মেরি-গো-রাউন্ডে ফেলুদা, বিভ্রান্ত দর্শক

বইয়ের ফেলুদা। সিনেমার ফেলুদা। টেলিভিশনের ফেলুদা। নাটকের ফেলুদা। রেডিওর ফেলুদা। সিরিজ়ের ফেলুদা। এবং আবারও সিরিজ়ের ফেলুদা। অর্থাৎ বাড়তে-বাড়তে এক থেকে একাধিক হয়ে এখন প্রায় যত্রতত্র ফেলুদার দেখা মিলছে। প্রায় যতগুলো মাধ্যম, ততজনে এসে দাঁড়িয়েছে সত্যজিৎ রায়ের গোয়েন্দা চরিত্র প্রদোষচন্দ্র মিত্র ওরফে ফেলুদার সংখ্যা। কয়েকদিন আগে খবর পাওয়া গেল পরিচালক অরিন্দম শীলও ফেলুদাকে নিয়ে ওয়েব সিরিজ় বানাবেন। এই সিরিজ়ে ফেলুর ভূমিকায় থাকবেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। গল্প সম্ভবত ‘গ্যাংটকে গন্ডগোল’।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে শুরু। তারপর একে-একে বড়পর্দায় ফেলুদার চরিত্রে অভিনয় করেছেন সব্যসাচী চক্রবর্তী, আবীর চট্টোপাধ্যায় আর এখন ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত। ছবি, টেলিভিশন ধারাবাহিক ও রেডিও মিলিয়ে ফেলুর চরিত্রে সৌমিত্র অভিনয় করলেও সবথেকে বেশিবার এই ভূমিকায় পাওয়া গেছে সব্যসাচীকে। মাঝখানে অবশ্য শশী কাপুর ও রাহুল বসুও ছিলেন।

এ পর্যন্ত মোটামুটি ঠিকঠাক চলছিল, শশীকে যদিও চূড়ান্ত বেমানান লেগেছিল ফেলুর চরিত্রে। ইন্দ্রনীলের ‘হত্যাপুরী’ এখনও মুক্তির অপেক্ষায়। তবে ‘হাজার হাজার হাজরা’র মতো ফেলু চরিত্রে একের পর এক অভিনেতার আসা শুরু হয়েছিল দেশে ব্রডব্যান্ড পরিষেবার ব্যান্ডউইড্‌থ বাড়া ও সস্তার চিনা অ্যান্ড্রয়েড ফোন বাজার ছেয়ে ফেলার পর। এর ফলে ওয়েব সিরিজ় নামক একটি নতুন মাধ্যমের আগমন হলো। সত্যজিৎপুত্র সন্দীপ রায়ও অকাতরে বিলিয়ে গেলেন বিভিন্ন ফেলুকাহিনীর ওয়েব সিরিজ় স্বত্ত্ব।

আরও পড়ুন: গোয়েন্দার ভূমিকায় অরুণিমা, হলো ছবির মহরত

এবার শুরু হলো বাঙালির অন্যতম প্রিয় গোয়েন্দা চরিত্রকে নিয়ে মেরি-গো-রাউন্ড। বাংলাদেশের এক সংস্থার প্রযোজনায় পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় নিজের পরিচালনাতেই ফেলুর ভূমিকায় অভিনয় করে ফেললেন। আবার ২০১৯-এ তৌকির আহমেদের পরিচালনায় আহমেদ রুবেলকে দেখা গেল ফেলুর চরিত্রে। তবে যেহেতু সেই সিরিজ়গুলো এ দেশের নয় এবং এখানে সেভাবে প্রচারও করা হয়নি, তাই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যাপারটাকে ততটা গুরুত্ব দিল না।

২০২০ সালে অনলাইন ভোটিংয়ের মাধ্যমে সৃজিত মুখোপাধ্যায় ফেলু হিসেবে টোটা রায়চৌধুরীকে নিয়ে এলেন। এদিকে জ্ঞানে, গুণে ও বিচক্ষণতায় সোশ্যাল মিডিয়ায় উপস্থিত প্রতিটি দর্শকই এক একজন স্বঘোষিত ফেলু বিশেষজ্ঞ। তাই সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় হয়ে গেল, সৌজন্যে টোটাবিরোধী দর্শক বনাম তাঁকে ‘টিনটোরেটোর যীশু’তে রাজশেখর নিয়োগীর চরিত্রে দেখে মনে-মনে আগামী ফেলুদা ভেবে রাখা ভক্তের দল। ফেলুরূপী টোটা এলেন ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’ ও ‘দার্জিলিং জমজমাট’-এ।

আরও পড়ুন: চাইলেই করা যাবে না ছবি, ₹২৫ লাখে বিক্রি উত্তম-স্বত্ব?

এরই মাঝে সন্দীপ ‘হত্যাপুরী’র ঘোষণা করলেন, কারণ ‘ডবল ফেলুদা’র পর বড়পর্দায় আর প্রদোষ মিত্রের দর্শন পাওয়া যায়নি। ইন্দ্রনীলের নাম ঘোষণা হওয়ামাত্র, তাঁর উচ্চতা কম বলে দর্শকের একাংশ ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফেলুর উচ্চতা নিয়ে বাঙালির নাকের উচ্চতাও বরাবরই খুব বেশি। কম উচ্চতার কারণে একাধিক বাঘা-বাঘা অভিনেতার নাম সম্ভাব্য ফেলু হিসেবে উঠে এলেও, বাঙালি তাঁদের খারিজ করে দিয়েছে। তবু ইন্দ্রনীল ভালো অভিনেতা এবং সন্দীপের পছন্দ বলেই সম্ভবত একটা বড় অংশের দর্শক তাঁকে মেনে নিয়ে চুপ করে গেলেন।

সমস্যা বাড়ল জটায়ু চরিত্রের অভিনেতাকে নিয়ে। বিভু ভট্টাচার্য মারা যাওয়ার পর সন্দীপ জটায়ুকে বাদ দিয়েই ‘ডবল ফেলুদা’ করেছিলেন। তবে জটায়ু ছাড়া বড়গল্প তেমন নেই। তাই জটায়ু খুঁজতেই হতো। সেই চরিত্রে অভিজিৎ গুহকে নির্বাচন করলেন সন্দীপ। বেঁকে বসল প্রযোজনা সংস্থা। উল্লেখ্য, এই সংস্থাই ‘দার্জিলিং জমজমাট’ প্রযোজনার দায়িত্বে ছিল। তাঁদের দাবি, বড়পর্দায় ও সিরিজ়ে ফেলু-তোপসে-জটায়ুর চরিত্রে ‘দার্জিলিং জমজমাট’-এর অভিনেতারা থাকলে দর্শকের মনে বিভ্রান্তি হবে না। ইতিমধ্যে ‘যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে’-এর ডিজিট্যাল সম্প্রচার স্বত্ত্বও এই সংস্থার হাতে চলে এসেছে। তবু নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন সন্দীপ। ফেলুকাহিনীর অন্যান্য সব ধরণের স্বত্ত্ব বিক্রি করে দিলেও বড়পর্দায় ফেলুকে নিয়ে ছবি বানানোর অধিকার তিনি নিজের কাছেই রেখেছিলেন। ফেলুদাকে নিয়ে ছবি করতে গেলে প্রযোজকের অভাব হয় না। হলোও না। এগিয়ে এল অন্য সংস্থা।

আরও পড়ুন: নীলাচলে রহস্য খুঁজছেন অঞ্জন, যেতে পারেন জঙ্গলেও

‘হত্যাপুরী’র ভবিষ্যত কেমন হবে তা সময় বলবে। তবে এর মধ্যে আবারও এক ফেলু সিরিজে়র ঘোষণা বহু ফেলুভক্তকে যেমন বিচলিত করেছে তেমনই দর্শকের একাংশ এ নিয়ে মন্তব্য করারও প্রয়োজন বোধ করছেন না। এর একটা কারণ এই যে পরমব্রতকে এর আগে ফেলুরূপে দেখা গেলেও, এপার বাংলার দর্শক তাঁকে মন থেকে গ্রহণ করেনি। ভালো অভিনেতা হওয়া আর ফেলুর ভূমিকায় মানিয়ে যাওয়া এই দুটি শর্ত যে একেবারেই পরস্পরের পরিপূরক নয় সে কথা ফেলুভক্তদের চেয়ে বেশি বোধহয় আর কেউ জানে না। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে বলা যায়, তপেশের ভূমিকায় পরমব্রত একসময় দর্শকদের মন জয় করেছিলেন। কাজেই তাঁকে ফেলু হিসেবে অনেকেই মেনে নিতে নারাজ।



আর একটু ভাবলে একটা সম্ভাব্য তৃতীয় কারণও বার করা যায়, এবং সেটাই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত ফেলুচর্চা কোথাও যেন দর্শকের উৎসাহে ভাটার টান এনে দিচ্ছে। একটার পর একটা ফেলু চিত্রায়ন দেখতে-দেখতে দর্শক এখন ক্লান্ত। জনপ্রিয় চরিত্রে অভিনেতা বদল কোনও নতুন ঘটনা নয়। সেই নিয়ে দর্শকের মধ্যে উন্মাদনা থাকাও স্বাভাবিক। যেমন শার্লক হোমসকে নিয়ে একাধিক অভিনেতা ছবি বা টেলিভিশনে অভিনয় করেছেন। তাঁদের কাউকে দর্শক গ্রহণ করেছেন, কাউকে করেননি। কিন্তু একই সময়ে এক চরিত্রে তিনজন অভিনেতার কাজ করা বিরল তো বটেই, কিছুটা হাস্যকরও। এমনটা আর কোথাও হয়েছে বলে জানা নেই। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃষ্টি ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়ে কয়েক বছর আগে একই রকম জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিল, যেখানে তিনজন পরিচালক আলাদাভাবে ও ভিন্ন মাধ্যমে ছবি ও সিরিজ় তৈরি করেছিলেন। এমনকি অঞ্জন দত্ত ব্যোমকেশের কাহিনী নিয়ে একই নামে দুটি ভিন্ন ছবি পরিচালনা করেন, ‘ব্যোমকেশ বক্সী’ (২০১০) ও ‘ব্যোমকেশ বক্সী’ (২০১৫)। দুটি ছবির নামভূমিকায় ছিলেন যথাক্রমে আবীর ও যীশু সেনগুপ্ত। বড়পর্দা ও ওয়েব সিরিজ় মিলিয়ে ব্যোমকেশের এই ওভারডোজ়ে যা হওয়ার তাই হলো। চরিত্রটি নিয়ে আগ্রহে টান পড়ল। এখন ব্যোমকেশের ছবি হোক বা সিরিজ়, কোনওটাই আর দর্শকের মধ্যে তেমন সাড়া ফেলে না।

আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি

অর্থাৎ ছবি করতে গিয়ে মৌলিক গল্প নয়, সফল গোয়েন্দাসাহিত্য থেকে টালিগঞ্জ বেরোতে পারছে না। একই বৃত্তে থেকে শুধু ফেলুদা আর ব্যোমকেশের ছবি দর্শক আর কতদিন দেখবেন সেটা নিয়ে নির্মাতারা ভাবছেন কি?

ওয়েব সিরিজ়ে ফেলুকাহিনী নিয়ে আইনী জটিলতা শুরু হয়েছিল সেপ্টেম্বরে। হঠাৎই আদালতের বাইরে সমঝোতা হয়েছে দুই প্রযোজনা সংস্থার। তবে এর ফল হিসেবে কী ঘটতে চলেছে তা এখনও স্পষ্ট নয়। ‘হত্যাপুরী’ মুক্তি পাবে ডিসেম্বরে। একই সময়ে যদি অরিন্দম পরিচালিত সিরিজ়টিও মুক্তি পায় তাহলে যে দুজন অভিনেতা নিজেদের ভাগ্য যাচাই করতে আসছেন, তাঁদের জন্য তেমন ভালো হবে না। আর এর মধ্যে যদি ‘যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে’-এর সম্প্রচারও শুরু হয়ে যায়, তাহলে তো কথাই নেই। সে ক্ষেত্রে তিন অভিনেতার চেয়েও বেশি বিপদে পড়বে খোদ ফেলুদাই।



বাঙালি আবেগপ্রবণ। কিছু বিষয় নিয়ে সেই আবেগ এমন জায়গায় পৌঁছয় যেখানে যুক্তি-বুদ্ধির পৌঁছনোর ক্ষমতা থাকে না। প্রতিবার ফেলু চরিত্রে অভিনেতা নির্বাচন নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় বয়ে যায়। তার কারণ ফেলু চরিত্রের জনপ্রিয়তা এতটাই যে প্রত্যেক ফেলুভক্ত নিজের পছন্দের অভিনেতাকে সেই আসনে বসাতে চান। এই চাপ যে পরিচালক ও অভিনেতাদের ওপরেও কতটা পরিমাণে থাকে, সেটা সহজেই আন্দাজ করা যায়। এর ফলে ফেলু চরিত্রে নতুন কোনও অভিনেতাকে নেওয়ার কথা ভুলে গিয়েছেন পরিচালকরা। বিশেষ কয়েকজন অভিনেতাকে নিয়ে একটা বৃত্ত তৈরি হয়েছে। ফেলুদার চরিত্রে যেন এদের মধ্যেই কাউকে ভাবতে হবে, সে ছবি হোক বা ওয়েব সিরিজ়। অবশ্য এর সঙ্গে প্রযোজনা সংস্থার লাভক্ষতির হিসাবও রয়েছে।

আরও পড়ুন: শেষ থেকে শুরু, বড়পর্দায় ফিরছে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’?

যে সময়ে সব্যসাচীকে ফেলু চরিত্রের জন্য নির্বাচন করা হয়, তখন সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। থাকলে তিনিও দর্শকের বিচারে কতটা পাশ করতেন সন্দেহ আছে। একদল ভক্ত এখনও সৌমিত্র ছাড়া আর কাউকেই ফেলু হিসেবে ভাবতে নারাজ। কেউ আবার সব্যসাচীই শেষ কথা, এমনটা ধরে বসে আছেন। উভয় পক্ষেরই বিপদ। কারণ সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে বন্যার জলের মত হুড়মুড়িয়ে যেভাবে ফেলুদাকে নিয়ে ছবি তৈরি হচ্ছে, তাতে চোখকান বেশিদিন বন্ধ করে বসে থাকা প্রায় অসম্ভব। 

এই অতিভক্তির ফলে দিনের পর দিন অগুনতি ফেলুছবি বাঙালির প্রিয়তম গোয়েন্দার জনপ্রিয়তাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে, নাকি বিভ্রান্তি বাড়াবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *