‘স্টার না হয়েও আমি নিজের দর্শক নিজেই তৈরী করেছি’

‘বেলাশেষে’ ছবিতে স্বল্প পরিসরেও নজর কেড়েছিলেন। সম্প্রতি ‘শাহজাহান রিজেন্সি’ ছবিতেও অত্যন্ত জোরালো এক চরিত্রে নিজেকে মেলে ধরলেন সুজয় প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। এইসবের মধ্যেই আজ কবিতাপাঠ তো কাল সঞ্চালনার কাজ করছেন। তবে নিজেকে এক আন্তঃসাংস্কৃতিক শিল্পী বলতেই ভালোবাসেন তিনি। দক্ষিণ কলকাতার এক ক্যাফেতে রেডিওবাংলানেট-এর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে ধরা দিলেন সুজয়।

তুমি নিজেকে আন্তঃসাংস্কৃতিক শিল্পী হিসেবে পরিচয় দাও। এই আন্তঃসাংস্কৃতিক শব্দটার অর্থ কি?

আন্তঃসংস্কৃতি মানে হল শিল্প সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে যার অবাধ বিচরণ। গতবছর একটা নতুন ধরণের কাজ করেছিলাম যেখানে ওয়ার্ল্ড পোয়েট্রির সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীতের কোলাজ ছিল। আবার কোথাও ফটোগ্রাফির সঙ্গে থাকছে পাঠ। উদয়শঙ্কর এরকম প্রচুর কাজ করেছেন। রবীন্দ্রনাথও করেছেন। নানান ধরণের শিল্পের ভাষাকে এক জায়গায় মিলিয়ে দেওয়া। সেটা করতে গেলে শুরুটা করা খুব কঠিন, বিভিন্ন ধরণের ফর্মকে ভাঙতে হয়। আমাকেও ভাঙতে হয়েছে। আমি ক্যাফেতে বা নাইট ক্লাবে রবীন্দ্রনাথ পাঠ করেছি। সেটা ওই সময় কেউ ভাবতেই পারত না।




অভিনেতা নাকি বাচিকশিল্পী, কিভাবে দেখতে চেয়েছিলে নিজেকে?

আমি খুব একটা ভেবে এগোইনি। আমার কাছে পাঠ করা, আবৃত্তি করা, অভিনয়  করা সবকটাই ভালো লাগার জায়গা। ভেতর থেকে মোটিভেশন না পেলে আমি কিছুই করি না। ছোটবেলায় চাইতাম ডাক্তার হতে। কিন্তু অঙ্কের ভয়ে জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিইনি। কিন্তু ডাক্তারি পেশাটা আমার খুব ভালো লাগত। তবে আমি যে খুব ভেবে এগিয়েছি তা নয়। ভালো লাগার জায়গা থেকেই আমি কাজ করি।

পজ়িটিভ ও নেগেটিভ দুরকম চরিত্রেই তুমি সমান সাবলীল। তোমার নিজের কোনটা ভালো লাগে? কি ধরণের চরিত্রে অভিনয় করতে চাও?

আমার কাছে সব সময়েই খুব ইউনি-ডাইমেনশনাল চরিত্র আসে জানো। দেবালয় ভট্টাচার্যের ‘বিদায় ব্যোমকেশ’ ছবিতে যেমন নেগেটিভ চরিত্রে অভিনয় করেছি, যেটা খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। তারপর শাহজাহানে ওরকম একটা বোল্ড চরিত্র। এর মাঝে আরও একটা ছবিতে কাজ করেছি যেটার নাম ‘বেলাশুরু’। বেলাশেষে ছবির সকলেই এই ছবিতেও আছেন, যদিও এটা সিকোয়েল নয়। তো এ ক্ষেত্রে তিনটে চরিত্রে আমি একই সময়ে কাজ করেছি, কোনও অসুবিধা হয়নি। এরকম একটা ঘটনা প্রতিবছর ঘটবে না। আমি এই এতগুলো চরিত্র ব্যালান্স করাটাকে উপভোগ করেছি। তবে আমি নানান ধরণের চরিত্রে কাজ করতে চাই। পছন্দের কাজ পেলেই আমি করব, না হলে নয়। 

যে জন থাকে মাঝখানে

এত দেরিতে অভিনয়ের জগতে এলে কেন?

আমি তো নিজে থেকে আসিনি। আমাকে যা অফার করা হয়েছে, আমি করেছি। শেখর দাস আমাকে প্রথম ছবিতে সুযোগ দেন। ওঁর ছবি ‘নেকলেস’-এ প্রথম বড় পর্দায় আসি। তারপর ‘যোগাযোগ’ ছবিতে কাজ করি। তারপরে অনিকেত চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহাপুরুষ ও কাপুরুষ’ ছবিতে অভিনয় করি। ছোট পর্দায় কিছু কাজ করেছি, তবে সেটা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। টিভি সাউথ এশিয়ায় একটা চ্যাট শো করতাম। এই সূত্রে একটা কথা মনে পড়ছে। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় জীবনের ৩০ বছর পূর্তিতে দুর্গাপুরে একটা অনুষ্ঠান আমি সঞ্চালনা করি। কাজটা আমি আমার মত করে করেছিলাম। তাতে সকলে খুব খুশি হয়েছিল, প্রসেনজিৎও। একটি নামী বেসরকারী টিভি চ্যানেল, যারা প্রচুর রিয়্যালিটি শো করেন, তাদের এক উচ্চপদস্থ কর্তা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বুম্বাদা (প্রসেনজিৎ) তার সামনেই বলেছিলেন, ‘ঋতুপর্ণ ঘোষের পর যদি কেউ চ্যাট শো হোস্ট করতে পারে তো সেটা সুজয়ই পারবে।’ ভদ্রলোক আমাকে দেখা করতে বলেছিলেন। কিন্তু কাজটা শেষ পর্যন্ত হয়নি। তবে তাতে কিন্তু আমার মন ভেঙে যায়নি। আমি সহজে দমে যাই না। এরপরে কলকাতায় অন-স্টেজ চ্যাট শো শুরু করি। দক্ষিণ কলকাতার একটা রেস্তোরাঁয় এটা শুরু করেছিলাম। কলকাতায় এরকম অনুষ্ঠান আমিই প্রথম শুরু করি। শো-এর নাম ছিল ‘জাস্ট মাই ওয়ে’। সেখানে আবির চট্টোপাধ্যায়, অনুপম রায়, অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়, রুপঙ্কর বাগচি, লোপামুদ্রা মিত্র, এদের সাক্ষাৎকার নিই। এরপরে আরও একটা জায়গায় এরকম শো করেছি। সেখানে সৃজিত মুখোপাধ্যায়, পাওলি দাম, চৈতালী দাশগুপ্ত, শাশ্বতী গুহঠাকুরতার মত মানুষদের সাক্ষাৎকার নিই। এগুলো সবই আমি নিজের জোরে করেছি। কেন অপেক্ষা করে থাকব কবে কেউ ডাকবে বলে? আমি স্টার নই। টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রি স্টার চায়। কিন্তু আমি স্টার না হয়েও নিজের দর্শক নিজে তৈরী করেছি। আমি কখনওই স্টার হতে চাই নি। স্টার হয়ে গেলে আমার শিল্পী স্বত্বা মরে যাবে।

তিন মূর্তি ও পায়ের তলায় সরষে

শাহজাহান রিজেন্সিতে নিতাই ব্যানার্জীর চরিত্রটা সমকামী হল কেন? অভিনেতা হিসেবে তুমি রয়েছ বলেই কি? গল্পে তো চরিত্রটা এমন ছিল না

সেটা সৃজিত বলতে পারবে। তবে ছবিটা রিলিজ় হওয়ার পরে আলাদাভাবে বিবৃতি দিয়ে বলেছিলাম যে আমি আর সমকামী চরিত্রে অভিনয় করব না। কিন্তু শাহজাহান-এ আমার চরিত্রটা এতটাই জোরালো ছিল, আর তার মুখ দিয়ে যা বলানো হয়েছে, তেমন চরিত্র তো আমি রোজ পাব না। ভবিষ্যতে যদি কখনও সমকামী চরিত্রে কাজ করার কোনও অফার আসে তাহলে সেটার চিত্রনাট্য শাহজাহান-এর মত বা তার চেয়েও ভালো হতে হবে। শাহজাহান-এ আমার চরিত্রটা ছোট হলেও তার আলাদা গুরুত্ব ছিল। সৃজিত কোথাও এই চরিত্রটাকে লঘু করেনি। আর শাহজাহান আমাকে জাতীয় পর্যায়ে একটা পরিচিতি এনে দিয়েছে।




আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমরা সকলেই জানি একজন সমকামী মানুষ অস্বাভাবিক নন। কিন্তু আগাগোড়া তো পরিস্থিতি এমনটা ছিল না। ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার সময়ে এসব সমস্যা তুমি কিভাবে মোকাবিলা করতে? কিছু খারাপ অভিজ্ঞতা তো হয়েছে নিশ্চয়ই

প্রচুর খারাপ অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু সেসব নিয়ে আজ আর কোনও কথা বলতে চাই না। আমাকে এত মানুষ ভালোবাসেন, আমার পজ়িটিভিটি দেখে এত মানুষ অনুপ্রেরণা পান যে সেসব কষ্টের দিনগুলোর কথা আমি আর মনে করতে চাই না। এক এক সময় যখন ভেঙে পড়েছি তখন আমার কাজ আমাকে আবার উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। আর আমার মা আমাকে সাহস দিয়েছেন। এছাড়া আমার কিছু বান্ধবী আছে, তারা আমার খুব বড় জোরের জায়গা। আমার এক দিদি আছেন, বিদেশে থাকেন, তিনি আমাকে ভেতর থেকে তৈরী করে দিয়েছেন, যাতে আমি নিজেকে কখনও প্রান্তিক মনে না করি। এই মানুষগুলো থাকতে আমার ভেঙে পড়ার কোনও জায়গাই নেই।

রক্তবরণ মুগ্ধকরণ

কাজের জায়গায়, বা আরও একটু স্পষ্ট করে বলা যায় বাংলা বিনোদন জগতে কখনও কোনওরকম রাজনীতির শিকার হয়েছ?

অনেকবার। এখনও হই। টেলিভিশনের এক বন্ধু, নাম বলব না, আমাকে একবার বলেছিল, ‘তোর তো ছেলেদের সঙ্গে কোনও ছবিই দেখি না।’ আমি কিন্তু তারপরেও পাল্টাইনি। ও এটাই বলতে চেয়েছিল কারণ আমি কোনও দলে থাকি না। টালিগঞ্জে কাজ করতে গেলে একটা বিশেষ সমষ্টির মধ্যে থাকতে হয়। কিছু বিশেষ লোকজনের সঙ্গে নিয়মিত ওঠাবসা, তাদের সঙ্গে ছবি তোলা, এগুলো করতে হয়। আর নয়তো একটা ভালোরকম রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড থাকতে হবে। আমি কিন্তু এই কোনও দলেই পড়ি না। আমার বিচার করবে আমার কাজ, কাদের সঙ্গে ওঠাবসা করলাম সেটা নয়। সৃজিত আমার ছোটবেলার বন্ধু। কিন্তু সেইজন্য তো ও আমাকে কাজটা দেয়নি। দিয়েছে কারণ ওই কাজটা আমি পারব তাই। আর একটা ব্যাপার, শাহজাহানের প্রথম দৃশ্যে যেখানে আমার চরিত্রটা আসছে, ওইরকম দার্ঢ্য নিয়ে ইংরেজিতে কথা বলা, এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমার প্রজন্মের আর কেউ পারবে না। এটার জন্যেও অনেকে আমাকে হিংসে করে।

বিভিন্ন ধরণের চরিত্রের জন্য কিভাবে প্রস্তুতি নাও?

শিবপ্রসাদ আর নন্দিতাদির কাছে আমি কৃতজ্ঞ থাকব বেলাশেষের ওই চরিত্রটার জন্য। ওই চরিত্রটা মফঃস্বলেও আমাকে বিরাট পরিচিতি দিয়েছে। বিদায় ব্যোমকেশের চরিত্রটার জন্য যেমন সুদীপা বসু আর দেবালয় দুজনেই খুব সাহায্য করেছিল। অনেকেই চরিত্রটা দেখে অবাক হয়েছেন। আমি কি করে ওই রোলে অভিনয় করলাম সেটাই মানুষকে আশ্চর্য করেছে। যেমন একটা নাটক করেছিলাম ‘লজ্জাতীর্থ’ নামে, সুদীপাদির পরিচালনায়। সেখানে একটা ভয়ঙ্কর চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। লোকটা একটা লম্পট, নিয়মিত তার বউকে পেটায়। সব দিক থেকে একটা খারাপ লোক। সেই শো’টা দেখতে তপন থিয়েটার হাউজ়ফুল হয়েছিল। সুদীপাদি আমাকে যেভাবে করতে বলেছে আমি ঠিক সেই ভাবেই করেছি। তো এরকম নানা ধরণের চরিত্র আমি করতে চাই। আমার খিদেটা ভালো চরিত্রের জন্য, ব্যানারের জন্য নয়।

সত্যজিৎ ও রেলভূত

নতুন কাজ কি করছ এই মুহূর্তে?

আমি এসভিএফ-এর সঙ্গেও যেমন কাজ করেছি তেমন উইন্ডোজ়-এর সঙ্গেও কাজ করেছি। এই মুহূর্তে কোনও ছবির অফার নেই। টেলিভিশনে একটা কাজ করছি। আর একটা ওয়েব সিরিজ়ে কাজ করব। সেটা জাতীয় স্তরে, হিন্দি আর ইংরেজি মেশানো। তবে সেটা নিয়ে এখনই কিছু বলা যাবে না। এছাড়া সোহাগ সেনের নতুন নাটক ‘ছোট ছবি’-তে অভিনয় করছি।

কোনও স্বপ্নের চরিত্র আছে যেটা করতে পারলে ভালো লাগবে?

হ্যাঁ, অবশ্যই। ‘মান্ডি’তে নাসিরুদ্দিন শাহ যে চরিত্রটা করেছিলেন, ওরকম কোনও চরিত্র অভিনয় করতে পারলে খুবই ভালো লাগবে। একটু নেগেটিভ চরিত্র করতে আমি ভালোবাসি, যেহেতু আমি ওরকম নই। ওটা আমার কাছে একটা চ্যালেঞ্জ বলতে পারো। আরও একটা ইচ্ছে আছে, কোনও লার্জার দ্যান লাইফ চরিত্রে অভিনয় করা। যেমন শেক্সপিয়রের নাটকের চরিত্রগুলোয় অভিনয় করার খুব ইচ্ছে রয়েছে। কিন্তু এখানে সেরকম কাজ আমাকে কে দেবে?

শব্দ যখন ছবি আঁকে

জীবনে আর কোনও লক্ষ্য আছে, অভিনয় ছাড়া?

এই মুহূর্তে আমার প্রধান লক্ষ্য নিজের তৈরী সংস্থা এসপিসি ক্রাফটের প্রত্যেক সদস্যকে একজন স্বনির্ভর শিল্পী হিসেবে গড়ে তোলা। আমি নিজে আমার বিপনন করেছি, নিজের জনসংযোগ করেছি। আমি এটাই জানি, এটাই শেখাতে পারি। কলকাতায় এই ধরণের কাজ আর কেউ করে না। আমি এখনও বছরে চার মাস মার্কেটিং কমিউনেকেশন পড়াই, এখনও কনসালটেন্সি করি। কারণ এগুলো আমার উপার্জনের রাস্তা। এগুলো করি বলেই সারাবছর ধরে আমার এই ভাল লাগার কাজগুলো আমি করতে পারছি। আমি কাজের ব্যাপারে খুব খুঁতখুঁতে। বেশি কাজ নিই না। যতটুকু ভালো লাগে, পছন্দ হয়, ততটুকুই করি। তার বেশি কাজ আমি কোনদিনও করব না। পিআর করে আমাকে কখনও কাজ চাইতে হয়নি। আর সেটা চাইবও না কোনওদিন। 

ছবি: প্রতিবেদক

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
1

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *