বাণিজ্যিক ছবির রসদ নিয়েও শক্তি হারাল ‘তুফান’
ছবি: তুফান
পরিচালনা: রায়হান রফি
অভিনয়ে: শাকিব খান, মিমি চক্রবর্তী, মাসুমা রহমান নাবিলা, চঞ্চল চৌধুরী, ফজলুর রহমান বাবু, গাজী রাকায়েত, লোকনাথ দে, মিশা সওদাগর, সুমন আনোয়ার
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ২৫ মিনিট
RBN রেটিং ★★★★★★☆☆☆☆
বাংলাদেশের ছবি ‘হাওয়া’ এবং ‘সুড়ঙ্গ’ নিয়ে কলকাতায় যে পরিমাণ কৌতূহল ও উৎসাহ দেখা গিয়েছিল সেই সংখ্যক প্রেক্ষাগৃহে ছবি দুটি মুক্তি পায়নি। ফলে বহু দর্শক ইচ্ছে থাকলেও দেখতে পারেননি। সেদিক দিয়ে ‘তুফান’-এর প্রচার শুরু থেকেই ছিল অনেক বেশি। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনা হওয়ার কারণে ছবি নিয়ে আলোচনাও হয়েছে বহুদিন ধরে। কিন্তু কলকাতার প্রেক্ষাগৃহে বাংলাদেশের কাছাকাছিও কি ব্যবসা করতে পারল ‘তুফান’ (Toofan)? সপ্তাহের মাঝে মাল্টিপ্লেক্সে দর্শকের উপস্থিতি সে কথা বলছে না। এই প্রতিবেদককে নিয়ে মাত্র পাঁচজন দর্শক ছিলেন গতকাল সন্ধ্যার শোয়ে। ‘তুফান’ প্রত্যাশা পূরণ করতে পারল কি?
মা-বাপ মরা সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে শান্ত (শাকিব) পরোপকারী এবং ভালো মানুষ। সে বিখ্যাত নায়ক হওয়ার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও নেহাতই একজন জুনিয়র আর্টিস্ট হিসেবে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সে কাজ পায়। কস্টিউম ডিজ়াইনার জুলির (নাবিলা) সাহায্যে কয়েকটি ছবিতে কাজ করার সুযোগ পেলেও, ভাগ্যের ফেরে শান্তর কপাল খোলে না। এই সময় নায়িকা সূচনার (মিমি) চোখে পড়ে সে। সূচনা তাকে পৌঁছে দেয় বাংলাদেশের একচ্ছত্র অধিকারী মাফিয়া ডন তুফানের (দ্বৈত চরিত্রে শাকিব) কাছে। কারণ শান্ত এবং তুফানের চেহারায় রয়েছে হুবহু মিল। এরপর কীভাবে ও কেন শান্ত ধীরে-ধীরে তুফানের মতো হয়ে ওঠে সেই নিয়েই ছবির গল্প এগিয়ে যায়।
কাহিনিতে তেমন নতুনত্ব না থাকলেও অ্যাকশন দৃশ্যের নির্মাণ ভালো। বিরতির আগেই গল্প আন্দাজ করা যায়। ফলে আড়াই ঘণ্টার ছবি দেখতে বেশ একঘেয়ে লাগে। অ্যাকশন দৃশ্যগুলি ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে চিত্রনাট্যের দুর্বলতা স্পষ্ট। এমনকি শান্তর স্ট্রাগলের সময়ের অংশের নির্মাণ কমেডি নাকি ইমোশন সেটাও সঠিক বোঝা যায় না।
আরও পড়ুন: পিছিয়ে গেল তব্বু-অজয়ের ছবির মুক্তি
প্রথম অর্ধের চিত্রনাট্য এবং অভিনয় উভয়েই অত্যন্ত দুর্বল এবং বিশ্বাসযোগ্য নয়। একমাত্র দেখতে ভালো লাগে নাবিলাকে। তবে তার জায়গাও চিত্রনাট্যে খুব বেশি রাখা হয়নি। পরবর্তীতে গালিব বিন গনি বা তুফানের জীবন কাহিনি শুরু হলে ছবি কিছুটা জমে। তবু প্রথম দৃশ্যে যে ঘটনা শান্তর স্বপ্ন হিসেবে দেখানো হলো, পরে সেটাই তুফানের জীবনে ঘটেছে বলেও দেখা গেল। এর কোনও স্পষ্ট উত্তর ছবিতে মেলে না। তাছাড়া শান্তর মতো ছেলে কীভাবে ওরকম নৃশংস স্বপ্ন দেখতে পারে আবার সেই ঘটনা কীভাবে সত্যিই তুফানের সঙ্গে ঘটতে পারে, সে কথা ধোঁয়াশা হিসেবেই রেখে দিলেন পরিচালক।
ছবিতে যেভাবে মুড়িমুড়কির মতো ভায়োলেন্স এসেছে তা দেখতে কিছুটা অস্বস্তি হয়। শান্তর তুলনায় তুফানের ভূমিকাতেই শাকিবকে দেখতে বেশি সাবলীল লাগে। তুফানকে যারা ঘিরে রাখে সেই বশিরের ভূমিকায় মিশা, জালালউদ্দিনের চরিত্রে গাজী এবং আরিফিন হিসাবে ফজলুর, প্রত্যেকেই অভিজ্ঞ অভিনেতা। ছোট চরিত্রে হলেও তুফানের পরামর্শদাতা হিসেবে নিজের ছাপ রেখেছেন লোকনাথ।
আরও পড়ুন: সবাইকে টেক্কা দিলেন দীপিকা?
আলাদাভাবে যাঁর কথা না বললেই নয় তিনি অত্যন্ত অল্প পরিসরে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন নিজের চরিত্রকে প্রতিষ্ঠা করার। তিনি সহকারী পুলিশ কমিশনার আক্রমের ভূমিকায় চঞ্চল। কিন্তু এমন শক্তিশালী ও বুদ্ধিমান একটি চরিত্রকে তৈরিই হতে দেয় না চিত্রনাট্য। দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী তুফানের বিরুদ্ধে যাকে ঘুঁটি করে সমতা পার্টি খেলা সাজাচ্ছে, সেই আক্রম কে, কী, এবং কেন, তার কোনও ভূমিকাই ছবিতে রাখা হয়নি। চঞ্চল হঠাৎই এলেন ধূমকেতুর মতো। কিন্তু সংলাপ ছাড়া তাকে ভরসা করার মতো কোনও কারণ দর্শকও খুঁজে পাবে না যদিও সেই সময় তুফানের পতন ছাড়া আর দ্বিতীয় কিছু চাওয়ার নেই। আক্রম চরিত্রটিকে গড়ে তোলার কোনও ইচ্ছাই দেখাননি পরিচালক। অথচ আগামীদিনে তুফানের সঙ্গে যার সমানে-সমানে টক্কর হতে যাচ্ছে এবং গল্পের নিয়ম মেনে যার হাতে তুফানের বিনাশ লেখা রয়েছে, সেই চরিত্রটির প্রেক্ষিত এবং পারিপার্শ্বিক দেখানো জরুরি ছিল।
যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্বেও আগাগোড়া ‘তুফান’ একটি শাকিবময় ছবি হয়ে রয়ে গেল। অথচ আড়াই ঘণ্টা সময় ধরে সন্ত্রাসীর সঙ্গে পুলিশের লড়াই এবং ষড়যন্ত্রের এক চমৎকার খেলা জমে উঠতে পারত। এমনকী তুফানের মতো সাংঘাতিক এক দুষ্কৃতিকে এত সহজে ধরে ফেলা গেল, পুলিশকে কোনও কসরত করতেই হলো না, এটাও ছবির গতিকে কিছুটা থমকে দেয় যেন। যদিও ছবির ক্রেডিট সিনের মধ্যে দিয়ে সিক্যুয়েলের সম্ভাবনাকে জিইয়ে রাখা হয়েছে।
মিমির চরিত্রটির খুব বেশি কিছু করার না থাকলেও তিনি তাঁর মতো করেই চেষ্টা করেছেন ছবিতে জায়গা করে নেওয়ার। শাকিব তুফানের চরিত্রে সফল হলেও শান্ত চরিত্রে তাঁর আরও যত্ন নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। জুলির চরিত্রে নাবিলাকে খুব ভালো লাগে দেখতে। চঞ্চল বরাবরের মতোই অপ্রতিরোধ্য এবং ধারালো। তিনি না এলে ছবি জমে উঠত না।
আরও পড়ুন: জারি রইল সিংহাসনের লড়াই
বাংলাদেশে সফল হলেও, এপার বাংলায় ‘তুফান’ কতটা লগ্নি উদ্ধার করতে পারবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এই ফর্মুলার ছবি ভারতীয় দর্শক সেই আশির দশক থেকে দেখে আসছেন। শুধুমাত্র অ্যাকশন দৃশ্য দিয়ে আর যাই হোক এ দেশের প্রেক্ষাগৃহ ভরানো যাবে না।
মোটের ওপর আপাদমস্তক বাণিজ্যিক ছবি হিসেবে ‘তুফান’ দেখতে মন্দ লাগবে না। ছবির দুটো গান এপার বাংলাতেও যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছে। তবু সবরকম মালমশলা নিয়েও চিত্রনাট্যের দুর্বলতাকে ঢাকা যায়নি। তবে যারা অ্যাকশন ও বিনোদনভিত্তিক ছবি দেখতে ভালবাসেন তাদের হতাশ করবে না ছবিটি।