ভাগ্য আর কর্মফল থেকে মুক্তির পথ খোঁজার থ্রিলার 

ছবি: সামসারা

দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ৫ মিনিট

পরিচালনা: সুদেষ্ণা রায়, অভিজিৎ গুহ

অভিনয়ে: ঋত্বিক চক্রবর্তী, রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্দ্রজিৎ চক্রবর্তী, সুদীপ্তা চক্রবর্তী, সমদর্শী দত্ত, দেবলীনা কুমার, তনুশ্রী চক্রবর্তী, অম্বরীশ ভট্টাচার্য, আর্যা বন্দ্যোপাধ্যায়

RBN রেটিং: ৩.৫/৫

ছবির নাম নিয়ে ধোঁয়াশা ছিলই। এ কেমন নাম? কী এর মানে? ছবির ট্রেলার বলছে গল্পটা একটা জার্নির, আর কিছু অদ্ভুত ঘটনার, যা চরিত্রদের সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়ায়। কাহিনীকার পদ্মনাভ দাশগুপ্ত ছবিটাকে একটা অন্য দুনিয়ায় গল্প বলে দাবী করেছিলেন। তাঁর মতে এমন একটা দুনিয়া রয়েছে, যেখানে আমরা স্বেচ্ছায় না গেলেও যাওয়ার আগ্রহ থাকে, কৌতূহল থাকে, নিজের অজান্তে একটা টানও থাকে। সেই দুনিয়াটাই হল ‘সামসারা’ বা সংসার, যেখানে ভাগ্য আর কর্মফল মুক্তির পথ খোঁজে। 




‘সামসারা’র জন্য এটুকু ভূমিকা না দিলেই নয় কারণ ছবির ক্লাইম্যাক্সে তার আসল সুর বাঁধা রয়েছে। তাই সেই ক্লাইম্যাক্স যেন কোথাও এতটুকু চিড় না খায়, সেটা খেয়াল রাখতেই হবে।

তবে সবার আগে বলা দরকার, বাংলায় ভালো থ্রিলার হয় না বলে কয়েক বছর আগেও যে হা-হুতাশ ছিল, ইদানিং প্রায় প্রতি সপ্তাহে সেরকম ছবির রিলিজ় হয়ত বাঙালির সেই পিপাসা মেটাতে পেরেছে। কিন্তু সত্যিকারের টান টান থ্রিলার আর কটা হয়! থ্রিলার মানেই যে গোয়েন্দা গল্প বা অ্যাডভেঞ্চার হতে হবে, তার কোনও মানে নেই। তাই সেদিক দিয়ে দেখলে ‘সামসারা’ সার্থক সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার হয়ে উঠেছে, এ কথা ছবি দেখতে বসে স্বীকার না করে উপায় নেই।

‘সামসারা’ বন্ধুত্বের ছবি। সেই বন্ধুত্বের মাঝে যেমন ভালোবাসা, ভরসা, বিশ্বাস আছে, তেমনই সন্দেহ, রাগ, বিরক্তিও আছে। এই সব নিয়েই তো বন্ধুত্ব তৈরি হয়। জীবনের নানান হতাশা—যাকে আমরা নাগরিক ভাষায় ফ্রাস্ট্রেশন বলি—তাকে তো বন্ধুর সামনেই ঝরিয়ে ফেলতে হয়। কখনও তা আড্ডা বা স্বীকারোক্তিতে, কখনও আবার কষ্টে কিংবা ভেঙে পড়ায়। সেই বন্ধুত্ব আর নির্ভরতার গল্প এই ছবির পাতায় পাতায়।

আরও পড়ুন: সংক্রামক নয় ভিটিলিগো, বোঝাবে সমুদ্র দাশগুপ্তর ছবি

মহেন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশনের তিন বন্ধু বিক্রম (ইন্দ্রজিৎ), অতনু (ঋত্বিক) ও চন্দনের (রাহুল) যোগাযোগ হয় বহু বছর পর। এতদিন পরে সকলেই আজ নিজের নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হলেও সমস্যা রয়েছে প্রত্যেকেরই। মুখে না বললেও সকলেই যে যার সমস্যায় জর্জরিত। কিন্তু তাতে বন্ধুত্বযাপন থেমে থাকে না। মধ্যরাতে কলকাতা শাসন, রাতভর আড্ডা আর বিয়ার খাওয়ার মধ্যেই উঠে আসে নানান সমস্যা, অসুবিধা, আতঙ্কের কথা। যে আতঙ্ক অতনুকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে প্রতিদিন। সে ধরেই নিয়েছে এর থেকে বেরোবার কোনও পথ নেই। এই সবকিছুকে সঙ্গে নিয়েই অতনু এক অদ্ভুত নির্লিপ্ত চরিত্র যে ভাগ্যের খেলায় আজ প্রায় খাদের কিনারে দাঁড়িয়েও বাজার থেকে মটন কিনে বাড়ি ফেরে। প্রতিদিনের চেনা বাঙালি চরিত্র।

অতনুর সমস্যায় তার দুই বন্ধু চিন্তিত হলেও তার আচার আচরণ আবার তাদেরই সন্দেহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এক নিরীহ লেখক কীভাবে যেন বাকি দুই বন্ধুর মনেও এক অনিশ্চয়তার বীজ পুঁতে দেয়। যে সমস্যাগুলোকে তারা এতদিন তেমন আমল দিচ্ছিল না, এখন সেগুলোও কেমন যেন প্রকট হয়ে ওঠে। ব্যবসায়ী চন্দন তার জীবনে প্রতিদিন যে আতঙ্কের সঙ্গে ঘর করে চলে, সেও অবশেষে তার থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে দৌড়োয় দেশের বাড়ি।

আর এক বন্ধু বিক্রম। তার জীবনে প্রাচুর্য আছে, দিলখোলা বন্ধুত্ব আছে, আর আছে এক অন্ধকার অতীত। যে অতীত তাড়া করে বেড়ায় ডিটেকটিভ অফিসার শরৎচন্দ্রের (অম্বরীশ) রূপ ধরে।

আরও পড়ুন: স্মরণে কিশোর, ২৭ বছর পর শহরে আসছেন লীনা

অবশেষে আসে সেই তারিখ। যে তারিখের জন্য অতনুকে সতর্ক করা হয়েছে বার বার। কিন্তু হঠাৎই তার হাতে আসে সমাধানের চাবি, সঙ্গে এক নতুন দুনিয়ায় মুক্তিলাভের আশা। যেখানে গেলে হয়ত উত্তর মিলবে সব ধোঁয়াশার। বেরিয়ে পড়ে তিন বন্ধু মুক্তির উদ্দেশ্যে, সামসারার উদ্দেশ্যে। পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় স্বয়ং পথই। কিন্তু মুক্তি মেলে কি? বলা নেই কওয়া নেই, একটা রিসর্ট এসে পড়ে। সেখানে গিয়ে দেখা হয় অনিন্দ্য (সমদর্শী) কিংবা সমরেশ কিংবা সেই ভয় দেখানো লোকটার সঙ্গে। সে আবার এক অমায়িক ট্যুর গাইড হয়ে অদ্ভুত সব জায়গা ঘুরিয়ে দেখায়। আলাপ হয় উপমার (সুদীপ্তা) সঙ্গে। কিন্তু উপমাকে হুবহু যেন কার মত দেখতে? উপমার আশ্চর্য রকমের ঠান্ডা আচরণ চন্দনকে পাগল করে তোলে। তারপর আসে বাসবদত্তা। কিন্তু এ তো রেশমী! কেন ও মিথ্যে পরিচয় দিচ্ছে ভেবে পায় না বিক্রম।

এই ভয়ানক গোলকধাঁধায় আটকে পড়ে দম বন্ধ হয়ে আসে তিন বন্ধুর। কী করবে এবার তারা? না, বলা যাবে না সে কথা। তাহলে মজাটাই মাটি। এ ছবির প্রায় প্রতি দৃশ্যে আছে চমকে দেওয়ার মত সিনেম্যাটিক মূহুর্ত যা প্রেক্ষাগৃহের অন্ধকারে বসে বার বার শিউরে উঠতে বাধ্য করে। তাই নিজের অভিজ্ঞতায় এই রোমাঞ্চ সঞ্চয় না করলে বোঝা যাবে না কিছুই।

ঘন্টা দুয়েকের ছবি জুড়ে এক অদ্ভুত অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টের সৃষ্টি করেছেন সুদেষ্ণা-অভিজিৎ। তবে তা কোথাও দুর্বোধ্য নয়। এই ছবির ন্যারেটিভ এতটাই শক্তিশালী যে এমন সাংঘাতিক একটা গল্পকেও কোথাও কখনও জটিল বা কঠিন মনে হয়নি। পদ্মনাভকে কুর্ণিশ। এমন নিটোল একটি মৌলিক সাসপেন্স থ্রিলার বাংলা ছবিতে প্রয়োজন ছিল খুব। 

আরও পড়ুন: যে জন থাকে মাঝখানে

আর যারা এই গল্পটাকে প্রাঞ্জল করতে সাহায্য করেছেন তাঁরা অবশ্যই ‘সামসারা’র শিল্পীরা। ঋত্বিক, সুদীপ্তা ও রাহুল প্রত্যাশামতই নিজেদের চরিত্রকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন। ভালো লেগেছে ইন্দ্রজিৎকেও। ইদানিং তাঁকে সেভাবে পাওয়া না গেলেও, এই ছবি সম্ভবত ইন্দ্রজিৎকে পাকাপাকিভাবে বড় পর্দায় স্থান করে দেবে। তনুশ্রী অভিজ্ঞ অভিনেত্রী। ছোট পরিসরে, আমন্ত্রিত চরিত্রে তাঁকে ভালো লাগে। সমদর্শীও বরাবরের মতই চরিত্রের চাহিদাপূরণে সক্ষম। এই চরিত্রের পর আরও নিয়মিতভাবে তাঁকে বাংলা ছবিতে দেখতে পাওয়া উচিত। ভালো লাগে অম্বরীশকেও। তাঁর চরিত্রে শ্লেষ ও ব্যঙ্গ বারবার ফুটে উঠলেও সবকিছুকে ছাপিয়ে যায় তাঁর কমিক টাইমিং। চরিত্র অনুযায়ী যথাযত দেবলীনা ও আর্যা।

ছবিতে আরও একজনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকার কথা স্বীকার করতেই হয়। তিনি নবারুণ বোস। থ্রিলার ছবিতে আবহ সঙ্গীত যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা আরও একবার প্রমাণ করলেন তিনি। এই ছবির আবহ অনেক সিনেম্যাটিক মূহুর্তকে আকর্ষণীয় করে তুলতে সাহায্য করেছে। একই সঙ্গে উল্লেখ্য চিত্রগ্রাহক রানা দাশগুপ্তর নামও। ছবির বেশ কিছু দৃশ্য, বিশেষ করে মেঘালয়ের লং শটগুলো মনে ছাপ রেখে যায়। 





বেশিরভাগ থ্রিলারেই গান একটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ‘সামসারা’ সেই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। পরিচালকদ্বয় অসীম সংযম দেখিয়েছেন সীমিত গান ব্যবহার করে। অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের সুরে রূপঙ্করের গাওয়া একটিমাত্র গান রয়েছে ছবিতে, সেটি গল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং শ্রুতিমধুর। জুবিন গর্গের সুরে তাঁরই গাওয়া অন্য গানটি ছবির টাইটেল কার্ডে ব্যবহৃত হয়েছে। একটাই হয়ত দুর্বলতা এই ছবির। প্রথাগত হুডানইট না হলেও ছবির শেষটা জেনে যাওয়ার পর হয়ত আর ফিরে দেখার সেই মজাটা থাকবে না। ক্লাইম্যাক্সের জন্য অপেক্ষাই এ ছবির মূল আকর্ষণ নিঃসন্দেহে।

একটি নিটোল বন্ধুত্ব ও জীবনের গল্প ‘সামসারা’, যা দর্শককে এক প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। বার বার মনে হয়, এমন কি আমার সঙ্গেও হতে পারে? এই ছবি অবশ্যই প্রেক্ষাগৃহের অন্ধকারে বসে দেখার। কেন না অন্ধকার ছাড়া নিজের মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ তো বড় একটা আসে না। 

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
1

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *