আড়াই ঘন্টায় ১৭ দিনের জীবন্ত ইতিহাস

ছবি: ৮৩

পরিচালনা: কবীর খান

অভিনয়ে: রণবীর সিং, বোমান ইরানি, দীপিকা পাড়ুকোন, নীনা গুপ্তা, জীভা, হার্ডি সান্ধু

দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ৪২ মিনিট

RBN রেটিং: ৪/৫

শুধুমাত্র রোমান হরফে লেখা দুটি সংখ্যা নয়, বহু ভারতীয়ের কাছে ‘৮৩’ একটা আবেগ। সেই আবেগ যা ভারতকে শুধুমাত্র একটি অভিজ্ঞ ক্রিকেটে খেলিয়ে দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল তাই নয়, আদায় করে এনেছিল সম্ভ্রমও। বিশ্বের তাবড় দলগুলোকে দাপটে হারানোর সম্ভ্রম। একই প্রতিযোগিতায় প্রবল পরাক্রমী ওয়েস্ট ইন্ডিজ়কে একবার নয়, দু’বার হারিয়ে ১৪ জন যোদ্ধা প্রমাণ করে দিয়েছিল অদম্য জেদ থাকলে কোনওকিছুই অসম্ভব নয়। তারপর রিও মিনহো ও গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল। ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে লোকগাথায় পরিণত হয়েছে ১৯৮৩ সালের জুন মাসের ১৭টি দিন। সেই ১৭ দিনের ঘটনাবলী আড়াই ঘন্টায় ছবির পর্দায় আনা মোটেই সহজ নয়। আর ঠিক সেটাই করে ফেললেন কবীর ও তাঁর দলবল। প্রতিটি অভিনেতা-অভিনেত্রী ও কলাকুশলীরা যা করে দেখালেন, তার বিকল্প হওয়া খুবই কঠিন।



ছবির চরিত্রগুলির ভূমিকা এমনভাবে সাজানো যে মনে হবে চোখের সামনে সত্যিই একটা গোটা ক্রিকেট ম্যাচ চলছে। ১৯৮৩-এর বিশ্বকাপের প্রত্যেকটি ম্যাচে প্রতিটি খেলোয়াড়ের কিছু না কিছু ব্যক্তিগত অবদান ছিল। প্রথম ম্যাচে ব্যাট হাতে যশপাল শর্মা, বল হাতে রবি শাস্ত্রীর শেষ উইকেট নেওয়া, দ্বিতীয় ম্যাচে সৈয়দ কিরমানির পাঁচটি ক্যাচ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের বিপক্ষে হেরে যাওয়া ম্যাচে মহিন্দর অমরনাথের ৮০ বা অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে হারা ম্যাচে কপিল দেবের একার ব্যাট ও বল হাতে লড়াই, এরকম নানা ছোটখাট ঘটনা এক একজন পৃথক নায়কের সৃষ্টি করেছিল। কপিল দলগত অধিনায়ক হলেও, ‘৮৩’তে সেইসব মুহূর্তে সেই চরিত্রগুলোই নায়ক।

প্রতিটি অভিনেতার অসম্ভব পরিশ্রমের ফল ফুটে উঠল পর্দায়। হার্ডি যখন নেটে বল করছেন তখন মদনলালের বোলিং অ্যাকশনের সঙ্গে অবিশ্বাস্য মিল। শাকিবের বোলিংয়ে জীবন্ত হয়ে উঠলেন মহিন্দর। একই কথা বলা চলে সাহিল খাট্টার, অ্যামি ভার্কের ক্ষেত্রেও।

আরও পড়ুন: নব্বইয়ের ‘সত্যান্বেষী’, বাদ পড়লেন ব্যোমকেশ

তথ্যনিষ্ঠ ছবি করেছেন কবীর। তবে কিছু দৃশ্য অতিনাটকীয় মনে হতে পারে। যেমন ১৭৫ করার দিনে লাঞ্চের সময় (তখন একদিনের আন্তর্জাতিক ১২০ ওভারের হতো ও মধ্যাহ্নভোজ ও চা পানের আলাদা বিরতি থাকত) ড্রেসিংরুমে দাঁড়িয়ে কপিলের একের পর এক গ্লাস জুস খেতে-খেতে ও প্রবল ক্রোধে মোটিভেশনাল স্পিচ দেওয়া বেশ বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। বস্তুত ওই সময়ে ড্রেসিংরুমে কপিলের ধারেকাছে কেউ ছিলেন না। শুধুমাত্র ঢাকা দেওয়া এক গ্লাস জল টেবিলে রেখে কপিলের সতীর্থরা তাঁর ক্রোধ থেকে নিজেদের বাঁচাতে সরে গিয়েছিলেন। তবু এটুকু বিচ্যুতি বোধহয় মেনে নেওয়াই যায়। তা না হলে একটা ছবি সিনেমা হয়ে ওঠে না।

গোটা ছবিতে ডিটেলিংয়ে অসম্ভব জোর দিয়েছেন পরিচালক। প্রতিটি ঘটনা খুঁটিয়ে দেখানো ছাড়াও, সেই সময়টাকে তুলে ধরার জন্য আসল স্থানে গিয়ে শুটিং করেছেন তিনি। ধরা পড়েছে টার্নব্রিজ ওয়েলসের সেই ছোট্ট মাঠ থেকে লর্ডসের লং রুম। এমনকি টার্নব্রিজের মাঠের পেছনে গোলাপি পাতার গাছগুলো পর্যন্ত ছবিতে রয়েছে। কপিলের ডান গালের তিলও রণবীরের গালে বর্তমান। তবে বাউন্ডারির বিলবোর্ডে রণবীরের সানগ্লাসের বিজ্ঞাপন না থাকলেই ভালো হতো। ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপে ওই কোম্পানি বিজ্ঞাপন দেয়নি যদিও সেই সংস্থা বেশ পুরোনো। সুনীল ভালসনের মতো ক্রিকেটার যিনি ১৪ জনের দলে থেকে একটি ম্যাচও খেলেননি—অল্পের জন্য অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে লিগের প্রথম ম্যাচ দলে স্থান পাননি—রয়েছেন তিনিও। রয়েছেন মদনলাল, কপিলদেব, শ্রীকান্ত, গাভাস্কারের স্ত্রী, এমনকি বলবিন্দর সান্ধুর বান্ধবীও।

আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি

গোটা ছবিতে তারকা রণবীরকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। তার বদলে ভীষণ বাস্তব হয়ে উঠলেন কপিলরূপী রণবীর। পাল্লা দিয়ে অভিনয় করলেন পিআর মান সিংয়ের চরিত্রে পঙ্কজ, শ্রীকান্তের ভূমিকায় জিভা ও শাকিব। গাভাস্কারের চরিত্রে তাহির রাজ ভাসিন অনবদ্য। ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের বিরুদ্ধে খেলতে নামলে ভারতীয়রা যে বেশি সমীহ দেখাতো, তা গাভাস্কারের মধ্যে কখনও ধরা পড়তো না। ঠিক সেটাই দারুণভাবে ফুটিয়ে তুললেন তাহির। পিতা লালার প্রতি মহিন্দরের ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধাও রয়েছে ছবিতে। প্রতিটি অভিনেতা মিশে গিয়েছেন নিজেদের অভিনীত চরিত্রে। এছাড়াও কপিলের হরিয়ানভি উচ্চারণ, শ্রীকান্তের তামিল মিশ্রিত হিন্দি ও ইংরেজি, রজার বিনির চোস্ত ইংরেজি, সান্ধুর পাঞ্জাবি, সন্দীপ পাতিলের ফ্ল্যামবয়ানসি বা মান সিংয়ের দোখনি উর্দু, ‘৮৩’তে সব কিছু সাংঘাতিকভাবে বাস্তব।




ছাপ রেখে গেল বেশ কিছু ছোট অথচ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রও। ম্যালকম মার্শালের ভূমিকায় তাঁরই পুত্র মালি মার্শাল অনবদ্য। দুজনের বোলিং অ্যাকশন অবিকল এক। ক্লাইভ লয়েডের ‘ফুটবলার ছেলে’ জেসন লয়েড এই ছবিতে তাঁর উচ্চতার জন্য হয়ে গেলেন জোয়েল গার্নার। শিবনারায়ণ চন্দ্রপলের ছেলে ত্যাগনারায়ন রয়েছেন ল্যারি গোমসের চরিত্রে। পিতা সন্দীপের ভূমিকায় তাঁরই ছেলে চিরাগ। আর পাইপ টানতে-টানতে লালা অমরনাথের ভূমিকায় অভিনয় করলেন বাস্তবের মহিন্দর। কয়েক সেকেন্ডের জন্য রয়েছেন বাস্তবের কপিলও। তাঁর স্ত্রীর ভূমিকায় দীপিকাকে ভালো লেগেছে।

আরও পড়ুন: নেপথ্যে গাইলেন জলি, স্টেজে দাঁড়িয়ে ঠোঁট মেলালেন রাহুল দেব বর্মণ

গোটা ছবি জুড়ে শুধুই ক্রিকেট। সেমিফাইনালে বব উইলিসকে বাউন্ডারি হাঁকানোর সময় মহিন্দর যশপালকে একটু ধরে খেলতে বলেছিলেন। যশপালের উত্তর, ও আমাকে মাদ্রাজ টেস্টে গালাগালি দিয়েছিল। তাই শুনে অমরনাথের প্রশ্ন, তুমি মাদ্রাজের বদলা ম্যানচেস্টারে নেবে? এহেন নানা খুঁটিনাটি গোটা ছবি জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে।  

সব ছবি কথায় ব্যখ্যা করা সম্ভব নয়। কিছু ছবি নিজে দেখে উপলব্ধি করতে হয়। ‘৮৩’ তাদের মধ্যে অন্যতম।



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
21

Sumit

Educator by profession. Now researching on history, cricket, and pop culture. Can't imagine a life without books. Music is his second skin. Collector of yesteryear songs. Sold on Salil Chowdhury and Mohd Rafi

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *