দ্রৌপদীর থাক পাঁচ, তুই বাপু একটা নিয়েই বাঁচ
‘চরিত্র’- আহা! কি বিশুদ্ধ, কি পবিত্র একখানা শব্দ। শুনলেই বেশ একটা—‘লাল পাড় সাদা, চুলে খোঁপা বাঁধা/শাঁখা পলা সাধ্বী, ‘আর একটু ভাত দিই?’/সেবায় তাল পাখা, ঘোমটা দিয়ে ঢাকা/তুলসী তলায় পিদিম, সঙ্গে উলুর রিদম্/বাজিয়ে দিলেই শাঁখ, সতীর জয়ঢাক’—এরকমই একটা ছবি চোখের সামনে ফুটে ওঠে। জনগনের চিরন্তনভাবে সতী চরিত্রের ওপর বেশ একটা ফ্যান্টাসি আছে। কিন্তু কোনও ফ্যান্টাসিই আবার শাস্ত্রীয় দেবদেবীর মডেল ছাড়া সংখ্যাগরিষ্ঠকে—অর্থাৎ যাকে আমরা জনসাধারণ বলি এবং মধ্যবিত্তের দিকেই যে পাল্লাটা ভারী—তাদেরকে ঠিক জপিয়ে আয়ত্তে রাখা যায় না। ধর্মীয় সুড়সুড়ি যাকে বলে আর কি!
‘তোমার ছেলের নিত্যনতুন ডেট/দুঃখী বালাই ষাট/ওই মেয়েটাও বদলাচ্ছে বয়ফ্রেন্ড/তাই নাকি? শালা স্লাট।’ তাই আছেনই তো আমাদের পঞ্চসতীর দলবল, একেবারে হুড়মুড়িয়ে উদাহরণের ঝাঁপি ফলাও করে, এক মহিলার বহুগামীতা বা নিজের অসুখী সম্পর্কের ভেতর একটু খোলা জানালা খুঁজে এক চিলতে মুক্ত বাতাসের সামনে উন্মুক্ত হওয়ার লক্ষণ দেখলেই, বিবেককে আনন্দের সাথে জোড় করে জুড়ে, ভরপুর ভাবে ‘এবার মঠগামী হও’ বুঝিয়েই ছাড়বে। সমাজের একটা বড় ক্ষতি হয়ে যাবে না? বাচ্চারা তোমায় দেখে কি শিখবে? বোঝো, বাচ্চাদের নাকি সেই ভদ্রমহিলাকে দেখা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই। আর তারাও বুঝতে শিখলে বুঝেই নেবে যে ওই মহিলা আসলে ‘নষ্ট মেয়েছেলে’।
কিন্তু এক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন আছে। শিশুরা কি সত্যিই একদিন হঠাৎ করে নিজেরাই বুঝে নেয় কোন মানুষ খারাপ বা ভালো? আমাদের, মানে বড়দের কোনও অবদান নেই? আমারা শেখাচ্ছি না তো, ‘ওই আন্টির সাথে একদম কথা বলবে না?’ কারণ আমরা চাই না আমাদের সন্তানের মননে একটা নিজস্ব বিচারবুদ্ধির সত্ত্বা তৈরী হোক। আমরা বুঝি না যে আমাদের সন্তান বিশ্ববরেণ্য হলেও যেমন সেটা আমার অবদান, সাথে-সাথে তার নিজস্ব অধ্যাবসায়েরও ফল। ঠিক তেমনই মানুষকে বিচার করার ক্ষেত্রে আমাদের বিচারতত্ত্বের সার গোড়ায় পড়া সত্ত্বেও, একটা সময়ের পর প্রকৃতিতে সে নিজের মত করে ডালপালা মেলেই নিজের মতামতের অস্তিত্ব জাহির করবে। সেক্ষেত্রে যদি কারোর জীবনে দাম্পত্য, সম্পর্ক ইত্যাদির মত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তকে সে জনসমক্ষে হেয় করে, তখন যারা প্রকৃত শিক্ষিত, উদারচেতা মানুষ, তাদের সামনে সে আদতে আমাদের শিক্ষাকেই ছোট করবে।
যে মৃত্যু আজও রহস্য
ভারতবর্ষে যারা সতীসাধ্বীর রোল মডেল, সেই অহল্যা, তারা, মন্দোদরী, কুন্তী, দ্রৌপদীর মধ্যে এক মন্দোদরী ছাড়া কেউই কিন্তু এক পুরুষের সাথে সঙ্গম করেননি। তবু তারা সতী, কেন? মায়াসুরের কন্যা মন্দোদরী অন্য পুরুষের প্রতি আসক্ত হননি হয়ত, কিন্তু তিনি যা করেছিলেন তা আরও ভয়ানক। নিজের স্বামী রাবণের পাপস্খালনের জন্যই হয়ত তার বধের অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন শত্রু সুগ্রীবের হাতে। আবহমান কাল ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে শেখানো হল তারা সতী আর আমরা বিশ্বাস করে তাদের মত করেই নিজের স্ত্রী, বোন, বান্ধবী, মা’কে দেখতে চেয়েছি। হয়ত নারী হিসেবে একটু মনের রাশ আলগা হলেই নিজেরাও নিজেদের বিবেকের কাছে পাপবিদ্ধ অনুভূতিতে বারংবার রক্তাক্ত হয়ে মরমে মরেছি, ভেবেছি কেন এমন হল? কেন এমন করলাম?
সত্যিই তো, কেন আরেকজন বা একের পর এক বহু পুরুষের কাছে একজন নারী নিজের বহু সাধের লালিত আনুগাত্য সঁপে দিচ্ছে, যখন সে কোনও সম্পর্কে আছে বা হয়ত সে কারোর প্রণয়ী, বাগদত্তা, বা কারোর স্ত্রী? এরকম না যে এই ঘটনা শুধু একজন নারীর জীবনেই ঘটে, বহু পুরুষও এই ধরণের ঘটনার রসাস্বাদনের সুযোগ পেয়েছেন, আর পেয়ে অবহেলাও করেননি। কিন্তু চর্চা হয়েছে বা আঙুল উঠেছে একজন নারীর দিকেই, আর ‘গায়ে পড়া’, ‘বেহায়া’, ‘ঢলানি’, ‘নষ্টা’, ‘দুশ্চরিত্রা’, ‘বেশ্যা’ এরকম নানাবিধ বিশেষণের ব্রাহমোস ধেয়ে গেছে তাদের দিকে। এই কথাগুলো দিয়ে বেশ সহজেই যে মেয়েটাকে ব্যাখ্যা করে দিলাম, অচ্ছুতের মত তাকে তাড়িয়ে দিলাম জীবন থেকে, ঘর থেকে, একঘরে করার চেষ্টা করলাম, একবারও ভাবলাম না, কেন এই বহুগামীতা? কেন তার মন বাইরের অলিন্দে এসে নরম হাওয়ায় এলো চুলে জ্যোৎস্না মাখতে দাঁড়ালো?
যে জন থাকে মাঝখানে
সম্পর্ক আসলে এক দামী শাড়ির পারের সুক্ষ্ম কল্কা কাজ, একটা সুতো যদি অলক্ষ্যে খুলে যায় কখনও, ধীরে-ধীরে টান পড়তে-পড়তে পুরো কাজের অধিকাংশটাই খুলে বেরিয়ে আসে। যেটুকু পড়ে থাকে, তাতে আর শাড়িটা পড়ে সভ্য সমাজে বেরোনো যায় না। আদতে বহু মানুষ সম্পর্কে বহু অসুখ বয়ে নিয়ে চলেফিরে বেঁচে থাকেন, এগোতে কষ্ট হলেও এগোয় এটা ভেবে যে একদিন ঠিক শুশ্রুষা জুটে যাবে, একদিন উল্টো দিকের মানুষটা বুঝবে কত মরু-সাহারার পথ বেয়ে শুধু তার ভালোবাসা দু’ আঁজলা ভরে নিতেই তার কাছে আসা, কত লক্ষ নক্ষত্র খসার দিব্যি দিয়ে নিজের ভাগের সমস্ত সুখ তার ঝুলিতে একটু-একটু করে পুরে দেওয়া, সমস্ত অবজ্ঞা, যন্ত্রণা এক চুমুকে ভুলে যাওয়া।
কিন্তু ক্রমান্বয়ে যখন একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য মনের সিংহভাগ ছিঁড়েভুড়ে যায়, অথচ বিনিময়ে জমতে থাকে একরাশ অবহেলা, তখন যদি কেউ এসে সেই ক্ষতয় একটু দুর্মূল্য সঞ্জীবনী সুধার প্রলেপ লাগায় তখন বড় বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়। সমস্ত ক্ষতগুলো শুকিয়ে পেঁজাতুলোর মত তার কাছে উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে, বড্ড ভারহীন লাগে সেই সময়টায়। আর জনগন, মানে যাকে সেই মানুষটা প্রতিবেশী বলত, আত্মীয় বলত, বন্ধু বলত, তারা সব্বাই একে একে ভেবে নিল পদস্খলন হয়েছে তার, নষ্ট হয়ে গেল সেই মানুষটা। দোষ কিন্তু তাদেরও যে ঠিক তা নয়। আসলে বংশানুক্রমে আদর্শ নারী চরিত্রের নামে রোপিত সেই সব পুরানের রোল মডেলদের বীজই তাঁদের সংকীর্ণ, মধ্যবিত্ত মানসিকতার আগুনে ঘি সম্প্রদানের কান্ডটি যত্ন সহকারে ঘটিয়ে চলেছে।
রক্তবরণ মুগ্ধকরণ
এই এত কথা বলার কারণ, সম্প্রতি টালিগঞ্জের এক প্রথিতযশা অভিনেত্রী শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায় বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চলেছেন, বা হয়ত ইতিমধ্যেই বসে পড়েছেন। সেটা অবশ্যই বড় ঘটনা নয়। কিছু মানুষের কাছে ঘটনা হচ্ছে যে তিনি তৃতীয়বার কেন বিয়ের পিঁড়িতে বসছেন আর সেটাও গত দু’বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বার। একজন স্বনির্ভরশীল মহিলা, নিজের স্বাচ্ছন্দ্যে পছন্দের জীবন বাঁচতে চাইছেন। কেন তাকে এর কৈফিয়ৎ দিতে হবে? সোশাল মিডিয়ায় যে ধরণের কুরুচিকর মন্তব্য আছড়ে পড়ছে এবং তা থেকে হাস্যরসের রগরগে উপাদান নিংড়ে বার করে নিচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মধ্যবিত্ত—একটি ভিডিওতে দেখলাম শ্রাবন্তীকে ‘ব্রা-বোনটি’ বলে ডাকা হচ্ছে—তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মাথা ঘামাতে যে অধ্যাবসায়, নিষ্ঠা ব্যয় করছেন, তার সিকি ভাগও যদি নিজের শিক্ষার অগ্রসরের জন্য খরচ করতেন, তাহলে হয়ত আজ এই ধরণের সামান্য ঘটনা নিয়ে তাদের এত হাসির উদ্রেক ঘটতই না।
যদি গ্ল্যামার জগতের এই ধরণের ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে রসালো আলোচনা করতেই হয়, তবে মাথায় রাখা উচিত যে এটাই তো প্রথমবার নয়। কাকে দিয়ে শুরু করব? হলিউডের বহু প্রখ্যাত অভিনেতা অভিনেত্রীর কথা বলতেই পারি, যেমন বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরেও বহুল জনপ্রিয় অভিনেত্রী কেট উইনস্লেটই তিনবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। বলে লাভ নেই, কারণ আমরাও মধ্যবিত্ত ক্ষুদ্র পরিসরে বাঁচতে চাওয়া বাঙালি হয়ে বলব, ‘ওসব কথা ছাড়ুন তো, ওদের কথা আলাদা। ক্যাপিটালিস্ট দেশে ওগুলো কোনও ব্যাপারই না।’
তাশি গাঁওয়ে একদিন
চলো, মেনে নিলাম ও দেশের ব্যাপার বৃহৎ বলেই নাকি সেখানকার মহিলা একাধিক সম্পর্কের স্বাধীনতা পায়, ওসব নাকি মানায় তাদের সাথে। খুব ঠিক কথা। কিন্তু কিশোর কুমারের চারটে বিয়ে, সেটা আমরা গদগদ কন্ঠে গলায় প্রশংসার জল ঢালতে-ঢালতে এখনও হজম করি কি করে? পুরুষমানুষ ছিল বলে, নাকি ওনার চোদ্দ পুরুষের আমাদের কাছে পৈতৃক ঋণ আছে কোনও? ভাগ্যিস তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এখন আর কেউ কাটাছেঁড়া করেন না, নাহলে তো স্বর্গীয় এই স্বনামধন্য শিল্পীও নীচে আমাদের দরজায় নেমে এসে বলতেন, ‘বাবা, আমার বড় ভুল হয়ে গেছিল, তোকে না জিজ্ঞেস করেই শেষবার ওই পুঁচকি লীনার গলাতেও মালা ঝুলিয়ে দিলুম। ক্ষমা করে দে বাপ।’
কিংবা ধরুণ আশা ভোঁসলে, কিরণ খের, বিন্দিয়া গোস্বামী, যোগীতা বালি, নীলম এবং সর্বোপরি বাঙালির ‘মিস ক্যালকাটা নাইন্টিন সেভেন্টি সিক্স’ অপর্ণা সেন, এনারা সবাই তো একাধিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছেন, একাধিক বিয়েও করেছেন। তাহলে এদের নিয়েও সোশাল মিডিয়ায় ট্রোল করা যাক। সবাই না হলেও মুষ্টিমেয় শিক্ষিতরা দেখুক আমাদের দীন-হীন মানসিকতা, আমাদের পারিবারিক রুচি যা আমরা বহন করে চলেছি রন্ধ্রে-রন্ধ্রে।
শব্দ যখন ছবি আঁকে
শুধু শ্রাবন্তী বলেই না, তাঁকে তো রূপোলী পর্দায় বহু মানুষ রোজ দেখেন, কাজেই তাঁর জীবন তো আর তাঁর নিজের থাকতে পারে না। রোজ যাকে টিভির পর্দায় দেখছি, আমরা ভেবেই নিয়েছি সে আমাদের পৈতৃক সম্পত্তি, ঘরের লোক, যা ইচ্ছে বলাই যায়। আবার এটাও আমরা ভাবছি বড়-বড় ব্যক্তিদের নিয়ে সমালোচনা করলে একটু তাদের সমকক্ষও বোধ করা যায় নিজেকে। আসলে আমরা এটা নিজের প্রতিবেশিনী, আত্মীয়া সবাইকে নিয়েই ভাবতে ভালোবাসি যদি তাঁর বিন্দুমাত্র বহুগামীতা আমাদের নজর কেড়ে নেয়।
মোদ্দা ব্যাপার হল সংকীর্ণ মধ্যবিত্ত নিম্নরুচি সম্পন্ন মানসিকতার লোকেদের একটাই সমস্যা, ঈর্ষা। আমি পারলাম না সারাজীবন লোকে আমাকে কি বলবে ভেবে, আর ও একটা মেয়ে হয়ে কি করে পারল? একটু ভয়ডর লাজলজ্জা কিচ্ছু নেই? একটু আড়ালে আবডালেও তো করতে পারত। তা না, সবার সামনে ড্যাং-ড্যাং করে বুড়ো আঙুল ফুলিয়ে একেবারে কাঁদি-কাঁদি কাঁচকলা দেখিয়ে এভাবে একের পর এক সম্পর্ক করছে, ফুর্তি করে বেড়াচ্ছে! শ্রাবন্তী না হয় স্টার, কিন্তু পাশের বাড়ির মেয়েটা তো আর স্টার নয়। এই ধরণের স্বৈরাচারী মানসিকতা ধীরে-ধীরে হলিউড থেকে টালিগঞ্জকেও নিজের যুক্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে একই জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিল, কিন্তু নিজের বাড়ির বা পাশের বাড়ির মেয়েকে নিজ জীবন নিজ মতাদর্শে, স্বাধীনতার সাথে কাটাতে দিতে আমরা নারাজ। হিপোক্রিসির চূড়ান্ত।
আমার মুক্তি আলোয় আলোয়
মধ্যবিত্ত মানসিকতা আসলে সত্য প্রকাশে ভয় পায়, বিশেষ করে কোনও মহিলা তাঁর জীবনের একান্ত ব্যক্তিগত ভাবাবেগগুলো সর্বসমক্ষে উন্মুক্ত করে সাহসিকতার পরিচয় দিলে। সেক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিকতার বর্মটা খসে পড়ে। পৌরুষের গালে সপাটে একটা চড় উড়ে এসে পড়ে। তবে এটা শুধু মধ্যবিত্ত পুরুষের মানসিকতা না, বহু মহিলারও সমস্যা। কারণ নিজেদের তিক্ত জীবন থেকে তারা তো মুক্তি পাননি, খুঁজতে চেষ্টাও করেননি। অতএব আশেপাশে এমনকি নিজের মেয়েও যদি সম্পর্ক থেকে বেরোতে চায় বা ঘর ভেঙে চলে আসতে চায়, সেক্ষেত্রে—‘ওর মত করে একটু মানিয়ে নেবার চেষ্টা কর না’, ‘লোকে কি বলবে ভেবে দেখেছিস?’ বা ‘আমি তোর বাবার সাথে তোর চেয়ে অনেক বেশি মানিয়ে চলেছি, তুই তো তাও ভালো আছিস’—এই ধরণের কথাবার্তা নিজের মা’ও অনেক ক্ষেত্রে বলে থাকেন খানিকটা সমাজের ভয়ে, আর অনেকটাই নিজের জীবনের অপারগতার প্রতিশোধ নিতে। ফলে কত তাজা জীবন খুঁজে নেয় হয় রেল লাইন, নয়ত সিলিং ফ্যান, বা হয়ত আগুনে ঝলসাতে-ঝলসাতে লিখে যায়, ‘কেউ পাশে ছিল না, কেউ কথা রাখেনি।’ আমাদের দুদিনের শোকপালন, সোশাল মিডিয়া জুড়ে হরতাল বসানো। কিন্তু সেই আমরাই কোনও মেয়ে নিজের মত করে বাঁচতে চাইলে তাঁর স্বাধীনতার সামান্য চাবিটুকুও কেড়ে নেব। আর এই আবর্তেই আমরা শ্রীবিষ্ণুর মত সমাজের চাকা ঘোরাতে থাকব নিজের প্রতিষ্ঠিত নিয়মে।
স্মার্টফোন কিনেছি কয়েক হাজার টাকা খরচ করে, যুগের হাওয়ায় তালে তাল দিয়ে ফোর-জি গতিতে ইন্টারনেট ব্যবহার করছি, সোশাল মিডিয়া ব্যবহারের মত একটু আধটু লেখাপড়াও শিখেছি। আমাদের অনেকেরই ফোনের পেছনে আধ কামড়ানো আপেল লেগে থাকে আজকাল। আসলে অর্থ যেমন সমাজে নারী স্বাধীনতার মাপকাঠি নয়, তেমনই শিক্ষার মাপকাঠিও অর্থ হতে পারে না। একাধিক সম্পর্কে তো আমির খান, বনি কাপুর, কবীর বেদী, করণ সিং গ্রোভার, সঞ্জয় দত্ত, এমনকি প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ও আবদ্ধ হয়েছেন। কই, তখন তো কেউ ছি-ছি করি না। আসলে পুরুষতান্ত্রিকতার, পৌরুষের অহংকারের কাছে সেগুলো খুবই তুচ্ছ ঘটনা।
যে দেশে দ্রৌপদী শুধুমাত্র শাশুড়ির আদেশ মান্য করার দায়ে পাঁচ ভাইয়ের ভোগ্যা স্ত্রী হয়ে জীবন অতিবাহিত করেন, এমনকি শ্বশুরকূলে স্বজাতির কোন্দলের কারণে বিবস্ত্র হয়ে পাশা খেলার বাজি হিসাবে মনোরঞ্জনের উপাদান স্বরূপ ব্যবহৃত হন, আবার ধর্মশাস্ত্র হিসেবে সেই মহাভারতকেই মাথায় করে রাখার স্বীকৃতি দেওয়া হয়, সেখানে অযথা কে কটা সম্পর্কে গেল, কার সাথে কি করল এগুলো কি খুব প্রাসঙ্গিক? কোনও নারী যথার্থ সম্মান পেলে হাজার বছর আগে রামায়ন মহাভারতের যুদ্ধও যেমন হত না, তেমনই আজকের দিনে কেউ পরপুরুষের কাছে নিজের ভালো থাকাও খুঁজতে যেত না। হয়ত সে আবার হেরে ফিরে আসবে, কিন্তু তবু জোড় গলায় বলতে পারবে, ‘আমাকে গায়ে আগুন দিতে হয়নি।’
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ একটা বোবা, মরা সম্পর্ককে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যায়, একসঙ্গে থাকে শুধু ‘লোকে কি বলবে’ এই কথা ভেবে। যে দেশে এখনও বিবাহিত দুই নারী পুরষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বললেও পরিচিত ঘাড়গুলো অজান্তেই ঘুরে যায়, সে দেশে দু’বছরের মধ্যে দুটো বিয়ে করে ফেলা তো একটা সামাজিক অপরাধের মধ্যে পড়ে। ‘বিয়ে তো নয়, আসল উদ্দেশ্য হল ‘ইয়ে’’, সংখ্যাগরিষ্ঠ এই চিন্তাটাই ঘুরপাক খায় আমাদের মাথায়। মনের মিলটা আর যাই হোক বিছানা থেকে আসে না। কিন্তু যেটা ভাবতে সুবিধা, আমরা সেটাই ভেবে নিই। যে সম্পর্কে আমি নেই, তার জটিলতা, তার ব্যর্থতার কারণগুলো, বিদীর্ণ আর্ত চিৎকারের মুহূর্তগুলো জানিই না, সেটা নিয়ে অযথা নোংরা তকমা আঁটাটা অশিক্ষার পরিচয়। কূপমন্ডুক হয়ে নিজের গন্ডির জীবন ভালো লাগতেই পারে, কিন্তু তাতে বিশ্বের সব সমস্যার সঠিক পর্যালোচনা করা যায় না।