স্মার্ট, বাস্তবধর্মী, ন্যাকামিবর্জিত
ছবি: সহবাসে
পরিচালনা: অঞ্জন কাঞ্জিলাল
অভিনয়ে: ইশা সাহা, অনুভব কাঞ্জিলাল, সায়নী ঘোষ, রাহুল অরুণোদয় বন্দোপাধ্যায়, দেবলীনা দত্ত, শুভাশিস মুখোপাধ্যায়, তুলিকা বসু, বিশ্বজিত চক্রবর্তী
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা
RBN রেটিং: ৩/৫
স্কুলজীবন থেকে ইঁদুর দৌড়ে সামিল হয়ে প্রায় ছুটতে-ছুটতে, পড়াশোনার গণ্ডি পেরিয়ে ক্রমশ পেশাগত প্রতিযোগিতার জীবনে পা রেখে দম ফেলার সময় না পাওয়া প্রজন্মের বেশিরভাগেরই সমস্যা একাকীত্ব। কেউ সঙ্গী না পেয়ে একা, কেউ বা সঙ্গী পেয়েও একা। ক্রমাগত ওপরে ওঠার নেশা, সীমাহীন উচ্চাশা, একে অপরকে বুঝতে না চাওয়া, সময়ের অভাব, সর্বক্ষণ পেশার চাপ সব মিলিয়ে এমন এক হতাশার সৃষ্টি হয় যে তার পাশে বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, পারস্পরিক টান সবই কেমন যেন ফিকে হয়ে যায়। পড়ে থাকে শুধু বিরক্তি, সন্দেহ আর মনখারাপ। আগামী প্রজন্মের কাছে এমনটাই হয়ে উঠছে জীবন। যেখানে সমাজের কোথাও স্থিরতা নেই, চাকরির নিশ্চয়তা নেই, জীবনযাত্রায় শান্তি নেই, কাজের তৃপ্তি নেই, সম্পর্কে ভরসা নেই, সেখানে ভবিষ্যতের জন্য লড়ে যাওয়া এই প্রজন্মকে কি ধৈর্যহীনতার জন্য দোষারোপ করা যায়? বোধহয় যায় না। তেমনই কিছু ছেলেমেয়ের গল্প বলতে চেয়েছেন অঞ্জন তাঁর প্রথম ছবিতে।
টুসি (ইশা) আর নীলের (অনুভব) দেখা হয় বন্ধুদের আড্ডায়। দুজনেই শহরতলী থেকে কলকাতায় চাকরি করতে আসা শিক্ষিত ছেলেমেয়ে। কিন্তু শহরে আস্তানার অভাবে দুজনেরই অবস্থা কিছুটা একরকম। এই অবস্থায় উপায় বার করে টুসির সহকর্মী পিকুদা (রাহুল)। সে দুজনকে একই ফ্ল্যাটে থাকার পরামর্শ দেয়। তাতে টাকাও বাঁচবে, আবার পছন্দসই ফ্ল্যাটও পাওয়া যাবে। খানিক দোনামোনা করে অবশেষে দুজনেই রাজি হয়ে যায়। একই বাড়িতে থাকতে গিয়ে ঘনিষ্ঠ হয় বন্ধুত্ব, গড়ে ওঠে ভালোবাসা। অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে টুসি। আর তখনই এসব দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেয় নীল। গল্পটা এই অবধি বেশ চেনা। আসল গল্প শুরু হয় যখন টুসির বাবা-মা কলকাতায় চলে আসেন ‘মেয়ে-জামাই’কে দেখতে।
আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি
আজকের যুগে নারী-পুরুষের শারীরিক সম্পর্ক এমন কিছু মহার্ঘ্য বিষয় নয় যে তাই নিয়ে ঢাকঢোল পেটাতে হবে। সেভাবে ভালোবাসা না থাকলেও শুধু বন্ধুত্ব থেকেও আসতেই পারে শারীরিক টান, ব্যাপারটা দোষের কিছু নয় বলেই মনে করা হয়। আজকের প্রজন্মের কাছে এটা খুবই স্বাভাবিক। শারীরিক সম্পর্ক থাকলে আগামীদিনে বিয়ে করতেই হবে এমনটাও কেউ ভাবে না আর। তবু এসবের পরেও একটা কিন্তু থেকে যায়। ঘরে বাইরে আমরা যতটা পাল্টেছি, যতটা শিখেছি বা প্রতিদিন শিখছি, এই সমস্ত আত্মোপলব্ধির পরেও থেকে যায় আস্ত একটা সমাজ। কয়েক শতাব্দী পেরিয়েও যার চিন্তাভাবনার ধারা বাইরে যতটা আধুনিক ভেতরে ঠিক ততটাই প্রাচীন। তাই এখনও পূর্ববর্তী প্রজন্ম মেনে নিতে পারে না বিয়ে ছাড়া কীভাবে দুটি ছেলেমেয়ে একসঙ্গে থাকবে।
ছবির ক্লাইম্যাক্স আর একটু সিরিয়াস হতে পারতো। এত সমস্যার সমাধান কেমন যেন এক নিমেষে হয়ে গেল। বাস্তবে তা হয় না। তবু ছবির পর্দা বলেই ফিল গুড ব্যাপারটার একটা আলাদা মাহাত্ম্য থেকেই যায়। সে জায়গায় এ ছবি সফল।
নাট্য পরিচালক বলেই বোধহয় অঞ্জনের পরিচালনা এতটা ঝরঝরে, মেদহীন। বাংলা ছবিতে এই ধরনের পরিস্থিতিকে এতদিন যেভাবে কমেডির মোড়কে দেখানো হয়েছে, তাতে আর যাই হোক আসল সমস্যাকে সামনে আনা হয় না। এই ছবির সার্থকতা সেখানেই। কোনও সমস্যাকেই কমেডি দিয়ে আড়াল করা হয়নি, বরং টুসি ও নীলকে বাস্তবের মতো করেই তার সামনে দাঁড়াতে বাধ্য করা হয়েছে। বাংলা ছবির দর্শকের একাংশকে ইদানিংকালে যে সব পরিচালক দায়িত্ব নিয়ে কিছুটা প্রাপ্তমনস্ক করে তুলতে পেরেছেন, অঞ্জন তাঁদের মধ্যে নবতম সংযোজন, সামাজিক সমস্যাকে যথেষ্ট স্মার্ট, বাস্তবিক ও ন্যাকামিবর্জিত আঙ্গিকে উপস্থিত করার জন্য।
আরও পড়ুন: মুখে কথা নেই, হত্যাকারীর চরিত্রে অনির্বাণ
চরিত্রের প্রয়োজনে এবং চিত্রনাট্য সহায় হলে স্বল্প পরিসরেও কী করা যায় তা দেখিয়েছেন এই ছবির তিন সিনিয়র অভিনেতা শুভাশিস, তুলিকা ও বিশ্বজিত। দেবলীনার কথা আলাদাভাবে বলতেই হয়। কলাবতীর চরিত্রে তাঁর অভিনয় প্রশংসার দাবি রাখে। তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি ও কমিক টাইমিং টুসির ডিপ্রেশনকে সুন্দরভাবে ঢেকে দেয় বারবার।
মূল চারটি চরিত্রের মধ্যে পূজা (সায়নী) ও পিকুকে এই ছবির মেরুদন্ড বলা যায়। পূজা যেমনই হোক তার অতীত, বেড়ে ওঠা, প্রতিদিনের লড়াই কোথাও গিয়ে তার প্রতি একটা সহানুভূতি তৈরি করে দেয়। সায়নী খুব সাবলীলভাবে মিশে গেছেন চরিত্রটির সঙ্গে। পিকুর চরিত্র রাহুলও সহজ ও স্বাভাবিক। যেমনটা হওয়া উচিত ছিল।
আরও পড়ুন: রাতের কলকাতায় বিপদের মুখে বনি-কৌশানি
সবশেষে নায়ক ও নায়িকার কথা। ২০২২-এ মুক্তি পেলেও এ ছবির শুটিং শেষ হয়েছে ২০১৯-এ। সে সময় ইশা মোটামুটি চেনামুখ হয়ে উঠলেও অনুভব ছিলেন নিতান্তই আনকোরা। কিন্তু ছবিতে দুজনেই সমান উজ্জ্বল এবং বিশ্বাসযোগ্য। মুক্তির দিক থেকে অনুভবের এটি চতুর্থ ছবি। যেভাবে নানারঙের চরিত্রে তিনি নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছেন তাতে আগামীদিনে আরও কঠিন চরিত্র তাঁর ঝুলিতে গেলে আশ্চর্যের কিছু নেই। ইশা নিজের মতোই সুন্দর ও সোজাসাপ্টা। ‘সোয়েটার’-এর পর এমন একটি ঋজু ও আবেগী চরিত্র তাঁর কেরিয়ারে প্রয়োজন ছিল।
সৌম্য ঋতের সুরে ছবির গানগুলি সুন্দর। রূপঙ্কর বাগচীর কণ্ঠে ‘ওই উঠোনে’ ও দুর্নিবার সাহার গলায় ‘প্রজাপতি’ গান দুটি শুনতে বেশ ভালো লাগে। অনির্বাণ মাইতির সম্পাদনা প্রশংসাযোগ্য।
গতকাল প্রিমিয়র শোয়ের শুরুতে অঞ্জন বললেন, ছবির কিছুটাও অন্তত তিনি যদি দর্শককে ভালো না লাগাতে পারেন তাহলে তিনি আবার থিয়েটারে ফিরে যাবেন। ‘সহবাসে’ এত সহজে তাঁকে ফিরে যেতে দেবে বলে মনে হয় না। ছবির নির্মাণই বলে দেয় তিনি থাকতে এসেছেন। ভবিষ্যতে আরও পরিণত বিষয়ের ওপর ছবির আশা রইল তাঁর কাছে।