অতীত ও বর্তমানের অঙ্কে মারণ ভাইরাসের খেলা
ছবি: স্বস্তিক সংকেত
পরিচালনা: সায়ন্তন ঘোষাল
অভিনয়ে: নুসরত জাহান, গৌরব চক্রবর্তী, রুদ্রনীল ঘোষ, শতাফ ফিগার, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, রাজ সেনগুপ্ত, সুমন্ত মুখোপাধ্যায়, মাইকেল লিপম্যান, মিক লিভারসিজ
দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ১৮ মিনিট
RBN রেটিং: ৩/৫
ইতিহাস গল্পকে সমৃদ্ধ করে, সম্ভবত সকলেই এ কথা মানবেন। আবার বিজ্ঞানও গল্পকে পুষ্ট হতে সাহায্য করে, এও অনস্বীকার্য। এই দুইয়ের পাশাপাশি সংকেতের খেলা ও রহস্যেও বাঙালি দর্শকের চিরন্তন আগ্রহ। তবে ইতিহাস, বিজ্ঞান, সংকেত এবং সবশেষে রহস্য, এই চারে মিলে গেলে কী হতে পারে তার কিছুটা আন্দাজ পাওয়া গেল ‘স্বস্তিক সংকেত’-এ। কোভিডের তৃতীয় ঢেউ পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে বড় বাজেটের ছবির হলে মুক্তি, প্রযোজকরা নিঃসন্দেহে সাহস দেখিয়েছেন। সম্পূর্ণ ছবির শুটিং হয়েছে লন্ডন ও আশেপাশের নানা জায়গায়। সেটা ছবির একটা বাড়তি আকর্ষণও বটে। ছবির শিল্পীতালিকাও যথেষ্ট নক্ষত্রখচিত। কাজেই প্রত্যাশা থাকা স্বাভাবিক ছিল। সেটা পূরণ হলো কি?
রুদ্রাণী (নুসরত) লেখিকা, ব্যাঙ্ককর্মী ও শখের ক্রিপ্টোগ্রাফারও। তার লেখা বই লন্ডনে প্রকাশিত হয়। তবে ব্যক্তিগত জীবনে সে অলস প্রকৃতির, পড়ুয়া স্বভাবের একটি মেয়ে। রুদ্রাণীর স্বামী প্রিয়ম (গৌরব) লন্ডনের একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় মোটা মাইনের চাকরি করে। ক্রিপ্টোগ্রাফিতে রুদ্রাণীর দখল আছে জেনে তার সঙ্গে যেচে আলাপ করে সিগমন্ড শ্যুমাখার (শতাফ)। তার ঠাকুরদাদার তৈরি ক্যানসারের প্রতিষেধকের ফর্মুলা রয়েছে সাইফারের আকারে। তা ডিকোড করে দিতে হবে রুদ্রাণীকে। সেই সাইফারের অর্থ উদ্ধার করতে গিয়ে রুদ্রাণী এক বিরাট অপরাধচক্রের জালে জড়িয়ে পড়ে। নিজের অজান্তেই সে লন্ডনের বুকে ছড়িয়ে দেয় এক মারণ ভাইরাস। এই অপরাধচক্রের কাজ জার্মান শাসক অ্যাডল্ফ হিটলারের আদর্শকে বয়ে নিয়ে চলা, অর্থাৎ ইউরোপকে অভিবাসী ও বিদেশি মুক্ত করে বিশুদ্ধ আর্য রক্তের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা।
এত বড় এক অপরাধচক্রে জড়িয়ে গিয়ে রুদ্রাণী অ্যান্টিডোট খুঁজতে বাধ্য হয়। খুঁজতে গিয়ে সামনে আসে স্বস্তিক চিহ্ন ও আজাদ হিন্দ ফৌজের বাঘের ছবি। সেই ছবিতে থাকা সংখ্যার ব্যাখ্যা দিতে পারবেন একজনই। সুভাষচন্দ্র বসুর (শাশ্বত) ঘনিষ্ঠ রেডিও ইঞ্জিনিয়র সত্যেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জীর পুত্র সুভাষ চ্যাটার্জী (রুদ্রনীল, দ্বৈত ভূমিকায়)। এরপরের গল্প প্রেক্ষাগৃহের জন্য তোলা থাক।
আরও পড়ুন: বিলুপ্তির পথে টোটো, ঢাকায় রাজাদিত্যর নতুন তথ্যচিত্র
আসা যাক ছবির অন্যান্য বিষয়ে। কাহিনীর প্রেক্ষাপট যথেষ্ট উর্বর ছিল, কিন্তু তবু যেন দানা বাঁধল না। গল্পের গোড়াতেই গলদ রয়ে গেল। শ্যুমাখার যদি ব্যক্তিগত প্রয়োজনে রুদ্রাণীকে খুঁজে পেয়ে কাজটা করাতে চাইত তাহলে তা বিশ্বাসযোগ্য হতো। কিন্তু যেখানে সরকারের এতবড় একজন মাথা গোটা ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণ করছে, সেখানে নামী এবং স্বদেশী কোনও পেশাদারকে ছেড়ে খামোখা এক শখের বাঙালি ক্রিপ্টোগ্রাফাররের সাহায্য প্রার্থনার যুক্তি কোনওদিক দিয়েই ধোপে টেকে না। ক্রিপ্টোগ্রাফার কি কম পড়িয়াছে? আবার প্রফেসর রুডল্ফ—যিনি হিটলারের হয়ে কাজ করেন—কেনই বা তার গোপন গবেষণার সবচেয়ে দামী সূত্রটি কোনও বাঙালি রেডিও ইঞ্জিনিয়রকে লুকিয়ে রাখার দায়িত্ব দিলেন তাও বোধগম্য হয় না। এছাড়া সত্যেন্দ্র যেভাবে সেই সূত্রকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে রাখলেন, তা কষ্টকল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। সত্যেন্দ্রর পক্ষে ওই সময়ে বসে আশা করা অসম্ভব যে একশোর কাছাকাছি বছর পরে কেউ আবারও এই ওষুধের খোঁজ করবে। একটা অ্যান্টিডোট অর্থাৎ ওষুধ। মানুষকে সুস্থ করে তোলার কোনও বিশেষ ওষুধকে এভাবে অসম্ভবের পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখা বেশ অযৌক্তিক।
তবে এই সবকিছুকে মাথায় রেখেও বলা যায় যে এই ছবি বর্তমান বিশ্বের এক বাস্তব সমস্যা, জাতিভেদ বা রেসিজ়মকে সামনে এনেছে। হিটলারের সময়ে যা ইহুদি তথা সমগ্র মানবসমাজকে আতঙ্কগ্রস্থ করে তুলেছিল, তা এ যুগেও সমানভাবে সাদা চামড়ার একশ্রেণীর মানুষের মধ্যে রয়ে গেছে। গত কয়েক বছরের ঘটনাক্রম বিশ্ববাসীকে সে কথা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে।
ছবির নির্মাণ এককথায় ঝকঝকে, স্মার্ট। লন্ডন শহরকে অত্যন্ত নয়নাভিরাম করে দর্শকের সামনে তুলে ধরেছেন সায়ন্তন। ভালো লেগেছে শহরতলীর দৃশ্যও। আগাগোড়া ছবিটিকে আধুনিকতার মোড়কে যেভাবে পেশ করা হয়েছে তা দর্শকদের ভালো লাগতে বাধ্য। ভালো লাগে ঐতিহাসিক দৃশ্যগুলিও। টুবানের চিত্রগ্রহণ প্রশংসণীয়। মেকআপে আবারও নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন সোমনাথ কুন্ডু। সুভাষচন্দ্রের ভূমিকায় শাশ্বতকে ঠিক যেন ক্যালেন্ডার থেকে নেমে আসা নেতাজী মনে হয়েছে। রুদ্রনীলের বৃদ্ধ বয়সের মেকআপ আর একটু ভালো হতে পারত। তবে সুমন্তর মৃত্যুশয্যার ছবিতে তাঁর শীর্ণদেহের মেকআপ যেন চমকে দেয়।
আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি
এবার অভিনয়। নুসরত ও গৌরব একইরকম ঝকঝকে ও সাবলীল। দুজনেই তাঁদের চরিত্রে মানিয়ে গিয়েছেন। নুসরতের অভিনয় খুব পরিণত লেগেছে। তাঁকে অসম্ভব সুন্দর দেখতেও লেগেছে। প্রিয়ম চরিত্রের অপ্রয়োজনীয় কথা বলার ব্যাপারটা বেশ বিরক্তিকর লাগল। তবু সেই বিরক্তির কারণকে সার্থকভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন গৌরব। দ্বৈত চরিত্রে যথারীতি বিশ্বাসযোগ্য রুদ্রনীল। বিশেষ করে সত্যেন্দ্রর ছেলে সুভাষের চরিত্রে তাঁর শরীরী ভাষা বুঝিয়ে দেয় অভিনেতা হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতাকে। শতাফকে ছোট চরিত্রে দেখতে ভালো লাগে। তাঁর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি মনে রাখার মতো। রুদ্রাণীর দাদুর ভূমিকায় সুমন্তর বিছানায় আধশোয়া হয়ে থাকার দৃশ্যটি মন ছুঁয়ে যায়। ওই একটি দৃশ্যে নিজের জাত চিনিয়েছেন সুমন্ত। বাংলাদেশি জিমির চরিত্রে সুন্দর মানিয়ে গিয়েছেন রাজ। বিদেশি অভিনেতারাও সকলেই চরিত্রের প্রয়োজন পূরণ করেছেন।
সব শেষে বলতে হয় শাশ্বতর কথা। তিনি গল্পের কেউ না হয়েও থেকে যাবেন দর্শকের মনে। সুভাষচন্দ্রের ভূমিকায় এমন সার্থক রূপদান বাংলা ছবিতে এর আগে হয়েছে বলে জানা নেই। স্বল্প পরিসরে একেবারে স্বপ্নের নেতাজীকে বই থেকে তুলে এনেছেন শাশ্বত। গম্ভীর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, পরিমিত আবেগপ্রবণ ও কর্তব্যে অবিচল সুভাষ বোধহয় এমনই ছিলেন।
রাজা নারায়ণ দেবের আবহ সঙ্গীত ভালো হলেও ছবিতে গান রাখার কোনও প্রয়োজন ছিল না। এই ধরনের গল্পে দর্শক পরবর্তী ঘটনার অপেক্ষায় থাকে। সেখানে আচমকা গান বেশ পীড়াদায়ক। সৌগত বসুর চিত্রনাট্য সময়োপযোগী ও যথাযথ।
সব মিলিয়ে ‘যখের ধন’ ও ‘আলিনগরের গোলকধাঁধা’র পর সায়ন্তনের মুকুটে আর একটা পালক যোগ করবে ‘স্বস্তিক সংকেত’-এর ঝাঁ চকচকে মেকিং, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।