কেন ‘সাড়ে চুয়াত্তর’?
“এটা যদি বয়স্ক লোকদের বোর্ডিং হতো, আমার কোনও আপত্তি ছিল না। এখানে প্রায় সবই অবিবাহিত ছেলে-ছোকরাদের কারবার। কাজেই আমার আশঙ্কা হচ্ছে যে বোর্ডিং-এর শান্তিভঙ্গ হবে।”
নির্যাসে ১৯৫৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত নির্মল দে পরিচালিত ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবির এই হলো মূল গল্প। উত্তর কলকাতার এক অল্পবয়সী ছেলেদের মেসবাড়িতে হঠাৎই এক প্রমিলার আগমন। ফল: ছেলেবুড়ো নির্বিশেষে অন্নপূর্ণা বোর্ডিং-এর পুরুষকূলে চিত্তচাঞ্চল্য। তাই নিয়ে অনেক ঘটনা, ঘটনার ঘনঘটা, মায় ষাটোর্দ্ধ মেসমালিক রজনীবাবুর ইজ্জৎ নিয়ে টানাটানি। অনাবিল হাস্যরসে সমৃদ্ধ এই ছবি ৬৫ বছর পেরিয়ে আজও সমান জনপ্রিয়। উত্তমকুমার-সুচিত্রা সেন জুটি হিসেবে আবির্ভাবেই বাজিমাৎ। ছবি মারকাটারি হিট।
‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিটি আসলে কার? উত্তম-সুচিত্রার? সম্ভবত না। প্রধান নায়ক-নায়িকার চরিত্রে এই জুটি থাকলেও, এ ছবি আসলে বাংলা চলচ্চিত্র ও মঞ্চের বেশকিছু দিকপাল অভিনেতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনয়ের এক বিরল কোলাজ। কাকে ছেড়ে কার কথা বলব? ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, হরিধন মুখোপাধ্যায় (শিববাবু, যার সংলাপ দিয়ে এই লেখা শুরু), শ্যাম লাহা, নবদ্বীপ হালদার, কে নেই এই ছবিতে?
কিন্তু তাও এরা কেউই বোধহয় নয়। দীর্ঘ ছয় দশক পেরিয়ে সাড়ে চুয়াত্তর আজ কাল্ট ক্লাসিক হওয়ার পেছনে যদি কোনও একটিমাত্র কারণ থেকে থাকে, তা হলো তুলসী চক্রবর্তী ও মলিনা দেবীর অসামান্য অভিনয় রসায়ন, যা না দেখে থাকলে লিখে বোঝানো কঠিন।
Advertisement
প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব বিজন ভট্টাচার্যর কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত, হাস্যরসে জমজমাট এই ছবিটির নামকরণটাই সবচেয়ে অদ্ভুত। সাড়ে চুয়াত্তর। কেন এই নামকরণ? ছবিটির সঙ্গে সাড়ে চুয়াত্তর, যা প্রকারভেদে ‘৭৪৷৷৹’ ও লেখা হয়ে থাকে, কথাটির সম্পর্কই বা কী? আসুন জেনে নেওয়া যাক।
ভারতবর্ষে বহুকাল আগে ব্যাক্তিগত চিঠি বা কোনও গোপনীয় কাগজ, বিশেষ করে প্রেমপত্রের উপর ৭৪৷৷৹ চিহ্নটি ব্যবহার করা হতো। এটা আসলে একটা ‘দিব্যি’ দেওয়া। অর্থাৎ, কোনও চিঠির উপর এই দিব্যি দেওয়া থাকলে, যাকে উদ্দেশ্য করে এই চিঠিটি লেখা হয়েছে, তিনি ছাড়া অন্য কেউ সেটি খুলে পড়তে পারবে না। যদি খোলেন তাহলে এক ভয়ানক পাপের ভাগী হতে হবে।
কি সেই পাপ?
চিতোরের রাণী পদ্মাবতীর উপাখ্যান আমাদের সকলেরই জানা। পরিচালক সঞ্জয় লীলা বনসালী সম্প্রতি একটি হিন্দী ছবিও বানিয়েছেন পদ্মাবতী-আলাউদ্দিন খলজীর গল্প থেকে যা নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। পদ্মাবতী ছিলেন চিতোরের রাণা রাওয়াল রতন সিং-এর পত্নী। কথিত আছে, তাঁর রূপের কথা শুনে, পদ্মাবতীকে পাওয়ার জন্য আলাউদ্দিন চিতোর দূর্গ আক্রমণ করেন ১৩০৩ খ্রীষ্টাব্দে। চিতোরের যত পুরুষ ছিলেন, নিজেদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করে মৃত্যুবরণ করেন। নিরুপায় রাণী নিজের স্বভিমান বজায় রাখার জন্য দূর্গের বাকি রমণীদের নিয়ে জহরব্রত পালন করেন। অর্থাৎ আগুনে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। শুধু কতগুলো শিশুর কান্নার আওয়াজ চিতোর দূর্গের সুউচ্চ প্রাচীরের প্রতিধ্বনিত হতে হতে রাত নেমেছিল সেদিন।
সেই সব মৃত সৈনিকদের উপবীতের সম্মিলিত ওজন ছিল সাড়ে চুয়াত্তর মন। ছবি তৈরি হওয়ার সময়কালে এক মন হতো চার সের, এখনকার মত ৪০ সের নয়। এক সের-এর ওজন বর্তমানে ০.৯৩ কেজি।
চিতোরের বীরগাথা, তা সত্যি হোক বা কাল্পনিক, প্রথম জানা যায় পদ্মাবতীর আত্মাহুতির আড়াইশো বছর পর, সুফি কবি মালিক মহম্মদ জয়সীর করুণরস কাব্য ‘মাধুরী’-তে। ধারণা করা, হয় সেই সাড়ে চুয়াত্তর মন উপবীতের মৃত মালিকদের নামে দিব্যি দিলে সেই দিব্যি লাগতে বাধ্য। তাই গোপনীয় চিঠির উপর ৭৪৷৷৹ লিখে দেওয়ার রেওয়াজ চালু ছিল।
‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে প্রেমপত্র চালাচালির ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল এবং একজনের ব্যাক্তিগত চিঠি অন্যের হাতে পড়ে চরম নাটকীয় মুহুর্তের সৃষ্টি হয়। সেই দিব্যি মেনে—গোপনীয় চিঠি অন্য কেউ পড়লে তার ‘পাপ’ লাগতে পারে—এই বিশ্বাসটি অদ্ভূতভাবে সত্যি হয়ে যায় যখন রামপ্রীতিকে (উত্তম) লেখা রমলার (সুচিত্রা) চিঠি কেদার (ভানু), কামাক্ষ্যা (জহর) এবং বোর্ডিং-এর আরও অনেকে খুলে পড়ে। সেই চিঠি রজনীবাবুকে (তুলসী) দেওয়া হয় পড়ার জন্য। কিন্তু পাকেচক্রে সেই প্রেমপত্র পড়ে ফেলেন তার স্ত্রী (মলিনা)। চিঠিতে লেখা অন্য অনেক কথার মাঝে বিশেষ একটি কথা—জ্ঞানবৃদ্ধ—থেকে তার বদ্ধমূল ধারণা হয় এ চিঠি কোনও এক তরুণী রজনীবাবুকেই লিখেছে। অতঃপর স্বামীকে ফিরে পাওয়ার জন্য রজনীবাবুর স্ত্রীর প্রাণান্তকর চেষ্টা, এমন কি ওঝা ডেকে ভূত তাড়ানো পর্যন্ত, সবকিছুই করে ফেলেন। সব ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয় রামপ্রীতি-রমলার বিয়ের আসরে, যখন রজনীবাবু দেখিয়ে দেন, যারা এই প্রেমপত্র লিখেছিল তাদেরই আজ বিয়ে হচ্ছে।
নির্ভেজাল আনন্দের ছবি ‘সাড়ে চু্য়াত্তর’-এর নামকরণে পেছনে যে অন্য এক করুণ কাহিনি লুকিয়ে আছে, তা হয়ত এত বছর পরেও অনেকেরই অজানা।