এরকম গোয়েন্দার প্রয়োজন ছিল

ছবি: রিভলভার রহস্য

পরিচালনা: অঞ্জন দত্ত

অভিনয়ে: সুপ্রভাত দাস, তনুশ্রী চক্রবর্তী, সুজন মুখোপাধ্যায়, শোয়েব কবির, অভিজিৎ গুহ, কাঞ্চন মল্লিক, সুদীপা বসু, তানিকা বসু, ছন্দক চৌধুরী, অঞ্জন দত্ত

দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৫৭ মিনিট

RBN রেটিং ★★★★★★★☆☆☆

ওয়েব সিরিজ়ের রমরমা বাজার শুরু হওয়ার পর থেকে বহু ছবির ক্ষেত্রে সেই ধাঁচটাকেই আপন করে নেওয়ার একটা প্রবণতা এসেছে। অর্থাৎ, প্রেক্ষাগৃহে বসে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মনে হয়, এ ছবি বাড়িতে টেলিভিশনে দেখলেও ক্ষতি ছিল না। উপভোগ করা তো দূর, চোখের ক্লান্তিটাই ছবি দেখার পথে সবথেকে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সবক্ষেত্রে না হলেও অধিকাংশ ছবি থেকে সেই বিগ স্ক্রিন ফিল পাওয়া যায় না। ইদানিং গোয়েন্দা গল্পও যেরকম একঘেয়ে হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাতে করে খুব একটা প্রত্যাশা থাকে না। তবে এই সবকিছুর থেকে ব্যতিক্রম হয়ে দাঁড়াল সুব্রত শর্মা। এমন রোমান্টিক গোয়েন্দা বাংলা সাহিত্য এবং ছবি, দু’ ক্ষেত্রেই বিরল। সে বিষয়ে পরে আসছি। 



গল্পে একটু আলোকপাত করা যাক। গোয়েন্দা ড্যানির (অঞ্জন) সহকারী হিসেবে সুব্রত (সুপ্রভাত) রাজা ব্যানার্জির (সুজন) কেস নিয়ে দার্জিলিং পৌঁছয় তমালির (তনুশ্রী) খোঁজে। সেখানে গিয়ে জাভেদ চৌধুরী (শোয়েব) ও পোনার (ছন্দক) মোকাবিলা করতে-করতে একটা সময় সুব্রত বড় ষড়যন্ত্রের গন্ধ পায়। 

গল্পের নামেই কিছুটা খটকা লুকিয়ে আছে। রিভলভার দিয়ে খুনজখম করা যেতে পারে, কিন্তু রহস্যটা কিসের? এই রিভলভারই সব রহস্যের মূল, আবার সমাধানও মেলে এখানেই। ছবির শুরু দুর্দান্ত একটি চেজ় দৃশ্য দিয়ে, যা হাতে ধরা ক্যামেরায় জার্ক শটে দেখতে দারুণ লাগে। একটা জমজমাট ছবি হতে চলেছে, প্রথম দৃশ্যেই অঞ্জন তা বুঝিয়ে দেন।

গোয়েন্দার প্রয়োজন ছিল

ড্যানির গল্পটা সুব্রতর মুখ দিয়ে বলানোয় অনেকটা সময় যেমন বেঁচে গেছে তেমনই ড্যানি সম্পর্কে কোনও ধারণা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। ফলে ড্যানি যতবার পর্দায় এসেছে সে আগাগোড়া এক সারপ্রাইজ় প্যাকেজ হয়েই থেকে গেছে। কখনও সে সুব্রতকে পরামর্শ দিচ্ছে, কখনও বা ধমকাচ্ছে, কখনও শুধুই মজা করছে, আবার কখনও দর্শকের হয়ে কথা বলছে। ড্যানির উপস্থিতি আগাগোড়াই দর্শককে চাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। চরিত্র হয়েও সে কিছুটা সুব্রতর বিবেক, আবার কিছুটা দর্শকের কাছে কমিক রিলিফ এবং সাময়িক ধোঁয়াশা কাটানোর পথও বটে। এই ব্যাপারটা গোয়েন্দা গল্পের ক্ষেত্রে একটা নতুন সংযোজন বলা যায়।

এরকম বেশ কিছু নতুন জিনিস রয়েছে এই ছবিতে। যেমন সুব্রতর আচরণ। পেশাদার হোক বা শখের, বাঙালি গোয়েন্দারা সাধারণত কিছুটা অতিমানব, বা বলা ভালো আবেগশূন্য হয়ে থাকে। সুব্রত তার বিপরীত মেরুতে। সে আবেগী। সে হয়ত এখনও তুখোড় গোয়েন্দা হয়ে ওঠেনি। সে ভুল করে, বারবার শত্রুপক্ষের হাতে আক্রান্ত হয়, মার খায়। তবু কেস ছেড়ে পালিয়ে যায় না। কারণ তার জেদ, কারণ তার আবেগও। সর্বোপরি সুব্রত বা তার কেস, সবটাই খুব বাস্তব। বাংলা ছবিতে এরকম গোয়েন্দার প্রয়োজন ছিল।

গোয়েন্দার প্রয়োজন ছিল

ড্যানির উপস্থিতি ছাড়া এ ছবিতে আর কোনও ফ্যান্টাসি নেই। অন্যান্য গোয়েন্দা গল্পের মতো সাজানো মসৃণ ঘটনাপ্রবাহ নেই। সুব্রতকে লড়তে হয়েছে রুক্ষ, কঠিন বাস্তবের কাছাকাছি কিছু গায়ের জোর-সর্বস্ব গুন্ডা আর তুখোড় বুদ্ধিসম্পন্ন নেপথ্যের কিছু দুষ্টু লোকের সঙ্গে। আপাতদৃষ্টিতে সুব্রতর পক্ষে যা অসম্ভব মনে হয়, সেটাই সে করে দেখায় তার অতিসাধারণ উপস্থিত বুদ্ধি আর আবেগী মন নিয়েই। সব মিলিয়ে শরীরী স্টাইল আর পালিশটুকু বাদ দিলে, সুব্রতকে বাঙালি জেমস বন্ডের কাছাকাছি বলাই যায়। ছাপোষা সাধারণ ব্যক্তিত্ব নিয়েই তার জেদ, রাগ, আবেগ, প্রেম, কান্না, অসহায়তার যোগফল দিয়ে দর্শকের মন জয় করে নেয় সুব্রত। তার ভালনারেবল প্রকৃতিই তাকে ভালো লাগতে বাধ্য করে। সুব্রত নায়ক নয়, বরং খুব চেনা এক জেদি বাঙালি। দাঁতে-দাঁত চিপে যার লড়ে যাওয়াটা আমাদের অনেকের জীবনের সঙ্গেই মিলে যায়। 

আরও পড়ুন: ব্যোমকেশের দায়িত্বে বিরসা

স্যাঁতস্যাতে আবহাওয়ায় ভেজা দার্জিলিংয়ের রাস্তাঘাট গল্পকে আক্ষরিক অর্থেই জীবন্ত করে তোলে। রহস্য শুরুতে একরকম থাকলেও পরবর্তীতে তার চেহারা পাল্টে যায়। তবু শেষ অবধি টানটান ব্যাপারটা থাকায় ‘এবার কী হবে’ উত্তেজনাটা আগাগোড়াই বজায় থাকে। কাজেই সবদিক দিয়েই রহস্য থেকেছে দুর্ভেদ্য ও অননুমেয়। আর সবথেকে বড় কথা ওই বিগ স্ক্রিন ইফেক্ট। বড়পর্দায় ছবি দেখার একটা আলাদা আনন্দ আছে। এ ছবি সেই আনন্দ পূর্ণমাত্রায় দেবে। 



অভিনয়ে সুপ্রভাত নিজের সবটুকু দিয়েছেন। নিজেকে ভাঙাগড়ার মধ্যে দিয়ে সার্থক বাস্তবিক গোয়েন্দা হয়ে উঠেছেন তিনি। আশা করা যায় রহস্যপ্রিয় বাঙালি দর্শক এই নতুন গোয়েন্দাকে গ্রহণ করবে। তনুশ্রীর চরিত্রে একাধিক স্তর রয়েছে। সেই সমস্ত স্তরকেই দক্ষতার সঙ্গে ছুঁয়েছেন তিনি। চরিত্র অনুযায়ী সাজেও অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও গ্ল্যামারাস লেগেছে তাঁকে।

শোয়েব সেই অর্থে নতুন নন। এর আগে বেশ কিছু কঠিন চরিত্র করেছেন তিনি। তবু এখানে তিনি একেবারে আলাদা এক চরিত্রে। জাভেদের চরিত্রে মানানসই লেগেছে তাঁকে। সুজন অভিজ্ঞ অভিনেতা, ফলে তাঁর ওপর প্রত্যাশা থেকেই যায়। খুব সাবলীল অভিনয়ে তা পূরণ করেছেন তিনি। স্বল্প পরিসরে চন্দনের অভিনয়ের দাপট বরাবরের মতোই তৃপ্তি দেবে।

আরও পড়ুন: গিরিশচন্দ্র ঘোষের ভূমিকায় এবার কৌশিক

অঞ্জনের অভিনয় নিয়ে নতুন কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। ড্যানির ভূমিকায় তিনি নিজের মতোই অপ্রতিরোধ্য। এরই মাঝে স্বল্প সময়ের জন্য এক দক্ষিণ ভারতীয় চরিত্ররূপে নতুন করে অবাক করলেন তিনি। আরও বেশি করে অভিনয়ে থাকা উচিত অঞ্জনের, অন্তত দর্শকের কথা ভেবেই। 

পুরো ছবি জুড়েই চিত্রগ্রহণ মনে রাখার মতো। ছবিতে একটিই গান রয়েছে, অঞ্জনের গাওয়া ‘পুরনো চাঁদ’। তার যে নেপালি সংস্করণ শোনা গেল তা সত্যিই কান এবং মনের আরাম দেয়।

ইদানিং অজস্র গোয়েন্দা ছবি ও সিরিজ় সারাবছর চলতেই থাকে। সেই গড্ডালিকায় সুব্রত শর্মা এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। আগামী দিনে আরও কঠিন কোনও কেসে তাকে দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকবে দর্শক।




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
2

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *