বিকজ় ইট’স দেয়ার!

ছবি: মিশন এভারেস্ট

পরিচালনা: দেবাদিত্য বন্দোপাধ্যায়

অভিনয়ে: চান্দ্রেয়ী ঘোষ, মেঘা চৌধুরী, দীপ শঙ্কর দে, শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়, গৌতম মুখোপাধ্যায়, অম্লান মজুমদার, রানা মিত্র, বিদিশা চৌধুরী, কৃষ্ণকিশোর মুখোপাধ্যায়

দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ৬ মিনিট

RBN রেটিং: ৩/৫

আজ থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে মাউন্ট এভারেস্ট অভিযানের পূর্বে বিখ্যাত পর্বতারোহী জর্জ ম্যালোরিকে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার হঠাৎ পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গে ওঠার ইচ্ছে হলো কেন? উত্তরে ম্যালোরি বলেছিলেন, বিকজ় ইট’স দেয়ার! অর্থাৎ আছে, তাই উঠছি। এর থেকে সহজ উত্তর বোধহয় আর হয় না। ম্যালোরির সেই অভিযান সফল হয়নি। তবু অক্সিজেন ছাড়া ২৬,৯৮০ ফুট পর্যন্ত উঠে রেকর্ড গড়েছিল তাঁর দল। এর ঠিক দু’বছর পর আবারও এভারেস্ট অভিযানে গিয়ে, একেবারে শেষ পর্যায়ে মৃত্যু হয় তাঁর। এডমন্ড হিলারি ও তেনজ়িং নোরগেরও আগে ম্যালোরি এভারেস্টের চূড়ায় পদার্পণ করেছিলেন কিনা, তা নিয়ে আজও গবেষণা চলছে।



বিকজ় ইট’স দেয়ার! এই তিনটি শব্দের টানেই প্রতিবছর বহু পেশাদার ও অপেশাদার পর্বতারোহী এভারেস্টের পথে পা বাড়ান। ১৯৯৬ সালের ভয়াবহ তুষারঝড় ও হিমবাহে ধ্বস নামার কারণে একাধিক অভিযাত্রীর মৃত্যুতে চূড়ান্ত অসফল হয়েছিল এভারেস্ট অভিযান। আমেরিকা ও নিউজ়িল্যান্ডের দুটি সংস্থার একাধিক যাত্রী, পেশাদার ও দক্ষ প্রশিক্ষক ও শেরপারা থাকা সত্ত্বেও সামিট সেরে ফিরতে পারেননি। শেষ মুহূর্তে মার্কিন সাংবাদিক জন ক্রাকার বিপদ সঙ্কেত দেখেও মুহূর্তের ভুলে ভেবেছিলেন সব ঠিক আছে। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তিনি। ততক্ষণে বিপদ যা ঘটার ঘটে গেছে।

সেই ঘটনাই দেবাদিত্য তুলে আনলেন ‘মিশন এভারেস্ট’-এ। পর্বতারোহী সৌমেন মুখার্জি সেবার অসাবধানতাবশত ঘুমিয়ে পড়েন। ফলত ব্যর্থ হয় অভিযান। একাধিক পর্বতারোহীর—এমনকি সামিটের দায়িত্বে থাকা রজত সেনেরও—মৃত্যু হয়। ১৯৯৬-এর সেই ঘটনা ছবির পর্দায় তুলে আনা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।

আরও পড়ুন: শেষ দৃশ্যে ভাঙা হোল্ডার, সত্যজিতের জয়জয়কার

এই ঘটনার সঙ্গে ছবিতে যোগ হয়েছে পর্বতারোহী সুনিতা হাজরা তথা ছবির সুছন্দা হাজরার গল্পও। মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ চাকুরে এক বধূ হলেও সুছন্দার চোখে ছিল এভারেস্টের শিখর ছুঁয়ে দেখার স্বপ্ন। যে কোনও দামে সেই স্বপ্নকে পেতে চেয়েছিল সে। স্বামীর সহায়তায় অবশেষে ২৩ লক্ষ টাকা যোগাড় করে অভিযানে বেরিয়ে পড়ে সুছন্দা। পর্বতারোহণের পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকার ফলে সাতজনের দলে সে অন্যতম অভিজ্ঞ ও নির্ভরযোগ্য অভিযাত্রী হয়ে ওঠে। দলের বেশিরভাগই ছিলেন অনভিজ্ঞ ও শখের অভিযাত্রী।

এভারেস্ট বা অন্যান্য দুর্গম পর্বতে বাণিজ্যিক অভিযানের ফলাফল কতটা ভয়াবহ সেই নিয়ে বহু বছর ধরেই বিতর্ক চলছে। অথচ পাহাড়ে চড়ার অদম্য আগ্রহ নিয়ে কয়েক লাখ টাকা সংগ্রহ করে প্রতি বছর ভিড় জমান এই অনভিজ্ঞ হুজুগে অভিযাত্রীর দল। ফলে যা হওয়ার তাই হয়। 

আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি

আপাতদৃষ্টিতে দেখতে খুব সাহসী ও নায়কোচিত কাজ হলেও সঠিকভাবে পর্বতারোহণের জন্য প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। বেস ক্যাম্প ছেড়ে ক্যাম্প এক, দুই, তিনে ক্রমশ ওঠার সময় প্রয়োজন হয় চরম শারীরিক সক্ষমতা, সাহস, প্রবল ঠান্ডায় যুঝতে পারার ক্ষমতা এবং সর্বোপরি মনের জোরের। ক্রমশ কমতে থাকে আশা। শুরুর দিনের মতো লড়াই করার ক্ষমতা আর থাকে না। রোদের তাপে মুখের চামড়া ঝলসে যায়, অক্সিজেনের অভাবে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে, কিছু ক্ষেত্রে মানসিক ভারসাম্যও নষ্ট হয়ে যায়। এই সবকিছু জেনেই পাহাড়ে ওঠার প্রস্তুতি নিতে হয়। আসলে নিষিদ্ধের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরকালীন। তাই হয়তো যেটা আর পাঁচজন ছুঁতে পারে না সেই শৃঙ্গকে জয় করার প্রবল ইচ্ছা ও প্রচন্ড জেদের বশবর্তী হয়ে প্রতি বছর বহু মানুষ ছুটে যান এভারেস্টে।



পাহাড়ের ডাক উপেক্ষা করতে না পেরে সুছন্দাদের দলের অনেকে এভাবেই ছুটে গিয়েছিল। রাজীবের নেতৃত্বে অভিযাত্রীর দলে নাম লিখিয়েছিল কমলেশ, কৌশিক, সুদেব, অভিনন্দন, পারমিতা, সুছন্দা ও আরও কয়েকজন। ওদিকে নিম্নচাপ তাড়া করে অভিযাত্রী দলকে। তার আগের দু’বছরে তুষারঝড়ে প্রাণ হারিয়েছেন অনেকেই। তাই ভয় ছিলই। রাজীবের অভিযাত্রী দল সামিট করে সুস্থ অবস্থায় ফিরতে পারবে কিনা, সকলে বেঁচে থাকবে কিনা, প্রবল তুষারপাতে সকলে নেমে আসতে পারবে কিনা, সেসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে ছবির পর্দায়।

গতানুগতিক ছবির ভিড়ে ‘মিশন এভারেস্ট’ এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। একই ধরনের বিষয়ের ওপর ছবি দেখে ক্লান্ত দর্শককে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করবে এই ছবি। বিশ্বাস করা যাবে বাংলাতেও এমন ছবি করা যায়। ভিন্নধর্মী ছবি নিয়ে পরিচালকদের সত্যিই এবার ভাবার সময় এসেছে। পুরো টিম নিয়ে যে দুর্গম জায়গায় গিয়ে এই ছবির শুটিং করা হয়েছে তার জন্য পরিচালককে কুর্নিশ। বাংলা ভাষায় এমন একটা ছবি ভাবতেও দুঃসাহসের প্রয়োজন হয়। আদিগন্ত বরফে ঢাকা উপত্যকায় চিত্রগ্রহণের কাজও প্রশংসনীয়। অভিনয়ে প্রত্যেকেই চরিত্রের প্রয়োজন পূরণ করেছেন। চান্দ্রেয়ীর অভিনয় নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। বরাবরের মতোই তিনি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছেন। এছাড়া মেঘা, দীপ এবং অন্যান্যদের অভিনয়ও যথাযথ। 

আরও পড়ুন: বেহিসেবী জীবনযাপন, আজ স্মৃতির অতলে সৌমিত্র

ছবির একমাত্র দুর্বলতা কিছু ক্ষেত্রে চড়া আবহ সঙ্গীত। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সংলাপ শোনা যায় না। ছবির শেষ পর্যায় আরও টানটান হতে পারতো, যা গানের ব্যবহারে খানিক গাম্ভীর্য হারিয়েছে। রূপম ইসলাম ও শানের গলায় ছবির গান শুনতে ভালো লাগে। 

তবে অভিনব বিষয় ও পর্বতারোহণের নানা খুঁটিনাটি বিষয়কে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখাবার জন্য এত ছবির ভিড়েও অন্যতম ব্যতিক্রমী ও সাহসী ছবি হয়ে থাকবে ‘মিশন এভারেস্ট’।




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *