পাছে লোকে কিছু ভাবে!

ছবি: এটা আমাদের গল্প

পরিচালনা: মানসী সিংহ

অভিনয়ে: অপরাজিতা আঢ্য, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, দেবদূত ঘোষ, খরাজ মুখোপাধ্যায়, কনীনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সোহাগ সেন, তারীন জাহান, আর্য দাশগুপ্ত, পূজা কর্মকার, তপতী মুনশী, জুঁই সরকার, যুধাজিত বন্দ্যোপাধ্যায়

দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ২ মিনিট

RBN রেটিং ★★★★★★☆☆☆☆

লোকে কী ভাববে! এ প্রশ্ন বাঙালির কিংবা সমগ্র ভারতীয় জীবনেই এক অমোঘ দুশ্চিন্তা। সব নতুন প্রচেষ্টার, ভালো বা খারাপলাগার, নতুন ভাবনার বা গতানুগতিকতার বাইরে অন্যরকম কিছু করার সামাজিক মাপকাঠি হলো ওই বাইরের লোকের ভাবনা। আমরা জীবনে অনেক কিছু ভেবে ফেলি যা হয়তো সময়ের থেকে এগিয়ে বা বৈপ্লবিক। হয়তো শুরুটা করতে পারলে সমাজ একটু হলেও পাল্টাত। কিন্তু পাল্টে যায় না। কারণ ওই এক প্রশ্ন, লোকে কী ভাববে? 



ছেলে, বউমা, নাতনি নিয়ে শ্রীতমার (অপরাজিতা) সংসার। যদিও এই সংসারে তিনি নিজেকে একটু একপাশে সরিয়েই রাখেন। বৌমার সঙ্গে বিশেষ সদ্ভাব নেই তার। বাড়িতে জোটে না প্রাণের আরামটুকু, তাই শ্রীতমা প্রতিদিন লাফিং ক্লাবে হাজিরা দেন একটু হাসির খোঁজে। সেখানেই মিঃ শর্মার (শাশ্বত) সঙ্গে পরিচয় হয়। শ্রীতমাকে একটু বেশিই পছন্দ  করেন এই পাঞ্জাবি ভদ্রলোক। ভাইয়ের স্ত্রী, ছেলে এবং নিজের পিসির সঙ্গে এক বাড়িতেই থাকেন অবিবাহিত এই প্রৌঢ়। মাত্র ক’দিনের মধ্যেই শ্রীতমাকে এতটাই ভালো লেগে যায় তাঁর যে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসেন। তারপর শুরু হয় আসল গল্প। 

২০২৪-এ দাঁড়িয়ে যে নিজেকে যতই আধুনিক বলুক না কেন, আসলে কিন্তু আধুনিকতা থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে বাস করে তথাকথিত আধুনিক সমাজের বেশিরভাগ মানুষ। সেটা আরও স্পষ্ট হয়ে যায় শতাব্দী প্রাচীন কোনও আচার অনুষ্ঠানে ধাক্কা লাগলে। সারাদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় ডুবে থাকা প্রজন্ম আসলে আজও চলে সেই বস্তাপচা পাড়া ও কলতলা কালচারকে সামনে রেখেই। সমাজ মেনে নেবে কিনা তার ওপর দাঁড়িয়ে কোনও ঘটনার বৈধতা বিচার করা হয়। মানবিকতা দিয়ে নয়, আন্তরিকতা দিয়ে নয়।

আরও পড়ুন: আবারও কানে ‘মন্থন’

সেই দিক দিয়ে মানসীর এই ছবি মজার মোড়কে হলেও খুব জরুরি এক বার্তা দেয়। সারাজীবন সংসারের জাঁতাকলে পিষে নিজের সমস্তটুকু দিয়ে একদিন যখন মানুষ একা হয়ে যায়, নীরব হয়ে যায়, তখন সেই বয়স্ক মানুষটিকে সঙ্গ দেওয়া বা তার ভালো থাকার জন্য অন্য কিছু ভাবার কথা তার আশপাশের সবাই ভুলে যায়। কেন পঞ্চাশ কিংবা পঞ্চান্নর গণ্ডি পেরোনো কোনও মানুষ সমাজের দেখানো পথেই হাঁটবেন? কেন তিনি নিজের জীবনে আনন্দ, সুখ, প্রেম, ভালোবাসা খুঁজে নিতে পারবেন না? প্রশ্ন রেখেছেন মানসী। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নিঃসন্দেহে। উত্তর পাওয়া গেল কি? 

ছবির ক্লাইম্যাক্স দর্শককে কিছুটা হলেও হতাশ করবে। যে বৈপ্লবিক বদল এবং সামাজিক বার্তা দেওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছিল ছবির কাহিনি, অযথাই তাতে রাশ টানার প্রয়োজন ছিল না। কিছু জায়গায় গল্প প্রত্যাশিত সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যায় অবশ্যম্ভাবীরূপে। সেই জায়গায় বাধাপ্রাপ্ত হলে ১০০ কিলোমিটার গতিতে চলা গাড়িকে হঠাৎ ব্রেক কষতে হয়, ফলে প্রচণ্ড প্রতিরোধে অবধারিতভাবে গাড়ির ক্ষতি হবেই। খুবই আবেগপ্রবণ হলেও ছবির শেষটা নিয়ে আরও একটু ভাবা যেত। এছাড়া বাস্তব সমাজের রক্তচক্ষু আরও কিছুটা কড়া হয়ে থাকে। এমনকী বয়স কম থাকলেও দ্বিতীয় বিয়ে করাকে আজও এই সমাজ খুব একটা ভালো মনে মেনে নেয় না। তাই চলার পথ আরও বন্ধুর, আরও কণ্টকময় হতেই পারত।

আরও পড়ুন: সত্যজিতের আরও দুটি ছবি সংরক্ষণের কাজ শুরু

মুখ্য শিল্পীদের অভিনয় এ ছবির বিরাট জোরের জায়গা। মিঃ শর্মার ভূমিকায় শাশ্বত (Saswata Chatterjee) নিজের চেনা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে চমকে দিয়েছেন প্রত্যাশিতভাবেই। চিরপরিচিত বাঙালি শাশ্বতকে খুঁজেই পাওয়া যায় না কোথাও। অপরাজিতাকে (Aparajita Adhya) ইদানিং যেমনভাবে দেখা যায় সেই ইমেজ ভেঙে তিনিও ব্যতিক্রমী। ধীর, স্থির, সংযমী ব্যক্তিত্বময়ী শ্রীতমা যেন নতুন কেউ। তবু প্রশ্ন থেকে যায়। যে বয়সের চরিত্রে অভিনয় করলেন দুই তুখোড় অভিনেতা, সেই বয়সের আশেপাশে যাঁরা এখন রয়েছেন, তেমন কোনও শিল্পীদের কি এই চরিত্রের জন্য নির্বাচন করা যেত না? চরিত্রের প্রয়োজন পূরণ করেছেন বাকি সকলেই। পাঞ্জাবি বউয়ের ভূমিকায় কনীনিকা ভারী মানানসই। আর অবশ্যই বড় চমক সোহাগ সেন। পাঞ্জাবি বুয়ার চরিত্রে তিনি পুরোটাই সারপ্রাইজ প্যাকেজ। প্রতিবার তাঁর চরিত্র পর্দায় আসা মানেই বিস্ময় ও মুগ্ধতা একইসঙ্গে আসে। এই চরিত্রে তাঁকে বেছে নেওয়ার জন্য মানসীকে ধন্যবাদ। ভবিষ্যতে প্রবীণ অভিনেত্রীর কাছে আরও নতুন চমকের আশা রইল। 



ছবির গানগুলি শুনতে ভালো লাগে। খরাজের কণ্ঠে এবং শাশ্বতর লিপে ‘সুইট সিক্সটিন’ গানটি মনে রাখার মতো। সম্ভবত এই প্রথম অন্য কোনও অভিনেতার জন্য প্লেব্যাক করলেন খরাজ। অভিনয়ের মতোই তাঁর কণ্ঠও অসম্ভব ভালো। এছাড়াও শ্রীকান্ত আচার্য এবং জয়তী চক্রবর্তীর আলাদাভাবে গাওয়া ‘তুমি একটু কেবল বসতে দিও কাছে’ রবীন্দ্রসঙ্গীতটি বড়ই শ্রুতিমধুর লাগে। 

চিত্রনাট্যের কিছু জায়গা দুর্বল। কয়েকটি জায়গায় নাটকীয়তা সেভাবে জমাট বাঁধে না। তবে ওই বাইরের লোকের ভাবনাকে দূরে সরিয়ে রেখে নিজের ভাবনাকে প্রাধান্য দিতে শেখায় শাশ্বত-অপরাজিতার গল্প। এখানেই দর্শককে মাত করার ক্ষমতা রাখে মানসীর প্রথম ছবি ‘এটা আমাদের গল্প’ (Eta Amader Golpo)। 




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
1

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *