বিশ্বাসে ভর করে স্বপ্নের উড়ান

ছবি: উড়োজাহাজ

পরিচালনা: বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

অভিনয়ে: চন্দন রায় সান্যাল, পার্নো মিত্র, সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়, সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়, অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, অনিরুদ্ধ ধর

দৈর্ঘ্য: ১ ঘন্টা ২২ মিনিট

RBN রেটিং: ৪/৫

মনুষ্যমনন স্বপ্নবিলাসী। কিন্তু স্বপ্নের সর্পিল পথে এগোতে গিয়ে যখন তার ভীষণ আপনার স্বপ্নটা ভাঙনের গন্ধ পায়, ঠিক তখনই থমকে যেতে হয় তাকে। তবুও তো মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। তাই স্বপ্নও কখনও শেষ হয় না। এইভাবেই একের পর এক স্বপ্নের রঙিন জালে জড়িয়ে পড়তে থাকে সে। 




বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘উড়োজাহাজ’ আদতেই এক স্বপ্নপূরণের কাব্য। গাড়ির মেকানিক বাচ্চু মন্ডলের (চন্দন) স্বপ্ন আকাশে ওড়ার। শিশুমনের চন্দনের এই স্বপ্নকে একমাত্র বুঝতে পারে তার ছেলে। একদিন হঠাৎই এক জঙ্গলের ভিতর বাচ্চু খুঁজে পায় এক ভাঙাচোরা যুদ্ধবিমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী সেই বিমান ভারত সরকারের সম্পত্তি হওয়া সত্বেও বাচ্চু তা মানতে নারাজ। যে বিমান সে খুঁজে পেয়েছে সেই বিমান তারই, এমনই এক বিশ্বাসে বলীয়ান বাচ্চু পুলিশ প্রশাসনের মুখোমুখি হতেও ভয় পায় না। ঠিক এই জায়গায় বাচ্চুর সঙ্গে দর্শক মিল পাবেন ‘অযান্ত্রিক’-এর বিমলের। ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত সেই ছবির সঙ্গে এই ছবির কোনওরূপ মিল না থাকলেও, সাধারণ একটা যন্ত্রের প্রতি গভীর এক ভালোবাসা দুটি ছবিকেই ঘিরে রয়েছে।

আরও পড়ুন: নিজের বায়োপিকে থাকছেন না সৌমিত্র

পরিচালক নিজে কবি। তাঁর পরিচালনায় স্বপ্নের সঙ্গে ছন্দ মিলে যায় আশ্চর্যভাবে। চন্দন ও তার স্ত্রীর প্রেমের দৃশ্যগুলো তাই চার দেওয়ালের গন্ডি পেরিয়ে পাড়ি জমায় দিগন্তে। পড়ে থাকে শুধু একটি খোলা জানালা। উন্মুক্ত সেই সুন্দর ঘরের জানালার পাশ দিয়ে চলে যায় এক বাঁশিওয়ালা। স্বপ্ন এবং বাস্তবতার ব্যবধানের এক অপূর্ব দৃশ্যাখ্যান থেকে যায় পর্দাজুড়ে। ‘উড়োজাহাজ’ বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের এক অতি চেনা ছবি। এ ছবি স্বপ্ন দেখতে শেখায়।

কিন্তু স্বপ্নপূরণ?

জঙ্গলের মাঝে একাকী ভাঙা প্লেন সারানোতে ব্যস্ত বাচ্চুর সঙ্গী একদল মৃত মানুষ। জীবিতাবস্থায় তারাও একসময় স্বপ্ন দেখতো। কেউ স্বপ্ন দেখতো একমুঠো ভাতের, কেউ দেখতো ভালোবাসার। কিন্তু স্বপ্নপূরণের আকাঙ্খাই তাদের ঠেলে দিয়েছে মৃত্যুর মুখে। তবে কি আজ মানুষের স্বপ্ন দেখা বারণ? পুলিশ অফিসার যখন বাচ্চুকে প্রশ্ন করে, ‘এ দেশটা কার?’, সহজ সরল বাচ্চুর অবুঝ মন জানতে চায়, “এ দেশটা আমাদের নয় স্যার?”

