুয়া মুখে দিয়েও কেন আকিরার মধ্যে কোনও পরিবর্তন এল না, তার কোনও ব্যাখ্যা নেই ছবিতে। বিদেশী বিভিন্ন ছবিতে জ়ম্বিদের যতটা ভয়ানকভাবে আমরা দেখেছি, এখানে ঠিক ততটাও ভয়াবহ রূপে দেখা গেল না তাদের। শুরুর চমকগুলো ছাড়া পরেরদিকে আর তেমন ভয় লাগে না। এছাড়া এতবার এত জ়ম্বির সঙ্গে লড়াই করেও আকিরা প্রতিবারই কীভাবে অক্ষত থেকে যায় তাও এক রহস্য। জ়ম্বি দলপতির দৃষ্টিতেও জ়ম্বিভাব তেমন প্রকট নয়। 

ছবির সিনেমাটোগ্রাফি আরও ঝকঝকে হলে ভালো লাগতো। মেঘ বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিরাজ সেনের আবহ ছবির সঙ্গে মানানসই। অভিনয়ে প্রত্যেকেই নিজের সুনাম রক্ষা করেছেন। আকিরার মতো চরিত্র যে কোনও নায়িকার কাছেই হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। গোটা ছবি জুড়েই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন তনুশ্রী। ঠান্ডা মাথায়, হাসিমুখে ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রকারী অনিলের ভূমিকায় রুদ্রনীল যথাযথ। এমন কোনও চরিত্র বোধহয় নেই যেখানে তিনি মানিয়ে যান না। তবে অবাক করলেন রজতাভ। তাঁর কন্ঠস্বর, নিষ্ঠুরতার সময়েও নির্লিপ্ত স্থৈর্য, স্বাভাবিক ছন্দে হিউমারের ব্যবহার, সবটাই হরিদাসের মোড়কে এক নতুন রজতাভকে চেনালো। 

চেনা ছকে বাঁধা ছবির ভিড়ে ‘জ়ম্বিস্তান’ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। কিছু অসঙ্গতি থাকলেও বাংলা ছবির একঘেয়েমির মোড় ঘোরাতে ছবির বিষয়বস্তু নিঃসন্দেহে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। অভিরূপের কাহিনী ও চিত্রনাট্য দুটোই বেশ কিছু জায়গায় দর্শককে ভাবতে বাধ্য করে। বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তির অগ্রগতির মধ্যেও মানবজাতির সামাজিক অবক্ষয় যেদিকে এগিয়ে চলেছে, তাতে কে বলতে পারে আমাদের আগামীদিনেও এমন কোনও ব্ল্যাক ডে ঘনিয়ে আসছে না? কে বলেছে সব রূপকথার শেষটা সকলের সুখে থাকার গল্প বলে? সব গল্পের শেষকথা ‘লিভড হ্যাপিলি এভার আফটার’ হয় না। অনেক গল্প কিন্তু সার্ভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট-এর কথাও বলে।

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *