আদ্যোপান্ত ডার্ক, বাংলা ছবিতে ফিরল অ্যাকশন

ছবি: পারিয়া

পরিচালনা: তথাগত মুখোপাধ্যায়

অভিনয়ে: বিক্রম চট্টোপাধ্যায়, অঙ্গনা রায়, সৌম্য মুখোপাধ্যায়, অম্বরীশ ভট্টাচার্য, শ্রীলেখা মিত্র, লোকনাথ দে, দেবাশিস রায়, দেবপ্রসাদ হালদার

দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ১৮ মিনিট

RBN রেটিং ★★★★★★☆☆☆☆

সমাজে মানুষ যেমন নানা সমস্যার মুখে পড়ে, তেমনই জীবজন্তুর সমস্যাও কম নয়। হয়তো তা মানুষের থেকে বেশিই কারণ বাকশক্তিরহিত বলে নিজেদের সমস্যার কথা তারা ব্যক্ত করতে পারে না। এই অবলা জীবদের মধ্যে সবথেকে বেশি বিপদ কুকুরের—অন্তত শহরে—বিশেষ করে রাস্তাঘাটই যাদের ঘরবাড়ি। আজকাল অনেকেই তাদের সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করেন বটে। তবু বেশিরভাগ মানুষের কাছে তারা আজও বিরক্তির উপাদান। তাদের বিরুদ্ধে ঘটে চলা অন্যায়ের প্রতিবাদ করারও কেউ নেই। মানুষের কাছে তারা যেন অনেকটাই অস্তিত্বহীন। কিছু বছর আগে কুখ্যাত ভাগাড়কাণ্ড সংক্রান্ত তদন্তে জানা যায় সে একসময় কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় যথেচ্ছভাবে সারমেয় হত্যা করা হয়েছিল। সেই মাংস যেত শহরের বিভিন্ন ফুটপাথের হোটেলে এমনকী অভিজাত রেস্তোরাঁতেও। সারমেয়কুলের ওপর হয়ে চলা এমন অত্যাচারকে বিষয় করেই মুক্তি পেয়েছে তথাগত মুখোপাধ্যায়ের (Tathagata Mukherjee) ছবি ‘পারিয়া’ (Pariah)।



ছবির নায়ক বিক্রম (Vikram Chatterjee)। তবে ছবিতে তাঁর কোনও নাম নেই। বিক্রম একটি কারখানায় কাজ করে এবং একা থাকে। কিছু আচরণ দেখলে বোঝা যায়, তার একটি অন্ধকার অতীত রয়েছে। কারখানায় বিক্রমের সহকর্মী লাট্টু (দেবাশিস)। লাট্টু তার সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়ে প্রায় প্রতিদিনই নায়কের বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠে। বিক্রম রাতের খাওয়া সারে স্থানীয় শান্তির হোটেলে। সেই হোটেলের বৃদ্ধা মালকিন পাড়ার কুকুরগুলির দেখাশোনা করে বলে বখাটে ছেলেদের কাছে সে ‘কুত্তাবুড়ি’ নামেই পরিচিত। প্রোমোটার রমেশের (লোকনাথ) লোকজন এসে তাকে দোকান তুলে দেওয়ার হুমকি দেয়।

আরও পড়ুন: ৪০ বছর পর পরিচালনায় ফিরছেন বিশ্বজিৎ

এরই মাঝে বিক্রমের আলাপ হয় সেই দোকানেরই একটি ছোট্ট কুকুরছানার সঙ্গে। হুমকি দিয়ে যাওয়ার পরের দিন পথকুকুরদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করাতে বেসরকারি সংস্থা কেয়ার অ্যান্ড কিওরের মালিক সংঘমিত্রা (শ্রীলেখা) আসে তার দুই সহকর্মীকে নিয়ে। তাদের মধ্যে কমলিনী (অঙ্গনা) সবে কাজ শিখছে। রমেশের হুমকির বিরুদ্ধে থানায় গিয়েও বিশেষ সুরাহা হয় না। সংঘমিত্রা গোটা ঘটনা সারমেয়প্রেমী প্রভাবশালী উকিল এম শর্মাকে (অম্বরীশ) জানায়। এইসব নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিক্রম ক্রমে এক জঘন্য চক্রব্যূহে প্রবেশ করে।

আরও পড়ুন: কী বলবে সেন্সর? জানেন না রাজর্ষি

টানটান ছবি ‘পারিয়া’। এ জন্য সম্পাদক আমির মণ্ডলের ধন্যবাদ প্রাপ্য। পথকুকুরদের মাংস নিয়ে ব্যবসার পাশাপাশি উঠে আসে প্রাণী সুরক্ষার ব্যাপারে পুলিশ-প্রশাসনের অনীহা, অর্থলোভী ব্রিডার, পোষ্য রেখে তার যত্ন না নেওয়া অহঙ্কারী পরিবার ও আরও একাধিক সমস্যা। ছবির বেশিরভাগ চরিত্রই ধূসর। তবে তাদের দর্শন বেশ কিছু ক্ষেত্রে পরিষ্কার।

খলনায়কের চরিত্রে সৌম্য (Soumya Mukherjee) এ ছবির প্রাণ। সংলাপ শোনারও প্রয়োজন হয় না, তাঁর চোখের দিকে তাকালেই শিউরে উঠতে হয়। তিনি পর্দায় এলে সব আকর্ষণ নিজের দিকে টেন নেন। ছবির দ্বিতীয় প্রাপ্তি অবশ্যই অঙ্গনা। এক আদ্যোপান্ত ডার্ক ছবিতে এক সরল ও মায়াময় চরিত্রে অঙ্গনা যেন নির্মল বাতাস বয়ে আনেন। শ্রীলেখা এবং অম্বরীশ তাঁদের চরিত্রে যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য।

আরও পড়ুন: শেষ দৌড়ে সত্যিই পড়ে গেছিল বব বিশ্বাস, জানালেন শাশ্বত

বিক্রমের জন্য খুব বেশি সংলাপ বরাদ্দ ছিল না। শুধু শরীরীভাষা দিয়ে অভিনয় করে গেলেন তিনি। তাঁর অভিনীত চরিত্রটি ছবির পরবর্তী ভাগে আরও বিস্তার পাবে, সে ইঙ্গিতও বুঝিয়ে দিলেন তিনি। এছাড়া লোকনাথ, দেবাশিস এবং অহঙ্কারী বাড়ির মালিকের ভূমিকায় দেবপ্রসাদ যথাযথ।

চিত্রনাট্য মোটের ওপর নির্মেদ। তবে কিছু অ্যাকশন দৃশ্যে মার্কিনি ছবির প্রভাব রয়েছে বোঝা যায়। ছবির প্রায় শেষে চাদ স্টাহলস্কির ‘জন উইক’-এর সরাসরি প্রভাবও রয়েছে। এমনকী এক চরিত্রের মুখের সংলাপও সেই ছবি থেকে প্রত্যক্ষভাবে অনুপ্রাণিত বলে মনে হয়। ছবি দেখার সময় এমন কিছু মনে না হলেও, শেষের দিকে এসে তাড়াহুড়ো করে সুতো গোটানো বেশ দৃষ্টিকটু লাগে।



উত্তরণ দে’র চিত্রগ্রহণ দুর্দান্ত। ক্যামেরার মাধ্যমে ডার্ক ছবির আবহ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তিনি, বিশেষ করে রাতের অ্যাকশন দৃশ্যগুলিতে। তবে নৃশংসতা পর্দায় আনা হয়েছে অত্যন্ত পরিমিতভাবে। কিন্তু তার মাত্রা বৃদ্ধি করেছে নেপথ্যসঙ্গীত। রণজয় ভট্টাচার্যের সুর বেশ কিছু ক্ষেত্রে গায়ে কাঁটা দেয়। পাশাপাশি ছবির বিভিন্ন অংশে সুরপ্রয়োগ যথাযথ।

আজকাল বাংলায় অ্যাকশনধর্মী ছবি হয় না বললেই চলে। তাই ‘পারিয়া’কে ব্যতিক্রমী বলাই যায়। পাশাপাশি এ ছবিতে উঠে এসেছে পথকুকুরদের প্রতি সমাজের একাংশের প্রবল ঘৃণা। উপাদান দুটি ভালোই মিশিয়েছেন তথাগত। এ ছবি পশুপ্রেম জাগ্রত করবে কিনা জানা নেই। তবে ইদানিংকালে যেখানে বেশিরভাগ বাংলা ছবি থ্রিলার-গোয়েন্দা-পরকীয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, সেখানে অন্তত বিষয় নির্বাচনের দিক থেকে ‘পারিয়া’ ভিন্নধর্মী তো বটেই।   




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Diptajit

An avid reader and a passionate writer of crime fiction. Poems and verses are his second calling. Diptajit is the editor of a Bengali magazine. Nothing makes him weaker than books, films and food

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *