প্রকাশিত হলো পূর্ণাঙ্গ ‘শ্যামা’র অ্যালবাম
কলকাতা: ‘রাজকোষ হতে চুরি! ধরে আন চোর, নহিলে নগরপাল, রক্ষা নাহি তোর। মুন্ড রহিবে না দেহে।’ এ এমন এক নেপথ্য সংলাপ যা শ্রবণে প্রবেশ করা মাত্র মন চলে যায় এক অজানা নগরীতে, যার রাজনর্তকীর নাম শ্যামা। রাজার আদেশ পেয়ে কোটাল স্থির করে, যে কোনও একজনকে অপরাধী সাব্যস্ত করে রাজার সামনে ধরে আনতেই হবে। অতএব শুরু হয় খোঁজ। বিদেশী বজ্রসেন বাণিজ্য করতে এসেছেন সেই নগরীতে। তাকেই কোটাল দোষী সাব্যস্ত করে। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। প্রথম দর্শনেই শ্যামা বজ্রসেনের প্রেমে আত্মহারা। যে করে হোক তার সাজা রদ করতেই হবে। শ্যামার অসাধ্য কিছুই নয়। তার প্রেমানলে আত্মাহুতি দিয়ে কিশোর উত্তীয় বাঁচিয়ে দেয় বজ্রসেনকে।
তারপরে কি ঘটে তা রবীন্দ্র অনুরাগী মাত্রেই জানেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্যতম জনপ্রিয় নৃত্যনাট্য ‘শ্যামা’ একাধাকিবার এসেছে মঞ্চে। তার গান ও সংলাপ লং প্লেয়িং রেকর্ডে শোনা গেছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, সন্তোষ সেনগুপ্তর মতো শিল্পীদের কণ্ঠে। পরবর্তীকালে শ্রীকান্ত আচার্য ও ইন্দ্রানী সেনের কণ্ঠেও শোনা গেছে ‘শ্যামা’।
আরও পড়ুন: তাশি গাঁওয়ে একদিন
তবুও যেন পুরোনো হয় না এই নৃত্যনাট্যের আবেদন। তাই আবারও নতুন করে ‘শ্যামা’কে শ্রোতাদের সামনে হাজির করলেন সঙ্গীত পরিচালক দেবজিত রায়। এবার শ্যামার কণ্ঠে আছেন ইমন চক্রবর্তী ও বজ্রসেন সাহেব চট্টোপাধ্যায়। এছাড়া উত্তীয়র চরিত্রে কণ্ঠদান করেছেন তৃষিত চৌধুরী ও কোটালের ভূমিকায় আছেন দেবাদৃত চট্টোপাধ্যায়। গতকাল শহরে এক অনুষ্ঠানে প্রকাশিত হলো ‘শ্যামা’র অডিও সিডি। অনুষ্ঠানে শিল্পীদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট পারকাশনিস্ট তন্ময় বোস। ইউটিউবেও শোনা যাবে সম্পূর্ণ আলেখ্যটি।
কিন্তু আবারও ‘শ্যামা’ কেন?
“‘শ্যামা’ নিয়ে প্রথম যে কাজটা হয়েছিল সেটার প্রেজ়েন্টেশন নিয়ে কিছু বলার নেই। অসাধারণ কাজ ছিল সেটা। কিন্তু আমাদের প্রজন্মই বা এত সুন্দর একটি আলেখ্যর ওপর কাজ করা থেকে বঞ্চিত হবে কেন? রবীন্দ্রনাথের গানের ওপর নতুন করে তো কিছু করার থাকে না, তবে যেটুকু আমরা চেষ্টা করতে পারি তা হলো সঙ্গীতের অ্যারেঞ্জমেন্টটাকে বর্তমান প্রজন্মের জন্য উপযোগী করতে,” জানালেন দেবজিত।
আরও পড়ুন: তিন মূর্তি ও পায়ের তলায় সরষে
“এর আগে ‘শ্যামা’র প্রত্যেকটি অ্যালবামেই নৃত্যনাট্যের কিছুটা অংশ বাদ দিয়ে করা হয়েছে,” জানালেন সাহেব। “এই প্রথমবার ‘শ্যামা’তে কোনও এডিট নেই। রবীন্দ্রনাথের মূল রচনাটা যেভাবে আছে, সেভাবেই পুরোটা গাওয়া হয়েছে। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের গান মানেই সেটা হারমোনিয়াম, তবলা, মন্দিরা, এসরাজের সঙ্গে গাইতে হবে, এই ধারণা অনেকদিন আগেই পাল্টে গেছে। সেই ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দেবজিত এমন কিছু ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার করেছে যেগুলো প্রত্যেকটা চরিত্রকে আলাদাভাবে বুঝতে সাহায্য করবে। সব মিলিয়ে কাজটা নতুন প্রজন্মকে ভেবেই করা।”
কীরকম যন্ত্রানুসঙ্গ ব্যবহৃত হয়েছে এবারের ‘শ্যামা’য়?
বজ্রসেনকে যেহেতু বিদেশী বলা হয়েছে, তাই তার অংশগুলোয় আবহের মাধ্যমে ভিন্ন সাউন্ডস্কেপ ব্যবহার করেছেন দেবজিত। শ্যামার অংশে খোল, পাখোয়াজের ব্যবহার হয়েছে। উত্তীয়র অংশে রয়েছে গীটার ও পিয়ানো। কোটালের চরিত্রটা গ্রাম্য প্রেক্ষাপটে ভাবা হয়েছে। তাই সেখানে লোকসঙ্গীতের আবহ আনতে ঢোল ব্যবহার হয়েছে।
আরও পড়ুন: যে জন থাকে মাঝখানে
“চারটে চরিত্রের প্রেক্ষাপট তাদের আবহের মাধ্যমে উঠে আসবে,” জানালেন দেবজিত। “আবার কিছু অংশে ‘পরিশোধ’ অর্থাৎ ‘শ্যামা’র গদ্যরূপের যে পাঠ্যাংশ, তার থেকে পাঠ করা হয়েছে। এটা সাহেব ও ইমন দুজনেই করেছে। কেন না কিছু আবেগ ওইভাবেই ভালো শোনায়।”
এর আগে রবীন্দ্রনাথের অন্য নৃত্যনাট্যের গানে অংশ নিলেও এই প্রথম শ্যামার ভূমিকায় কণ্ঠ দিলেন ইমন। “আসলে এই কাজটা এত অন্যরকম ভাবে করা হয়েছে যে রবীন্দ্রনাথের গানের আসল মেজাজটা ধরে রেখেও তা নতুন প্রজন্মের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম,” জানালেন ইমন। “শ্যামা চরিত্রটি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে একজন রাজনর্তকীর স্বাভাবিক অহংকারের সঙ্গে তার মধ্যে একজন সৎ মানুষ লুকিয়ে আছে। সে নিজের প্রেমকে পাওয়ার জন্য যা খুশী করতে পারে এবং পরে গিয়ে সে কথা স্বীকার করতেও দ্বিধা করে না। তার স্বপ্নের পৃথিবী ভেঙে যাবে জেনেও সে বজ্রসেনকে সত্যিটা বলে। এই সৎ সাহসটা আমাকে ভাবিয়েছিল। আমার মনে হয়েছে যে মানুষটা সৎ তার গায়কীতে একটা জোর থাকা দরকার। শ্যামার ব্যক্তিত্বের এই দিকটাই আমি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি।”
আরও পড়ুন: পঁচিশে ‘উনিশে এপ্রিল’
নিয়মিত রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলেও, এই প্রথম বজ্রসেনের ভূমিকায় গাইলেন সাহেব। “কাজটা আমার নিজের খুব পছন্দ হয়েছে,” জানালেন তিনি। “রবীন্দ্রনাথের গানকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে গেলে ওদের মতো করে সেটা উপস্থাপন করতে হবে। এই নিয়ে আমি দেবজিতের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করেছি। আমি কীভাবে বজ্রসেনকে দেখছি আর ও কী ভাবছে সেটা নিয়ে কথা বলে এগিয়েছি। দেবজিত যেভাবে সুরের অলঙ্করণটা করেছে সেটা আমার অসাধারণ লেগেছে।”
উত্তীয়র ভূমিকায় থাকা তৃষিত জানালেন, “এর আগে মঞ্চে একাধিকবার ‘শ্যামা’র গান গাইলেও, রেকর্ডিং করলাম এই প্রথম। সম্পূর্ণ আলেখ্যটার মধ্যে দিয়ে প্রত্যেকের নিজস্ব গায়কীর স্টাইল ও দেবজিতদার বেসিক অ্যারেঞ্জমেন্টটা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।”
আরও পড়ুন: পাকদণ্ডীর পথে পথে দেওরিয়াতাল
তন্ময় মনে করেন, “রবীন্দ্রনাথের গান এমন এক আবেগ যা অস্তমিত গায়কদেরও আয়ু বাড়িয়ে দেয়। মানুষ একটা ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীতের অ্যালবামের আশায় বসে থাকেন এখনও। আর এখানে তো নতুনভাবে শ্যামাকে নিয়ে ভাবা হয়েছে। আমি নিশ্চিত শ্রোতাদের এই নতুন ‘শ্যামা’ ভালো লাগবেই।”
সমগ্র অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনায় ছিলেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়।