ইচ্ছে দুনিয়ার জানলা খুলে দিয়ে
ছবি: ইউনিকর্ন
পরিচালনা: তথাগত মুখোপাধ্যায়
অভিনয়ে: দেবলীনা দত্ত, চিরঞ্জিত চক্রবর্তী, রাজর্ষি দে, রানা বসু ঠাকুর, পূজা মৈত্র, শ্রীজয়ী ভট্টাচার্য
দৈর্ঘ্য: ৫৮ মিনিট
RBN রেটিং: ৪/৫
করোনাপূর্ব চৈত্রসেলের গড়িয়াহাট কিংবা হাতিবাগান। এপ্রিলের গরমে ঘেমেনেয়ে প্রায় যুদ্ধ করে বাস থেকে নেমে ফুটপাথের ভিড়ে ঢুকতে-ঢুকতে যখন কানে আসে সেলের বেডকভারের হাঁকডাক, ওদিকে চোখটা গিয়ে পড়ে কোনাকুনি শাড়ির দোকানে দামের ট্যাগে—বাড়ির বয়স্কদের জন্য কিনবেন ভাবছেন—এদিকে নিজের ছানাটি তখন গরমে হাঁসফাঁস করে আইসক্রিম খাওয়ার বায়না ধরে, ঠিক এই সময়ে মনটা যদি হুশ করে চলে যায় গোয়ার সমুদ্রতটে, বা ডুয়ার্সের কোনও পা ডোবানো নদীর পাথরের ওপর? প্যাচপ্যাচে গরম, ভিড়ের ঠেলাঠেলি, কানফাটানো চিৎকার, দিশেহারা অবস্থা, সব কেমন মিনিটের মধ্যে ভ্যানিশ হয়ে গিয়ে আচমকা একটা নিস্তব্ধ অবস্থা আর অপার শান্তি বিস্তার করে। খুলে যায় কোনও ইচ্ছে দুনিয়ার জানলা। কিন্তু সে তো কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার। আবার ফিরতেই হয় বাস্তবের রূঢ় জমিতে, ফেরা ছাড়া গতি নেই। তবু ওই কয়েক মুহূর্তের কল্পনা যে তৃপ্তি দেয় তার রেশ থেকে যায় বহুক্ষণ। এ কী এক ধরণের দিবাস্বপ্ন? নাকি একই মানুষের মধ্যে দু’রকম সত্ত্বা?
ঠিক এই প্রশ্নটা নিয়েই অপালা (দেবলীনা) গিয়েছিল মনোরোগ বিশেষজ্ঞর কাছে। পারিবারিক বন্ধু চিকিৎসক দিগম্বরকে (চিরঞ্জিত) সে তার অভিজ্ঞতা জানায়। তার অবস্থাটা অবশ্য আমাদের কল্পনার জগতের থেকে খানিকটা আলাদা। অপালার সঙ্গে যা বারবার হতে থাকে, তাকে ঠিক স্বপ্ন বলা যায় না। বরং এ যেন তার আর একটা সত্ত্বা, যার মধ্যে দিয়ে সে নিজেকে খুঁজে পায়। যে জীবনটা সে ভোর ছ’টা থেকে রাত বারোটা অবধি বাঁচে, সেটা যেন একটা ছদ্মজীবন। এমন নয় যে সেখানে সে শুধু অভিনয় করে। বরং ঘরে বাইরে হাজারটা লড়াই করেও সে বেঁচে থাকতে চায় এই সংসার নিয়েই।
সকলের সঙ্গে প্রতিদিনের রোজনামচা ভাগ করে নিয়ে আর পাঁচজনের মতোই অপালার দিন কেটে যাচ্ছিল। হঠাৎ একদিন আলমারির লুকোনো কোনও এক কোণ থেকে সে খুঁজে পায় তার দিদার দেওয়া নকশীকাঁথা। দিদার কথা অনুযায়ী এ কাঁথায় জাদু আছে। সেই কাঁথা হাতে আসার পর থেকেই অপালার চোখের সামনে একটা আলোর জগৎ খুলে যায়। সে যখন তখন বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়েও পাড়ি দিতে পারে অচেনা কোনও সমুদ্রের ধারে, কিংবা সটান একেবারে জলের তলায় মাছেদের রাজ্যে। কখনও বা চলে যায় কোনও অদেখা শহরের ফাঁকা রাস্তায়। কখনও হ্যামকে দোল খেতে-খেতে আদিবাসীদের নাচ দেখে। সেখানে তার পোশাক বদলে যায়, পাল্টে যায় হাঁটাচলাও। অপালা তখন পিছুটানহীন এক স্বাধীন সত্বা হয়ে ওঠে। প্রাণভরে বাঁচে সে ওই কয়েকটা মুহূর্ত। তারপর হয়ত হঠাৎ সে নিজেকে আবিষ্কার করে বাড়ির পিছনদিকে বা অন্য কোনও জায়গায়। ফিরতে হয় অপালাকে, হয়ত তার আপনজনের কথা ভেবেই। মন চাইলেও সে ওই ইচ্ছে দুনিয়ায় থেকে যেতে পারে না।
আরও পড়ুন: ‘সারেগামাপা’ বিতর্কে ইতিবাচক দিকও খুঁজে পাচ্ছেন রূপঙ্কর
অপালা জল ভালোবাসে, তাই তার এই ইচ্ছে উড়ান বা ডাক্তারের ভাষায় টেলিপোর্টেশন বারবার তাকে জলের কাছেই নিয়ে যায়। স্কুল কলেজে পড়ার সময় থেকে অপালা স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাইত, তার ইচ্ছে ছিল সারা পৃথিবী ঘোরার। প্রতিদিনের জীবনের লড়াইয়ের মাঝে পড়ে তার সেই স্বপ্নগুলো হারিয়ে যায়। পিষতে থাকে সংসারের জাঁতাকলে। অফিসে বসের লোলুপ দৃষ্টি আর বাড়িতে স্বামীর অবজ্ঞা ও ক্রমাগত চাকরি ছাড়ার চাপ দেওয়ার মাঝে পড়ে অপালা আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো মরতে-মরতে সাময়িকভাবে পালাবার পথটা খুঁজে পায়। তার একান্ত নিজস্ব আনন্দের জানলা, বারান্দা বা একটা গোটা আকাশ, সবাই যার ঠিকানা পায় না।
সাধারণ ডাক্তারী বিদ্যায় কয়েকটা নার্ভের ওষুধ দিয়ে কি স্বপ্ন দেখা বন্ধ করা যায়? কয়েক মুহূর্তের বেঁচে নেওয়াকে ঘুমের অতলে তলিয়ে যেতে দেবে কি অপালা? দিগম্বরের কেজো বাস্তববাদী বুদ্ধিতে যদিও এসব মেয়েলি সমস্যা, মানিয়ে নিতে না পারার অজুহাত। কাঁথার ছবিগুলো নিয়ে অপালা যা ভাবে সবই নাকি কাল্পনিক। তার স্মৃতি, অনুভূতি সবই নাকি এক ধরণের হ্যালুসিনেশন। তাই যদি হবে তাহলে অপালা সেদিন কোথায় হারিয়ে গেল? সে কি আর কখনও ফিরবে?
আরও পড়ুন: গার্হস্থ্য হিংসার শিকার, তবুও ঔজ্জ্বল্যে অম্লান
কল্পবিজ্ঞানকে আশ্রয় করে এক ধরণের জাদু বাস্তবতার ছবি ‘ইউনিকর্ন’। ছবির কাহিনী বেশ অন্যরকম হলেও কখনও একঘেয়ে লাগে না। বরং অপালার ইচ্ছে জগৎটাকে আরও বেশি করে দেখার ও জানার আগ্রহ শেষ অবধি দর্শককে টেনে রাখে।
এ ছবি দেবলীনার একার। অপালার চরিত্রের নানা দিক, তার স্বাধীনচেতা মনোভাব, বিভ্রান্তি, কষ্ট, আনন্দ সব মিলিয়ে ঈর্ষণীয় এক চরিত্রকে পর্দায় ফুটিয়ে তোলা যে কোনও দক্ষ অভিনেত্রীর পক্ষেই সোনায় সোহাগা সুযোগ। সেই সুযোগের পূর্ণমাত্রায় সদ্ব্যবহার করেছেন দেবলীনা। ছবিতে অপালা চরিত্র থেকে তাঁকে আলাদা করে ভাবা যাবে না। দেবলীনাকে এর আগে কোনও ছবিতে এভাবে ব্যবহার করা হয়নি। এই মুহূর্তে বাংলা ইন্ডাস্ট্রির সেরা চরিত্রাভিনেত্রীদের একজন হয়ে ওঠার ক্ষমতা দেবলীনা রাখেন, প্রমাণ করেছেন তিনি।
আরও পড়ুন: শেষ যাত্রায় ব্রাত্য, পথ হেঁটেছিলেন মাত্র কয়েকজন
বাংলা ছবির বিগত দিনের সুপারস্টার হয়েও অভিনয়ের দিক দিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে নিজেকে বারংবার প্রমাণিত করে চলেছেন চিরঞ্জিত। এখানেও তাঁর পরিমিত অভিনয় অপালার উড়ানকে যেন আরও স্পষ্ট করে তোলে। বিখ্যাত চিকিৎসক হয়েও অপালাকে বুঝতে না পারার অক্ষমতা তাঁর চোখেমুখে পরিষ্কার ফুটে ওঠে। তাই কিছু গতে বাঁধা মেডিক্যাল সমাধান ও তথাকথিত নীতিপুলিশি করতে বাধ্য হন তিনি। ভাবলেশহীন মুখে এক ব্যস্ত ডাক্তারের ভূমিকায় চিরঞ্জিত প্রশংসার দাবি রাখেন। এছাড়া রাজর্ষি, রানা ও অন্যান্যরাও যথাযথ।
সবশেষে বলতে হয় ছবির চিত্রগ্রহণ নিয়ে। তথাগতর ক্যামেরায় বিদেশের সমস্ত দৃশ্যই অনবদ্য। বারবার দেখেও যেন আশ মেটে না। এছাড়া শুভদীপ দের ক্যামেরাও প্রশংসনীয়। ছবির শুরুতে উত্তর কলকাতার ভগ্নপ্রায় বাড়ি, শিকড় ওঠা ছাদ, বন্ধ দরজায় তালা, অন্ধকার সিঁড়ির জানলা, চোরাকুঠুরির মতো গলিপথ এসব বাঙালি জীবনের অতীত ঐতিহ্যকে মনে করিয়ে দেয়।
ময়ূখ ভৌমিকের সঙ্গীত পরিচালনাকে এই ছবির প্রাণ বলা যায়। উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘সলিটারি রিপার’-এ সুরারোপ সত্যিই যেন অপালার নিজস্ব পৃথিবীতে দর্শককে পৌঁছে দেয়। প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যের সম্পাদনা ছবিটিকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে। ছবির গল্প ও চিত্রনাট্য দুই বিভাগেই কৃতিত্বের দাবি রাখেন পরিচালক। পেশাগতভাবে অভিনেতা হলেও পরিচালনাই সম্ভবত ভবিষ্যতে তাঁর সঠিক জায়গা হতে চলেছে।
বলা বাহুল্য, গতানুগতিক ধারার বাইরে হয়েও ‘ইউনিকর্ন’ দর্শক মননের এক অন্য স্তরে উত্তরণ ঘটাতে সফল হবে।