প্রাচীন ধ্যানধারণার আগল ভাঙার ইঙ্গিত
ছবি: ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি
পরিচালনা: অরিত্র মুখোপাধ্যায়
অভিনয়ে: ঋতাভরী চক্রবর্তী, সোমা চক্রবর্তী, সোহম মজুমদার, মানসী সিংহ, শুভাশিস মুখোপাধ্যায়, অম্বরীশ ভট্টাচার্য, সাহেব চট্টোপাধ্যায়
দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ৭ মিনিট
RBN রেটিং: ৩/৫
ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে সাম্য কথার অর্থ সমানাধিকার। কিন্তু কাদের? সাম্যবাদ বা কমিউনিজ়মের সংজ্ঞা অনুযায়ী তা কি শুধুই মালিকপক্ষ এবং শ্রমিকপক্ষের? আর নারী? তাদের বুঝি কোনও অধিকার নেই? এসব প্রাচীন ধ্যানধারণা এখন অতীত। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে নারী-পুরুষের মধ্যে এক শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া ছাড়া আর যে কোনও পার্থক্যই নেই, তা আবারও প্রমাণ করলো ‘ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি’।
প্রাচীন যুগে নারীদের যে অবমাননা, লাঞ্ছনা শুনে আসতে হয়েছে সে সব ‘তাসের দেশ’-এর চিঁড়েতনী, হরতনীদের এইবার আগল ভাঙার পালা। সেই কাজটা কিছুটা হলেও সহজ হয়ে যায় ২০১৯-এ শবরীমালা মন্দিরে ঋতুমতী নারীপ্রবেশের ফলে। অরিত্রর ছবির শবরী (ঋতাভরী) যেন সেই নতুন যৌবনের দূত। কলেজে সংস্কৃত সাহিত্যে অধ্যাপনার পাশাপাশি শবরী পৌরোহিত্য করে স্বইচ্ছায়, ভালোবেসে। শবরীর বাবা নৃসিংহবাবু (সাহেব) ছিলেন সুপন্ডিত ও পুরোহিত যিনি তাঁর মেয়েকে নিজে হাতে পুজোর সমস্ত কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে শিখিয়েছিলেন। তিনি এও শিখিয়েছিলেন পৌরোহিত্যের কাজে নারী-পুরুষের কোনও ভেদাভেদ হয় না। এমনকি বৈবাহিক আচারে কন্যাদানও অযৌক্তিক। মেয়ে তো কোনও পণ্য নয় যে তাকে দান করে দিতে হবে।
সেই শবরীর বিয়ে হয় এক গোঁড়া রক্ষণশীল পরিবারে। বাতাসিপুর গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান অমরাবতী দেবীর (সোমা) ছোট ছেলে বিক্রমাদিত্যের (সোহম) বউ হয়ে আসে শবরী। বিয়েতে কন্যাদান না হওয়া, বা পুজো করতে গিয়ে নারায়ণ শিলা স্পর্শ করায় শাশুড়ি, পিসিশাশুড়ি এবং তাদের কুলপুরোহিতের বিরাগভাজন হয় শবরী। তবু সে থামে না। শ্বশুরবাড়িতে লুকিয়ে সে নিত্য চালিয়ে যাচ্ছিল তার কাজ। তার এই মহিলা দলটির একটি মজার নামও দিয়েছিল সবাই, ‘গানবাজনা করা পুরোহিত’। বর্তমানে মেয়েরা গাড়ি চালাচ্ছে, শপিং মলে বা সর্বসমক্ষে সন্তানদের স্তন্যপান করাচ্ছে, পুজোয় নাচের তালে ঢাকও বাজাচ্ছে। কিন্তু মেয়েরা পুজো করছে এ যেন এক বৈপ্লবিক ব্যাপার। মন্দিরের কাজে মেয়েদের প্রধান পরিচয় তো হয় দেবদাসী নয়তো পুজোর জোগাড়ে। কিন্তু বিপ্লব তো বেশীদিন লুকোনো যায় না, ফলত অমরাবতী এবং বাড়ির অন্যান্যদের কাছে প্রকাশ পায় শবরীর পরিচয়।
আরও পড়ুন: ফাগুন লেগেছে বনে বনে
প্রথম ছবি হিসেবে বেশ অন্যরকম ভাবধারার পরিচয় দিলেন অরিত্র। ছবির উপস্থাপনা সুন্দর। ঋতাভরীর অভিনয় বেশ ভালো। তবে কয়েকটি দৃশ্যে তাঁকে আড়ষ্ট লেগেছে। সোহমের অভিনয় সাবলীল। স্ত্রীর সমস্ত কাজে তাকে সবসময় সমর্থন দিয়ে আসে বিক্রমাদিত্য। সব বিপদ, অপমান থেকে স্ত্রীকে পুরাণের রাজা বিক্রমাদিত্যের মতোই রক্ষা করে সে। তবে কিছু জায়গায় সোহমের সংলাপগুলো এতটাই জড়ানো যে বুঝতে বেশ বেগ পেতে হয়।
অভিনয়ে সোমা, মানসী, অম্বরীশ প্রত্যেকেই তাদের চেষ্টায় সফল। আলাদা করে বলতেই হয় সাহেবের স্বল্প সময়ের উপস্থিতি। তাঁর দৃপ্ত কণ্ঠে সংস্কৃত শ্লোকের উচ্চারণ প্রশংসাযোগ্য। ভালো সঙ্গত করলেন শুভাশিস। গোঁড়া ব্রাহ্মণ পুরোহিতের ক্রুর হিংসাত্মক অভিব্যক্তি তাঁর চোখেমুখে স্পষ্ট। তবে শবরীর সঙ্গে তার পৌরোহিত্য নিয়ে তরজাটা আরও একটু জমাটি হলে ভালো লাগত। অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গীত যথাযথ।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ‘ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি’ দেখার মতোই ছবি। অচলায়তনের নিয়ম বদলানোর জন্য সত্যিই পঞ্চকের দরকার। নিয়ম তো পরিবর্তনশীল। থেমে থাকলে চলবে কেন? সেই কথাটাই বোঝাতে চেয়েছেন অরিত্র। যেখানে দেবীদের ঋতুমতী অবস্থায় অম্বুবাচির পুজো হয়, সেখানে রজস্বলা নারীদের মন্দিরে ঢুকতে বাধা কিসের? এটা তো একটা সামান্য শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া মাত্র। এই সহজ সত্যটা মানতে সমস্যা কোথায়? ঋতুমতী হওয়া তো সুস্থতার পরিচয়। শবরী তো নারীবাদী সমাজের দাবি জানায়নি। সে শুধু চেয়েছে অসাম্যটুকু বাদ দিয়ে সাম্যটুকু থাকুক। এ চাওয়াতে তো কোনও অপরাধ নেই। তবে আজও এমন অনেকেই আছেন যাঁরা এই সমস্ত বস্তাপচা নিয়মকে প্রাধান্য দেন, লালন করেন। এই সংকীর্ণ মানসিকতার অযৌক্তিক নিয়মগুলোকে শুষে নিতে যে আরও কত স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্রয়োজন হবে, তা বোধহয় স্বয়ং ব্রহ্মাও জানেন না।