ভালো অভিনয়ে ঢাকা পড়ল দুর্বল চিত্রনাট্য
সিরিজ়: অ্যাডভোকেট অচিন্ত্য আইচ
পরিচালক: জয়দীপ মুখোপাধ্যায়
অভিনয়ে: ঋত্বিক চক্রবর্তী, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, সুরাঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়, অলকানন্দা রায়, দেবরাজ ভট্টাচার্য, লোকনাথ দে, সৃজা ভট্টাচার্য, খেয়া চট্টোপাধ্যায়, দুলাল লাহিড়ি, সনমিত্র ভৌমিক
সিরিজ়ের দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ৪৭ মিনিট (৭ পর্বে)
RBN রেটিং ★★★★★☆☆☆☆☆
শহর কলকাতার বুকে প্রতিনিয়ত কোনও না কোনও অপরাধ ঘটে চলে। অপরাধী কখনও ধরা পড়ে, কখনও পড়ে না। অনেক ক্ষেত্রে আসল অপরাধী থেকে যায় আড়ালে, দোষ পড়ে কোনও নিরপরাধের ঘাড়ে। কিন্তু কোনও নিরপরাধ ব্যক্তি কি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারে? সবসময় কি তারা ন্যায়বিচার পায়? সেরকমই এক ন্যায়বিচার পাওয়ার কাহিনি নিয়ে এসেছেন জয়দীপ তাঁর নতুন সিরিজ় ‘অ্যাডভোকেট অচিন্ত্য আইচ’-এ।
এই কাহিনির কেন্দ্রীয় চরিত্র অচিন্ত্য (ঋত্বিক) স্বীকার করে, সে অত্যন্ত খারাপ উকিল। সাধারণত গরু-ছাগল চুরি করার মামলাই সে লড়ে। তার বাবা নির্মল আইচ (দুলাল) একসময় আদালতকর্মী থাকার দরুণ অচিন্ত্য ‘খারাপ উকিল’ হলেও আদালতে তার কিছু পরিচিতি রয়েছে। এদিকে একই সময়ে দত্তবাড়িতে ঘটে যায় এক হত্যাকাণ্ড। সঙ্গীতচর্চার ক্ষেত্রে অবদানের জন্য দত্তবাড়ির ভারতজোড়া খ্যাতি। এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক পুরষ্কারপ্রাপ্ত, সরোদবাদক পাবলো দত্তকে (সনমিত্র) মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তার পাশে রক্তমাখা ছুরি হাতে তারই স্ত্রী মালিনীকে (সুরাঙ্গনা) বসে থাকতে দেখা যায়।
মালিনীকে অভিযুক্ত করে তার বিরুদ্ধে মামলা করেন দেবনাথ দত্ত (লোকনাথ)। বাদীপক্ষের হয়ে মামলা লড়তে আসে বিখ্যাত উকিল সীতারাম গাঙ্গুলি (শাশ্বত)। এদিকে সীতারামের নাম শুনে কেউ মালিনীর হয়ে মামলা লড়তে প্রস্তুত নয়। এই পরিস্থিতিতে এগিয়ে আসে অচিন্ত্য। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় পুলিশ অফিসার গীতা (খেয়া) এবং অচিন্ত্যর সহকারী ভীম লক্ষ্মণ সর্দার (দেবরাজ)।
এই সিরিজ়ের অন্যতম জোরের জায়গা হলো কয়েকজন শিল্পীর দুর্দান্ত অভিনয়। নামভূমিকায় ঋত্বিক (Ritwick Chakraborty) দারুণ তো বটেই, পাশাপাশি তার প্রতিপক্ষ সীতারামের চরিত্রে শাশ্বত (Saswata Chatterjee) অনবদ্য। বনেদি পরিবারের ঠাটবাট বারবার ফিরে এসেছে অলকানন্দা (Alokananda Roy) ও লোকনাথের (Loknath Dey) শরীরি ভাষায়। মালিনীরূপী সুরাঙ্গনার (Surangana Bandyopadhyay) জন্য খুব বেশি সংলাপ বরাদ্দ ছিল না। তবু চোখমুখের অভিব্যক্তিতে খুনের আসামীর চরিত্র দারুণভাবে ফুটিয়ে তুললেন তিনি। সনমিত্র ও দুলাল যথাযথ।
আরও পড়ুন: সত্যজিতের আরও দুটি ছবি সংরক্ষণের কাজ শুরু
আলাদা করে বলতে হয় তিনটি চরিত্রের কথা। হত্যারহস্যের অন্যতম সাক্ষী পাখির ভূমিকায় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জেরাপর্বে সৃজার অভিনয় মনে রেখে দেওয়ার মতো। অপরদিকে, রহস্যভেদের জন্য অচিন্ত্যর সহকারী ভীমের চরিত্রে দেবরাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। চরিত্রের প্রয়োজনে মিশিয়ে দিয়েছেন হাস্যরসের কিছু উপাদানও। সবমিলিয়ে চরিত্রটি উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। এছাড়া, অচিন্ত্যর নানা সমস্যায় ভরা জীবনে টাটকা বাতাস হয়ে আসা গীতার ভূমিকায় খেয়া অত্যন্ত সাবলীল।
আরও পড়ুন: আবারও কানে ‘মন্থন’
তবে কাহিনিগত দিক থেকেই সবথেকে বড় সমস্যায় পড়ে ‘অ্যাডভোকেট অচিন্ত্য আইচ’ (Advocate Achinta Aich)। হত্যাকাণ্ডে পুলিশি তদন্ত হবেই। তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট পেশ করে পুলিশ। তারপর শুরু হয় বিচার প্রক্রিয়া। সিরিজ়ে সেই গোটা তদন্ত প্রক্রিয়াই বাদ। পুলিশের তরফ থেকে অভিযুক্তের বিপক্ষে কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ পেশ করতে দেখা গেল না। তাকে স্রেফ অনুমানের ভিত্তিতে কাঠগড়ায় তোলা হলো। এ মামলা তো শুরুতেই খারিজ হয়ে যাওয়ার কথা। আরও আছে। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ডিএনএ পরীক্ষা করা গেলেও, আদালতে তা তখনই গ্রাহ্য হয় যদি আদালত নিজে সেই পরীক্ষা করার আদেশ দেয়। এখানেই শেষ নয়, ইচ্ছে হলেই ভিডিয়ো এভিডেন্স আদালতে পেশ করা যায় না। এই মর্মে আগাম আবেদন করতে হয়। বিপক্ষের উকিল সম্মত হলে, তবেই তা পেশ করা যায়। সেই ভিডিয়োর সত্যতা যাচাই করার জন্য ফরেন্সিক পরীক্ষাও করা হয়। এরকম বহু ছিদ্র রয়ে গেছে চিত্রনাট্যে।
কাহিনির মোচড় এবং কয়েকটি চরিত্রের সঙ্গে অতীতের সম্পর্কের অংশগুলি ভালো হলেও খুব তাড়াহুড়ো করে শেষ করা হয়েছে সিরিজ়িটি। তাই সূত্র মেলাতে গিয়ে গোঁজামিলের আশ্রয় নিতে হয়েছে। দর্শক আগের সুতোগুলির সঙ্গে মেলাতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলতে পারেন। শুভদীপ গুহর আবহ প্রয়োগ যথাযথ। বিভিন্ন সময়ের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় আলোছায়ার খেলায় চিত্রগ্রাহক টুবান দে সফল। তবু সম্পাদনার ক্ষেত্রে মলয় লাহা এতখানি নির্মম না হলেও পারতেন। সেক্ষেত্রে কাহিনি আরও জমাট হতে পারত।
ওয়েব সিরিজ় জগতের ধারা অনুসরণ করে এই সিরিজের রহস্যকে অমীমাংসিত রেখে দর্শককে পরবর্তী সিজ়নের জন্য অপেক্ষা করাননি জয়দীপ। সে জন্য তাঁর সাধুবাদ প্রাপ্য। তবে কাহিনি আরও মজবুত করতে না পারলে পরবর্তী সিজ়নে দর্শকের আগ্রহ কমতে বাধ্য।