অর্ধশতক পেরিয়ে
একটা উপন্যাস কত বছর ধরে তার জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে? আজকের দিনে যেখানে এক দশকেরও কম সময়ের মধ্যে পাঠক একটা বইয়ের নাম ভুলে যায়, সেখানে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলা সাহিত্যে কাল্ট হয়ে যাওয়া উপন্যাস শংকরের চৌরঙ্গী। ১৯৬২ সালে ছাপার অক্ষরে প্রথম প্রকাশিত হয় এই উপন্যাস, নগরসভ্যতার এক অসামান্য দলিলরূপে। ষাটের দশকে রচিত সেই কাহিনী, যার মাধ্যমে ক্ষমতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা সমাজের আসল মুখগুলোর ছবি উঠে আসে, সাধারণ কিছু মানুষের প্রতিদিনের সংগ্রামের কথা উঠে আসে একেবারে অন্য আঙ্গিকে, তা নিশ্চয়ই আজ বিশ্বায়ন পরবর্তী যুগে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক।
আর তা যদি নাই হবে, তা হলে এই সময়ে দাঁড়িয়ে পরিচালক সৃজিত মুখোপধ্যায় আবারও চৌরঙ্গী বড় পর্দায় আনতে চাইতেন না।
প্রথমবার চৌরঙ্গী নিয়ে ছবি তৈরি হয় ১৯৬৮ সালে। পরিচালনা করেন পিনাকী মুখোপাধ্যায়। উপন্যাসের মত ছবিটিও তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। অভিনয়ে ছিলেন উত্তমকুমার, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, সুপ্রিয়া চৌধুরী, উৎপল দত্ত, ভানু বন্দোপাধ্যায়, বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়, অঞ্জনা ভৌমিক এবং আরও অনেক প্রথম সারির অভিনেতা। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর বলা বাহুল্য আরও বেশি করে বাঙালি জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন স্যাটা বোস, শঙ্কর, মার্কোপোলো, বায়রন সাহেব, গুড়বেরিয়া, ন্যাটাহরি, রোজ়ি, করবী গুহ, মিসেস পাকরাশী, আগরওয়ালা, কনি দি উয়োম্যান নামের চরিত্ররা। সত্যসুন্দর বোসের মতো উজ্জ্বল তরুণরা যেমন আজও নানান নভেল পড়ে কিংবা ছবি দেখে হোটেল ইন্ডাস্ট্রিতে চাকরি করতে আসে, তেমনই কেউ হয়ত হঠাৎই ধূমকেতুর মতো আছড়ে পড়ে পাঁচতারা জীবনের আঙিনায়, যেমনভাবে শঙ্কর এসে পড়েছিল একদিন। আবার নিত্যহরির মত কোনও ছাপোষা ব্রাহ্মণকে হয়ত অনিচ্ছা সত্বেও প্রতিদিন অতিথিদের বালিশ বিছানা ঘাঁটাঘাঁটি করতে হয় কোনও এক বিলাসবহুল হোটেলে। মার্কোপোলোর জীবনের ট্র্যাজেডি কিছুতেই তাকে শুধুমাত্র এক হোটেল ম্যানেজার হিসেবে দূরে সরিয়ে রাখে না। বরং কাঠখোট্টা চরিত্রের আড়ালে বড় বেশী জীবন্ত হয়ে ধরা দেন তিনি।
বিশ্বনাথের বারাণসী, বারাণসীর বিসমিল্লাহ
এই সমস্ত চরিত্ররা আমাদের আসেপাশেই ছড়িয়ে রয়েছে, শুধু খুঁজে নেওয়ার অপেক্ষা। আর অর্ধশতক পেরিয়ে, সেই খুঁজে নেওয়ার দায়িত্বই সম্ভবত কাঁধে তুলে নিতে চেয়েছেন সৃজিত।
নতুনভাবে চৌরঙ্গী অবলম্বনে ছবি করতে গিয়ে সৃজিত গল্পের সময়কে এগিয়ে এনেছেন ষাটের দশক থেকে বর্তমান সময়ে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই গল্পের পারিপার্শ্বিকের একটা আমুল পরিবর্তন দেখা যাবে। ছবির নাম চৌরঙ্গীর বদলে রাখা হয়েছে ‘শাহজাহান রিজেন্সি’। পাল্টাচ্ছে চরিত্রের নামও। উপন্যাসে যে সমস্ত নাম ছিল তা ছবিতে রাখা হয়নি, হয়ত সচেতনভাবে আগের ছবিটির প্রভাব এড়ানোর কারণেই। ছবির মূল চরিত্র শঙ্করের নাম এখানে হয়েছে ‘রুদ্র’। স্যাটা বোস হয়ে যাচ্ছেন ‘স্যাম বোস’। এমন আরও অনেক নতুন কিছু দেখা যাবে ছবিতে।
শুধু পাল্টাচ্ছে না প্রধান চরিত্রগুলির আঙ্গিক, সুত্রধরের মূল্যবোধ। মূল উপন্যাসটি পড়লেই বোঝা যায়, শঙ্কর এখানে একজন আম বাঙালি, যে কালের নিয়মে মা-বাবার শিক্ষায়, স্নেহে বড় হয়। তারপর পারিপার্শ্বিকের কাছে নীতিবোধের পাঠ নিয়ে একদিন ভাগ্যের ফেরে, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলার উদ্দ্যেশে কঠিন বাস্তবের পথে পা বাড়ায়। সেই অতি সাধারণ ও মধ্যবিত্ত বাঙালির চোখে দেখা সাততারা বিলাসিতা, ও সেই ঝাঁ চকচকে খোলসের আড়ালে ক্ষয়ে যাওয়া জীবনের নগ্ন, কদর্য রূপকে লেখক প্রত্যক্ষ করেছেন দিনের পর দিন।
তিন মূর্তি ও পায়ের তলায় সরষে
কিভাবে এমন একটা কাহিনী লেখার কথা মাথায় এল তাঁর? উত্তর দিয়েছেন শংকর নিজেই।
সেদিন হঠাৎ তুমুল বৃষ্টি। সঙ্গে ছাতা না থাকায় চৌরঙ্গীর মোড়ে কে সি দাসের দোকানের পাশে দাঁড়িয়েছেন লেখক। মনটা ভাল ছিল না সেদিন। ‘কত অজানারে’ প্রকাশিত হয়েছে বেশ অনেকদিন আগে। অথচ তাঁর নতুন লেখা মনোনীত হয়নি। সকলে বলতে শুরু করেছে উনি একটিমাত্র বই লিখেই নাম করেছেন, আর কিছু লেখার ক্ষমতা ওঁর নেই। ইংরেজীতে যাকে one-book author বলা হয়। নতুন কি নিয়ে লিখবেন সে ব্যাপারেও মনস্থির করতে পারছেন না। সেদিন ওই জায়গায় পাশেই একটি ছোট্ট বইয়ের দোকানে বই দেখতে গিয়ে একটি কবিতার বইতে কয়েকটি লাইনে তাঁর চোখ আটকে গেল। লাইনগুলো ছিল এরকম: আমরা সকলেই পৃথিবীর পান্থশালায় আছি/কেউ কেউ প্রাতরাশ খেয়ে চলে যাবে। কেউ বা মধ্যাহ্নভোজ অবধি অপেক্ষা করবে/কেউ আবার রাতের খাবার খেয়ে যাবে। দূরে এক বিলাসবহুল পাঁচতারা হোটেলের দিকে চোখে পড়ল লেখকের। সেখানে তখন নৈশভোজের উদযাপন চলছে। স্থির করলেন লেখক, ওই হোটেলই হবে তাঁর আগামী উপন্যাসের প্রধানতম চরিত্র।
যে মৃত্যু আজও রহস্য
দ্বিতীয়বার ছবি হওয়া প্রসঙ্গে শংকর বলেন, ‘একটা ছবি তো অনেকের গল্প নিয়েই হয়। আমার কপালে একটা নাটক ও দুটো ছবি জুটল এই একই গল্পের ওপর। দেখাই যাক না মানুষের কেমন লাগে।’
ছবি প্রসঙ্গে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় জানালেন শঙ্করের চরিত্রটি, এখানে যার নাম রুদ্র, সে মূলত গোটা ছবি জুড়ে লেন্সের কাজ করছে। তার চোখ দিয়েই দেখা হচ্ছে বাকি চরিত্রগুলিকে।
রক্তবরণ মুগ্ধকরণ
ছবিতে হাউজ়কিপার নিতাই বন্দোপাধ্যায়ের চরিত্রে রয়েছেন সুজয় প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। তিনি জানালেন, হাউজ়কিপিং-এর কাজ সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না তার, তাই সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে চরিত্রটি তার কাছে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং। পিনাকীবাবুকে কাছ থেকে জানার সুবাদে তাঁর সঙ্গে বহুবার এই ছবি নিয়ে কথাও হয়েছে, জানালেন তিনি। ভানু বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে তুলনার চাপ কিভাবে সামলাবেন এর উত্তরে তিনি বললেন, সৃজিত যেভাবে চরিত্রটিকে এঁকেছেন সেটা আগের ছবির ন্যাটাহরির থেকে একেবারেই আলাদা। ভানুবাবুর জুতোয় পা গলানো তার কাছে পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার, এই তৃপ্তি তার থেকে যাবে আজীবন।
সুজয় আরও জানালেন, উপন্যাসে যে ক্যাবারে ড্যান্সারের ভূমিকা ছিল তা সময়ের পরিবর্তনের কারণেই রাখা যায়নি। এখনকার পটভূমিতে দাঁড়িয়ে ক্যাবারে নাচ আর চলে না, বরং বেলি ডান্সার চলতে পারে।
শাহজাহান রিজেন্সি মুক্তি পাচ্ছে ১৮ জানুয়ারী।
আরো লিখলে, আরো পড়তাম