ফ্যান্টাসির জালে জড়িয়ে গেল গুপ্তধনের রহস্য
ছবি: সাগরদ্বীপে যকের ধন
পরিচালনা: সায়ন্তন ঘোষাল
অভিনয়ে: পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, কোয়েল মল্লিক, গৌরব চক্রবর্তী, কাঞ্চন মল্লিক, কৌশিক সেন, শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়, রজতাভ দত্ত, অ্যাডোলীনা চক্রবর্তী
দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ৫ মিনিট
RBN রেটিং: ২.৫/৫
গুপ্তধনের সন্ধান করা ও তাই নিয়ে এক রুদ্ধশ্বাস অভিযানের গল্প বলার এক নতুন ধারার সৃষ্টি হয়েছে বাংলা ছবিতে। বাঙালি দর্শক বরাবরই গোয়েন্দা ও রহস্যের গুণমুগ্ধ ভক্ত। প্রায় প্রত্যেকেরই ছোটবেলা কেটেছে নিজেকে শংকর ভেবে বা শীতকালে গায়ে চাদর জড়িয়ে নিজেকে ফেলুদা সাজিয়ে। এই শংকরের পাশাপাশি আরও দুজন অভিযানপ্রেমী মানুষের জন্ম হয়েছিল হেমেন্দ্রকুমার রায়ের হাত ধরে। বিমল ও কুমার-এর জুটি বাঙালি অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় পাঠকের কাছে অতিপরিচিত। এদের দুঃসাহসিক অভিযান নিয়ে লেখা ‘যকের ধন’ অবলম্বনে ২০১৭-তে মুক্তি পেয়েছিল সায়ন্তনের একই নামের ছবি।
প্রথমেই বলে রাখা ভালো, ‘সাগরদ্বীপে যকের ধন’-এ বিমল-কুমার জুটি উপস্থিত থাকলেও এই গল্প হেমেন্দ্রকুমারের লেখা নয়। সৌগত বসুর মৌলিক চিত্রনাট্য নিয়ে এই ছবি পরিচালনা করেছেন সায়ন্তন। ‘সাগরদ্বীপে যকের ধন’ আসলে কল্পবিজ্ঞান ও গুপ্তধনের মেলবন্ধন। তরল রেড (লাল) মার্কারির সন্ধানে তাইল্যান্ড পাড়ি জমায় বিমল (পরমব্রত), কুমার (গৌরব) ও তাদের আরেক সঙ্গী বাঁকাশ্যাম ধর (কাঞ্চন)। এই বাঁকাশ্যামবাবুর বাবা একজন বৈজ্ঞানিক ছিলেন যিনি প্রথম এই রেড মার্কারির হদিশ পান এবং তার সূত্র বিভিন্ন ধাঁধার মাধ্যমে নিজের গবেষণাগারে লুকিয়ে রাখেন।
আরও পড়ুন: ১৬ বছর পর বাংলা ছবিতে রাখী, পেলেন সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার
রেড মার্কারির খোঁজ করতে গিয়ে বিমল-কুমার মুখোমুখি হয় ডাক্তার রুবি চট্টোপাধ্যায়ের (কোয়েল)। রুবিরও উদ্দেশ্য রেড মার্কারি খুঁজে পাওয়া কারণ তার ওপর নির্ভর করে আছে এক অজানা রোগে আক্রান্ত রুমি নামের এক শিশুর জীবন। সন্ধান এবং যাত্রা এক হওয়ায় বিমল, কুমার এবং রুবি একসঙ্গে এগিয়ে যায় একটার পর একটা ধাঁধার জট কাটিয়ে।
সম্প্রতি যে সংখ্যক রহস্য উপাদানে ভরপুর ছবি বাংলায় হয়েছে, তাতে দর্শক এই ছবিতে সহজেই অনুমান করতে পারবেন পরের দৃশ্যে কি হতে চলেছে। ছবির প্রথমার্ধে একের পর এক রহস্যের উন্মোচন এবং অভিযানের প্রস্তুতি বেশ উপভোগ্য। কাঞ্চনের কমিক টাইমিং অসাধারণ। গোটা ছবিটা শুধু তাঁর জন্যই দেখা যায়। দ্বিতীয়ার্ধে কোথাও যেন সেই গল্পের টানটান উত্তেজনাতে ভাঁটা পড়ে। এছাড়া অযাচিত হাস্যরস সৃষ্টির চেষ্টাও বিরক্তির উদ্রেক ঘটায়।
আরও পড়ুন: নিজের বায়োপিকে থাকছেন না সৌমিত্র
এত সুন্দর প্লট, রহস্যের বুনন, একঝাঁক দাপুটে অভিনেতা থাকা সত্বেও ছবির ক্লাইম্যাক্সে কল্পবিজ্ঞানের প্রাণী এনে সায়ন্তন এক বাটি দুধে একফোঁটা চোনা ফেলে দিলেন। গুপ্তধনের রহস্য তাই জড়িয়ে গেল ফ্যান্টাসির জালে। খনিজ সম্পদের ভান্ডার দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়া বর্তমানে বিশ্বে একটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক সমস্যা। তাই তার পরিপূরক হিসেবে রেড মার্কারির ব্যবহার বিজ্ঞানের ইতিহাসে আলোড়ন সৃষ্টি করবে, এটাই ছিল অভিযানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য। অথবা অজানা সেই রোগের ওষুধ হিসেবে রেড মার্কারি ব্যাবহারের চেষ্টা নিয়েও এগোতে পারত কাহিনী। কিন্তু ‘আলিনগরের গোলকধাঁধা’র মতো ছবি যার হাত দিয়ে বেরিয়েছে, তার কাছে শেষ পর্যন্ত এরকম হাস্যকর সমাপতন কাম্য ছিল না।
অভিনয়ে প্রত্যেকেই যথাযথ। কুমারের চরিত্রে গৌরবের থেকে আরও কিছুটা সক্রিয়তা আশা করা যেত। মিতিনমাসির চরিত্রে কোয়েলকে দেখার পর এই ছবির দুঃসাহসিক দৃশ্যে অভিনয়ের ক্ষেত্রে তাঁকে অনেক বেশি সাবলীল লেগেছে। যদিও বেশ কয়েকটি অ্যাকশন দৃশ্য দেখলে কপালে ভাঁজের সৃষ্টি হতে বাধ্য। বিশাল এক খাদের ওপর থেকে ঝাঁপ দেওয়ার পর বা একটি বিপুল বিস্ফোরণের পরেও কারোর গায়ে কোনও আঘাতের চিহ্নমাত্র নেই। এটা কখনও সম্ভব?
আরও পড়ুন: ইচ্ছে পূরণের স্বপ্ন নিয়ে নতুন ছবি ঘোষণা করলেন সুমন মৈত্র
রুমির চরিত্রে অ্যাডোলীনার অভিনয় প্রশংসনীয়। একটিও সংলাপ ছাড়া শুধুমাত্র নির্লিপ্ত চাহনী দিয়ে নিজের অভিব্যক্তি খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়েছে সে। আল মাহরির চরিত্রের জন্য রজতাভ যথার্থ নির্বাচন (শুধুমাত্র তার সংলাপের ওরকম বিকৃত উচ্চারণ না ঘটালেও চলত)। হিরুদার চরিত্রে কৌশিক দুর্দান্ত। ছবির ভিএফএক্স অসাধারণ। হিন্দি বা অন্যান্য বিদেশী ছবির সঙ্গে পাল্লা দিতে সক্ষম সীমিত বাজেটে তৈরী এই ছবির ভিএফএক্স। বিশেষ করে সমুদ্রের তলায় লকেট খোঁজার দৃশ্য যে কোনও বিদেশী অ্যাডভেঞ্চার ছবির সঙ্গে তুলনা করা যায়। বিক্রম ঘোষের আবহ এই ছবির রহস্য ঘনীভুতকরণের যোগ্য সহায়ক।
গুপ্তধন খোঁজার গল্পে ধাঁধা বা হেঁয়ালির জট ছাড়ানো সব ছবির ক্ষেত্রেই বড্ড একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে। চিত্রনাট্যকারদের এবার বোধহয় ব্যতিক্রমী কিছু ভাবার সময় এসেছে। তবে যদি সম্পূর্ণ ছোটদের ছবি হিসাবে বিবেচনা করা হয় তাহলে এ সবকিছুই অগ্রাহ্য করা সম্ভব। সেদিক থেকে দেখতে গেলে ‘সাগরদ্বীপে যকের ধন’ ছোটদের নিরাশ করবে না।