এখানেই এক অদ্ভুত টানাপোড়েনের সামনে এনে দাঁড় করালেন পরিচালক। সত্যিই তো! দেশ তো জনগণের। তাহলে জনগণ তার ইচ্ছামতো বাঁচতে চাইলে সেখানে অন্য কারোর হস্তক্ষেপ কেন? পরবর্তী আরেক দৃশ্যেই উত্তর পাওয়া যায় এই প্রশ্নের। ক্ষমতা ও ক্ষমতালোভী মানুষের আগ্রাসী মনোভাবের কথা জানিয়ে পরিচালক বলছেন, “ক্ষমতা যার, প্লেনটা তার।” অর্থাৎ প্লেন সরকারের। এইভাবে প্রশাসন বাচ্চুর স্বপ্নকে শুধুমাত্র ভেঙেই দেয় না, উল্টে মানুষটার নামের আগে উন্মাদ, পাগল এধরনের তকমাও সেঁটে দেয়।

আরও পড়ুন: ১৬ বছর পর বাংলা ছবিতে রাখী, পেলেন সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার

বাচ্চুর স্বপ্নের জগতের একমাত্র বাস্তব তার ওই ভাঙাচোরা বিমান। নিজের হাতে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে প্লেনের গায়ে লাল নীল ফুল ফলের নকশা আঁকতে থাকে সে। যেমন করে গ্রামের লোকেরা নিজেদের বাড়ির দেওয়ালে নকশা এঁকে তাকে সুন্দর বানায়, ঠিক তেমনই। তার কান্ড দেখে সেই মৃত মানুষের দল বলে ওঠে, এই  যুদ্ধবিমান কত হাজার হাজার মানুষকে মেরে ফেলেছে এক নিমেষে। তখন হয়তো কোনও সন্তান তার বাবাকে জড়িয়ে ঘুমোচ্ছিল অথবা কোনও স্ত্রী তার স্বামীকে আদর করছিল। তাই সেই যুদ্ধবিমান কে কেন ওড়াবে বাচ্চু? প্লেনের গায়ে তুলির টান দিতে দিতে বাচ্চু বলে, ‘এখন তো এটা যুদ্ধবিমান নয়। আর কাউকে মারতে পারবে না এটা। এটা এখন একমুঠো আকাশ।’ সত্যিই কত সহজে ধ্বংসের কারণগুলোকে মুছে ফেলা যায় পৃথিবী থেকে।

প্রতীকী ভাবনার ‘উড়োজাহাজ’ বুদ্ধদেবের অন্যান্য ছবির তুলনায় অনেক বেশি সহজ। হয়তো বা সেই ছবির বর্তমান বাস্তবের আয়নায় প্রতিফলন ঘটছে বলে সাধারণ মানুষের কাছে বোধগম্য হবে। কাট-শট সিনেমাটোগ্রাফির অসাধারণ কাজ দেখালেন অসীম বসু। অলকানন্দা দাশগুপ্তের পরিমিত আবহ যথাযথ সঙ্গত দিয়েছে ছবিজুড়ে। অভিনয়ের দিক থেকে প্রত্যেকেই যথাযত। বাচ্চুর চরিত্রে চন্দন অনবদ্য। যদিও সাঁওতাল এলাকায় থাকা অশিক্ষিত চন্দনের মুখের ভাষা একটু বেশিই আধুনিক ও স্পষ্ট ঠেকে। যে লোক তার ছেলেকে বলছে সে বাংলা লিখতে পড়তে জানে না আবার সেই জানাচ্ছে ভূগোলের বইতে দেশ বিদেশের কথা পড়ার গল্প। খটকা লাগে সেখানেই। তবে বাচ্চুর স্ত্রীর চরিত্রে বিশেষ কিছু করার ছিল না পার্নোর।

‘উড়োজাহাজ’ সম্পূর্ণভাবেই পরিচালকের ছবি। শেষ দৃশ্যে বিশ্বাসে ভর করে স্বপ্নের রানওয়েতে দৌড়তে থাকে বাচ্চু। ওড়াতে থাকে তার স্বপ্নের ডানা। ধাওয়া করে পুলিশ। কিন্তু বাচ্চু থামে না, উড়তে থাকে। যেমন উড়তে চায় সাধারণ মানুষ। কারোর হয়তো ডানা ছেঁটে দেওয়া হয়। তবুও ওড়া কি বন্ধ করা যায় তার? আর যাই হোক, স্বপ্নের ডানায় ভর করে উড়তে তো কোনও বাধা নেই।

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Gargi

Travel freak, nature addict, music lover, and a dancer by passion. Crazy about wildlife when not hunting stories. Elocution and acting are my second calling. Hungry or not, always an over-zealous foodie

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *