গানবাজনা, রহস্য ও ভালোবাসার জমজমাট মিশেল

ছবি: ট্যাংরা ব্লুজ়

পরিচালনা: সুপ্রিয় সেন

অভিনয়ে: পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, মধুমিতা সরকার

দৈর্ঘ্য: ১২২ মিনিট

RBN রেটিং: ৩.৫/৫

শহর কলকাতা কোনওদিন আমাদের অজান্তেই যেন এক সূক্ষ্ম রেখায় দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। একদিকে রয়েছে অর্থবান সম্প্রদায়, আর অন্যদিকে নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যাওয়া মানুষরা। অর্থবানদের কাছে রয়েছে নোটের তাড়া যা সব স্বপ্ন সত্যি করার চাবিকাঠি। কিন্তু বাকিদের? তাদের পকেটে টাকা নেই বলে কি স্বপ্ন থাকতে নেই? তাই কেবলমাত্র স্বপ্নকে হাতিয়ার বানিয়ে ইচ্ছের ডানায় ভর করে এগিয়ে যাওয়ার গল্প বলে এই ছবি।




২০০৯ সালে ইউনিয়ন লিডার সিরিল মুর্মুর খুনের ঘটনা দিয়ে ‘ট্যাংরা ব্লুজ়’ শুরু হয়। তারপর জাম্পকাটে দশটা বছর এগিয়ে গিয়ে শুরু হয় ছবির মূল কাহিনী। তিনটি চরিত্রের জীবন কেন্দ্র করে গল্প এগিয়েছে। জোয়ী (মধুমিতা) আজীবন সঙ্গীতকে ভালোবেসেছে। বিদেশে গিয়ে গানবাজনা নিয়ে পড়াশোনা করার পর সে মুম্বইতে ফিরে এসে একটি ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করার কাজ পায়। কিন্তু চোখা সমালোচনায় তার স্বপ্নের ভরাডুবি হয়। ভেঙে পড়ে জোয়ী কলকাতায় ফিরে আসে।

নিজেকে একরকম গানের জগৎ থেকে সরিয়েই নিচ্ছিল জোয়ী, এমন সময় তার সঙ্গে আলাপ হয় সঞ্জীব মন্ডল অ্যান্ড গ্ৰুপের। এই পারকাশন দলের কর্ণধার সঞ্জীব (পরমব্রত) জীবন বদলে শুরু করলেন নিজের ব্যান্ড। এদিকে বাদ্যযন্ত্র কেনার টাকা নেই। তাই সমাজে আপাত অব্যবহার্য নানা জিনিস পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তুলে শুরু হলো ব্যান্ড। কিন্তু সাফল্যের পথ বড়ই কঠিন। সেখানে পথপ্রদর্শক সকলেই মুনাফা লোটার জন্য ওঁৎ পেতে রয়েছে। কাজেই, বারবার হেরে গিয়েও নতুন করে যাত্রা শুরু করে সঞ্জীব। তার লড়াইয়ে অজান্তেই যেন শামিল হন দর্শক।

আরও পড়ুন: অন্তরঙ্গ দৃশ্যে ‘না’, রাজ কাপুরকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন পদ্মিনী

জোয়ী আর সঞ্জীবের পাশাপাশি এই ছবিতে আরও একজনের গল্প সমান্তরালভাবে চলে। ছবির শুরুতেই খুন হয়ে যাওয়া সিরিল মুর্মুর ছেলে চার্লটন মুর্মু, ওরফে চালু সেই গল্পের নায়ক। সঞ্জীবকে সে গুরু মানে। তার ব্যক্তিগত জীবনের নানা ওঠাপড়াও প্রভাব ফেলে ছবির গতিপথে।

ছবির শুরুর ঘটনা নিয়ে একটা রহস্যের ছায়াও দর্শককে তাড়া করে বেড়ায়। সেই রহস্যের সমাধান হয় একেবারে শেষে।

আরও পড়ুন: কলকাতার বুকে ক্যাফে থিয়েটারের অভিনব প্রয়াস

পরমব্রত এবং মধুমিতার অভিনয় যথাযথ। এছাড়া সঞ্জীবের সহকারী হিসেবে তার ব্যান্ডের প্রতিটি খুদে অভিনেতা বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার।

সুপ্রিয় এর আগে বহু তথ্যচিত্র পরিচালনা করলেও এটি তাঁর প্রথম ফিকশন ছবি। ট্যাংরার সঞ্জয় মণ্ডলের জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই ছবি বানালেও চলচ্চিত্রের উপযোগী করে তোলার জন্য বেশ কিছু কল্পনার মালমশলা মেশানো হয়েছে এই ছবিতে। তবে সবকিছুর পরেও ছবি দেখার সময়ে একবারও মনে হয় না যে এই ছবির নির্মাতা ফিচার ছবি নির্মাণের জগতে প্রথমবার পা রাখলেন।

আরও পড়ুন: আবারও স্করসেসির সেরায় সত্যজিৎ

এই ছবির সবথেকে বড় অস্ত্র হলো এর গতি। ছবির প্রতিটি অংশই সমান গুরুত্বপূর্ণ। পরিচালক দু’ঘন্টা ধরে এই গতিময়তায় দর্শককে শামিল করতে সক্ষম হয়েছেন।

ছবির কাহিনীকার সুপ্রিয় নিজেই। তিনটি মূল চরিত্রের কাহিনীকে সমান্তরালভাবে চালালেও অত্যন্ত নিপুণভাবে সেই তিনটি রেখাকে এক করে দিতে পেরেছেন তিনি। তবে অতি কল্পনা মেশাতে গিয়ে নায়ক-নায়িকাদের একেবারে জিতিয়েও দেননি তিনি। কিছু পেতে গেলে যে কিছুকে বিসর্জন দেওয়া এ সংসারের এক অমোঘ নিয়ম, সে কথা মাথায় রেখেই কাহিনীর শেষাংশ রচনা করেছেন সুপ্রিয়। তাঁর এবং পরমব্রতর যৌথ চিত্রনাট্যেও বলিষ্ঠতার ছাপ স্পষ্ট।

ছবিতে রঞ্জন পালিতের ক্যামেরার কাজও যথাযথ। কোনও অংশেই আলোছায়ার খেলাকে খুব বেশি একঘেয়ে মনে হয় না। সুমিত চৌধুরীর প্রায় নিখুঁত সম্পাদনাও প্রশংসার দাবি রাখে।




সবশেষে বলা যাক এই ছবির আবহ এবং সঙ্গীতের কথা। এমন এক অভিনব ব্যান্ডের কাহিনী যে ছবিতে বলা হচ্ছে, তার আবহ নিয়ে দর্শক আগে থেকেই আশাবাদী হবেন। বিভিন্ন দৃশ্যের সঙ্গে যথাযথভাবে আবহ পেশ করেছেন সঙ্গীত পরিচালক নবারুণ বসু। একই সঙ্গে বিভিন্ন র‍্যাপের জন্য যা সুরারোপ করা হয়েছে, তাতে দর্শক দেখার সঙ্গে-সঙ্গে নিজের অজান্তেই তাল মেলাবেন। র‍্যাপের প্রতিটা কথাও দর্শকদের মনে দাগ কেটে যায়। এই শ্রেণীর মানুষগুলোর ব্যাপারে নতুন করে ভাবতে শেখায় প্রাঞ্জল দাসের লেখা র‍্যাপের কথা।

সব মিলিয়ে গানবাজনা, রহস্য ও ভালোবাসার ছোঁয়া নিয়ে নববর্ষের নতুন ছবি ‘ট্যাংরা ব্লুজ’ জমজমাট।



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Diptajit

An avid reader and a passionate writer of crime fiction. Poems and verses are his second calling. Diptajit is the editor of a Bengali magazine. Nothing makes him weaker than books, films and food

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *