সমকালীন গ্রাম্য সমাজের কোলাজ

ছবি: ও অভাগী

পরিচালনা: অনির্বাণ চক্রবর্তী

অভিনয়ে: রফিয়াত রশিদ মিথিলা, সুব্রত দত্ত, দেবযানী চট্টোপাধ্যায়, ঈশান মজুমদার, সায়ন ঘোষ, জিনিয়া পান্ডে, কৃষ্ণ বন্দোপাধ্যায়, সৌরভ হালদার

দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট

RBN রেটিং ★★★★★★☆☆☆☆

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘অভাগীর স্বর্গ’ সে যুগের জাতপাতের ছুঁৎমার্গ এবং গ্রাম্যজীবনের সংকীর্ণতাকে চিনিয়ে দিয়েছিল। সেই কাহিনি অবলম্বনে অনির্বাণ তুলে ধরলেন সমকালীন গ্রাম্য সমাজের টুকরো ছবির এক বেদনাদায়ক কোলাজ। স্কুলজীবনে এ গল্প পড়েনি এমন বাঙালি গত শতকেও বিরল ছিল। অনির্বাণ সেই গল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছেন একাধারে হতদরিদ্র, বঞ্চিত এবং অত্যাচারী, শোষক সম্প্রদায়ের খণ্ডচিত্র। 



বিয়ের আগে গ্রামে যাত্রার মঞ্চে যমরাজকে (ঈশান) দেখে এবং তার কথা শুনে তাকেই জীবন উৎসর্গ করে অভাগী (মিথিলা)। সতীলক্ষ্মী স্ত্রী ছেলের হাতের আগুন পেয়ে যমরাজের সঙ্গে রথে করে স্বর্গে যায়, এই ধারণা তার মনে গেঁথে যায়। পরবর্তীতে রসিকের (সায়ন) সঙ্গে বিয়ে এবং ছেলে কাঙালির জন্মের পর অনেকদিন পার হয়ে গেলেও অভাগীর মনে মৃত্যুর সেই মহান চিত্রকল্প থেকে যায়।

রসিক বেশিদিন সংসার করেনি, সে ফুলে-ফুলে মধু খেয়ে বেড়াতে অভ্যস্ত। গ্রামের জমিদার (সুব্রত) একাধিক সন্তানের পিতা হয়েও অন্য মহিলাদের রেহাই দেন না। যদিও অভাগী এই সমস্ত ব্যাপার থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখে। তার মনের ভেতর শুধুই যমরাজ থেকে গেছে, যে অভাগীর অসহায়তার সঙ্গী হয়ে ওঠে। 

সমকালীন গ্রাম্য সমাজের

শহরের ছোঁয়া থেকে অনেক দূরে এক প্রত্যন্ত গ্রামের ছবি এঁকেছেন পরিচালক। তার জন্য প্রয়োজনীয় চিত্রগ্রহণ, কালারটোন, সংলাপ সবই ছবিতে এসেছে যথাযোগ্যভাবে। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায় অন্য জায়গায়। বাঙালি গ্রাম্যসমাজে যত নিচু জাতই হোক না কেন, এমন মুড়িমুড়কির মতো ব্যভিচার, তাও শুধুমাত্র টাকার জন্য, খুব চোখে লাগে। গল্পের প্রয়োজনে অভাগীর গ্রাম, তার সংসার, প্রতিবেশী সমস্ত কিছুকেই কল্পনায় গড়ে তুলেছেন পরিচালক। কিন্তু অভাগীকে সতী প্রমাণ করতে গিয়ে বাকি সব মহিলা কী সহজে অবাধ যৌনাচারী হয়ে উঠেছে দেখলে অবাক হতে হয়। এমনটা এতই সহজে এবং নির্বিঘ্নে হতে পারলে সাম্প্রতিককালে কলকাতার এত কাছে গ্রামের মহিলাদের ওপর দীর্ঘদিন ধরে যৌন অত্যাচার করা নিয়ে তুলকালাম ঘটে গেল কী করে? একজনকে সাদা প্রমাণ করতে বাকিদের অকারণেই কালো করে ফেলা হলো, যা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু এবং অবাস্তব দেখতে লাগে।

আরও পড়ুন: সত্যজিতের আরও দুটি ছবি সংরক্ষণের কাজ শুরু

এছাড়াও অভাগীর কাহিনি এবং পরিণতি স্কুলজীবনেই জানা এবং বোঝার মতো ছিল। শরৎচন্দ্রের কলমে সহজ সরল গল্পটি সমাজের ভেদাভেদকে চিনিয়ে দেয়। অথচ ছবিটি ভাষা এবং দৃশ্যের কারণে আর যাই হোক শিশু-কিশোরদের দেখার উপযুক্ত নয়। যমরাজের চিত্রকল্প ছবিতে আলাদা কোনও মাত্রা যোগ করে না। তবে গল্পের শেষাংশকে এক বিশ্বাসযোগ্য পরিণতির দিকে নিয়ে গিয়েছেন পরিচালক যার ফলে ছবিটি শুধুই হতাশা দিয়ে শেষ হয়নি।

অভাগীর চরিত্রে মিথিলার অভিনয় দেখতে ভালো লাগে। এছাড়া জমিদার চরিত্রে সুব্রত এবং রসিকের ভূমিকায় সায়নের অভিনয় মনে রাখার মতো। কমেডিয়ান হিসেবে পরিচিত হয়েও বিপরীতধর্মী চরিত্রে চমকে দিয়েছেন কৃষ্ণ। কাঙালি চরিত্রের কিশোর অভিনেতা প্রশংসার দাবি রাখেন। 



মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়ের সুরে ছবির গানগুলি শ্রুতিমধুর। রূপঙ্কর বাগচীর গলায় ‘ও লজ্জাবতী’ গানটি শুনতে বেশ লাগে। চন্দ্রানী বন্দোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘আমার মন মানে না’ ছবি শেষের পরেও মনে থেকে যাবে।

কথাসাহিত্যিকের বিখ্যাত ছোটগল্পের সমস্ত সম্ভাবনা এবং অণু-পরমাণু তথ্যকে একত্র করে সাহিত্যকে পর্দায় এঁকেছেন অনির্বাণ। সাম্প্রতিককালে এমন ছবি কমই হয়েছে। এক হতভাগ্য গ্রাম্য রমণীর মৃত্যু চিন্তাকে কেন্দ্র করে যে কাহিনির শুরু এবং শেষ, তাকে পর্দায় অন্যভাবে উপস্থাপন করেছেন পরিচালক, ফলে ছবিটি দেখতে বসে ক্লান্ত লাগে না। বরং অভিনেতাদের দক্ষতা গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যায় নিজস্ব গতিতে। 




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *