আসল গোয়েন্দা

“ওনার কয়েকটা বই পড়েই তো গোয়েন্দা হওয়ার ভূত চেপেছিল মাথায়।”

“কয়েকটা? সবগুলো নয়?”

“না ভাই। গল্পের বই কেনার মত পয়সা ছিল না। তবে ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’টা দারুণ লেগেছিল। কোনও ভিলেন নেই। কিন্তু তাও কেমন বুদ্ধি খাটিয়ে কিনারা করল। হেঁয়ালির জট ছাড়ানোটাও অসাধারণ।”

“আর সিনেমা?”

“‘সোনার কেল্লা’ দেখেছি। আর কিছু হিন্দী-ইংরেজি ছবি।”

আমার ব্যাগ থেকে সামনের টেবিলের ওপর রাখা ফেলুদা সিরিজ়ের দুটো বই। ‘বাদশাহী আংটি’ আর ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’। এই একটা মাঝারি মাপের টেবিলেই গোটা ঘর ভরে গেছে। বাকি আসবাব বলতে একটা বেঁটে আলমারি আর কয়েকটা প্লাস্টিকের চেয়ার। কলুটোলার মারকাজ়ি মসজিদের অনতিদূরে এক প্রায়ান্ধকার গলি। হরিণবাড়ি ফার্স্ট লেন। সাংবাদিক সহকর্মী শান্তনু বিশ্বাস হদিস দিয়েছিল এই বেসরকারী গোয়েন্দা সংস্থার। সান ডিটেকটিভ এজেন্সী। তারই কর্ণধার বছর পঞ্চান্নর রণদেববাবু উত্তর দিচ্ছিলেন আমার প্রশ্নের। অফিসের পরিবেশও গলির সঙ্গে মানানসই। একটা টিউবলাইট আছে বলে রক্ষা, তা না হলে রণদেববাবুর অফিসে দিনেরবেলাতেও দুহাত দূরে থাকা মানুষ দেখা যেত কি না সন্দেহ।




“কিরকম কেস পান আপনারা?”

“কোথায় কেস? কোনওমতে টিমটিম করে চলছে। কখনও-সখনও আসে দু-একটা। তাও আপনারা গল্পে যেমন পড়েন, তেমনটা মোটেই নয়। রহস্যের নামগন্ধ থাকে না তাতে।”

“যেমন?”

“যেমন বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রী সম্বন্ধে খোঁজখবর। তাও সেটা কালেভদ্রে। নব্বইয়ের দশক অবধি মাসে এরকম কেস বেশ কয়েকটা আসত। ইদানিং আর আসে না।”

“কেন?”

“শহরে সম্বন্ধ করে বিয়ে করার চল প্রায় উঠেই গেছে। ছেলেমেয়েরা আজকাল নিজেরাই পছন্দ করে বিয়ে করে। দুই পরিবারের যোগাযোগ আগে থেকেই জানা হয়ে যায়। ব্যাকগ্রাউণ্ড চেক-এর জন্য বিয়ে অবধি কেউ আর অপেক্ষা করে না।”

দ্রৌপদীর থাক পাঁচ, তুই বাপু একটা নিয়েই বাঁচ

রণদেববাবুর কাজের লোক বিজয় দুকাপ চা দিয়ে গেছে। নিজের করা নয়, দোকান থেকে কিনে আনা। পরে জেনেছিলাম বিজয় রণদেববাবুর খাস লোক নয়। পাশে একটি লেদ মেশিনের কারখানারও বেয়ারা সে। বিজয় যে শুধু চা-জলখাবার এনে দেয় তাই নয়, প্রয়োজনে রণদেববাবু  তাকে তাঁর গোয়েন্দাগিরির কাজেও ব্যবহার করেন। বছর একুশ  বয়স, তুখোর ছেলে।

“হুম,” চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম আমি। “আর অন্য কোনও কেস আসে না?”

“অন্য কেস মানে? খুন, রাহাজানি?”

“হ্যাঁ।”

“না মশাই,” বিষণ্ণ হাসলেন রণদেববাবু। “খুন তো অনেক বড় ব্যাপার। ছোটোখাটো চুরি ছিনতাই হলেও লোকে পুলিশ ডাকে। গাঁটের পয়সা খরচ করে কেউ প্রাইভেট গোয়েন্দা ডাকে না। ওসব আপনার বইতেই থাকে। তাছাড়া পুলিশকে খবর না দিলে কেসটা লিগাল হয় না। আমরা তো আর এফআইআর নিতে পারব না।”

real private detective

“কিরকম টাকা নেন আপনারা?”

“‘আপনারা’ বলে কেউ নেই এখানে,” ম্লান হাসলেন রণদেববাবু। “আমিই সব। যখন শুরু করেছিলাম তখন পার্টনার ছিল একজন। তবে খুব বেশিদিন টেকেনি। ভালো চাকরি পেয়ে গেল। তারপর এজেন্সি ছেড়ে দিল।”

“যাই হোক, বিয়ের খোঁজখবর করতে কত নেন?”

“সেটা পার্টি বুঝে। সাধারণ মক্কেল হলে হাজার বিশেক বলি। তারপর দরদাম করে ওই সতেরো-আঠারোয় রফা হয়। মালদার পার্টি হলে আরও বেশি। তবে সেরকম কেউ আসে না খুব একটা।”

“অন্য ধরণের কাজ কিরকম আসে?”

“ফলো করি,” মৃদু হেসে বললেন রণদেববাবু।

“ফলো? কাকে?”

“যে সব স্ত্রী তাদের স্বামীদের সন্দেহ করে অন্য সম্পর্কে লিপ্ত থাকার, সেই সব লোকদের। তাদের বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের খবর এনে দিই।”

বিশ্বনাথের বারাণসী, বারাণসীর বিসমিল্লাহ

“তার মানে সারাদিন তাদের পেছন-পেছন ঘুরতে হয়?”

“তা তো হয়ই,” মাথা নেড়ে বললেন রণদেববাবু। “আমার বাইক আছে তাই সুবিধা। মাঝে-মাঝে সারাদিন হয়ত কোনও অফিসের বাইরে বসে থেকেই কেটে যায়। তবে বেশি সময় লাগে না। দু-তিন দিনের মধ্যেই বোঝা যায় কোন পুরুষের মনে কি আছে।”

“এক্ষত্রে কি মক্কেল সবাই মহিলা? পুরুষ নেই?”

“মহিলা মক্কেলই বেশি। তবে তাদের সন্দেহ যে সবসময় সত্যি হয় তা নয়। একবার এক ভদ্রমহিলা এসেছিলেন। তার স্বামী হঠাৎ কেন দেরি করে বাড়ি ফিরছেন সেটা জেনে দিতে হবে। ভদ্রলোকের অফিসের বাইরে একদিন দুপুর থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। ক্যামাক স্ট্রীটে। ছুটির পর ভদ্রলোক বেরোলেন। অফিসের উল্টোদিকে একটা হোটেল থেকে ক্যাসারোলে ভাত আর মুরগীর ছাঁট মাংস কিনলেন। তারপর সেটা নিয়ে সটান ঢুকে গেলেন প্রিটোরিয়া স্ট্রীটে। জ্ঞান মঞ্চের পাশে—রাস্তার কোনায়—কতগুলো কুকুর ওরই জন্য অপেক্ষা করছিল। তিনি খুব যত্ন করে ওই কুকুরগুলোকে খাওয়ালেন। তারপর নিজে এক কাপ চা খেয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলেন। পরপর তিনদিন ওনার পেছনে ঘুরেছিলাম। প্রতিদিন একই রুটিন। তারপর মোবাইলে ছবি তুলে এনে ভদ্রমহিলাকে দিই।”

“এই সামান্য কারণের জন্য কেউ গোয়েন্দা লাগায়? মহিলা তার স্বামীকে সরাসরি জিজ্ঞস করলেই তো পারতেন।”

“সে জানি না মশাই। তবে ভদ্রমহিলার কুকুরে খুব এলার্জি ছিল। তাই বোধহয় ওনার স্বামী ওকে কিছু বলেননি।”

খেল দিখা সকোগে না?

“ইন্টারেস্টিং।”

“তা বটে,” হেসে বললেন রণদেববাবু। “তবে ঝামেলাও আছে এই লাইনে। ইন ফ্যাক্ট মারও খেতে হয়েছে।”

“সে কি?” আমার আশ্চর্য হবার পালা।

“একটা লোকের পিছু পিছু খিদিরপুরের একটা গলিতে ঢুকে যাই। লোকটা যে আমাকে খেয়াল করছে সেটা বুঝতে পারিনি। একটা মোড় ঘুরতেই দু-তিনটে লোক ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর। তারপর মাটিতে ফেলে বেদম মার।”

“তারপর?”

“তারপর আর কি? সারা গায়ে ব্যথা নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। বউ কথা শোনালো অনেক। সুস্থ হতে কয়েকদিন টাইম লেগেছিল।”

“এরকম ঘটনা আরও ঘটেছে না কি?”

“নাহ্। ওই একবারই। তারপরেই বাইক কিনব ঠিক করি।”

গান শেষ আর জান শেষ তো একই কথা রাজামশাই

“কোনও অ্যাসিস্ট্যান্ট নেননি কখনও?”

“ধুস্‌। কে আর ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে আসবে বলুন? ওই বিজয়ই যা একটু হেল্প করে মাঝেমাঝে। আর তাছাড়া—”

“তাছাড়া?”

“আমিও আর বেশিদিন এই লাইনে নেই। আজকাল আর ভালো লাগে না। বেশিরভাগ দিনই তো মাছি তাড়াতে হয়,” রণদেববাবুর গলায় হতাশা।

“গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দেবেন?”

“কোথায় গোয়েন্দাগিরি? যা করছি তাকে কি গোয়েন্দাগিরি বলে না কি? অনেক হল, আর নয়। ছেলেটা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে ভূবনেশ্বরে। ক্যাম্পাসিং হয়ে গেছে। কলকাতারই একটা কোম্পানিতে কল পেয়েছে। ও দাঁড়িয়ে গেলে আমার নিশ্চিন্তি। অফিসঘরটা রেখে দেব। এই ভাড়ায় তো আর অন্য কোথাও অফিস পাব না কলকাতা শহরে।”

উত্তর থেকে দক্ষিণ, খণ্ডচিত্রে কলকাতার প্রায় সমস্ত বেসরকারী গোয়েন্দাদেরই এক অবস্থা। রহস্য বলতে যা বোঝায়, যেমনটা ফেলু বা ব্যোমকেশের গল্পে পাওয়া যায়, তার ছিঁটেফোঁটাও থাকে না এদের জীবনে। সবই মোটা দাগের কাজ, মাথা খাটানোর সেখানে কোনও বালাই নেই।

যে মৃত্যু আজও রহস্য

যেমন বললেন ভ্যানগার্ড ইনভেস্টিগেটরস-এর সুকুমার দত্ত। এনার অবস্থা রণদেববাবুর থেকে কিছুটা হলেও ভালো। অফিসটাও বেশ গোছানো। “রেগুলার মক্কেল আছে দু-একজন। তবে শাঁসালো মক্কেল বলতে যা বোঝায় তেমন কেউ নেই। এদিক-ওদিক থেকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে চলে যায় আর কি।”

“মাথা খাটানোর মত কোনও কেস পান না?”

“ধুর, ধুর। গল্পের গোয়েন্দার সঙ্গে কোনও মিলই নেই আমাদের। পুলিশ ছাড়া গোয়েন্দা হয় না দাদা। আপনার বাড়িতে চুরি হলে কি আপনি পুলিশে যাবেন, না আমাকে ডাকবেন? আর আসবেনই বা কেন বলুন? চুরি বা খুনের মামলার তদন্ত করতে গেলে যে পরিকাঠামো লাগে, তা তো আর আমাদের নেই।”

সুকুমারবাবুর কয়েকজন উকিল মক্কেল আছেন। তাদেরই কোনও ফৌজদারী মামলার প্রমাণ জোগাড় করে দেওয়ার কাজ করেন মাঝে-মাঝে।

ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। তবে তা নিতান্তই হাতে গোনা। শান্তনুর দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী হাজির হলাম লেনিন সরণীর ক্যাট্‌স আই লিগাল সার্ভিসেস-এ। এরা অবশ্য পুরোটাই বেসরকরী গোয়েন্দা সংস্থা নন। আইনী উপদেশও দিয়ে থাকেন।

“বাজারে আমাদের মতন আর কোনও কোম্পানি নেই দাদা। অমরা তদন্তে টেকনোলজি ব্যবহার করি, যা আর কেউ করে না,” দাবী করলেন ক্যাট্‌স আই-এর কর্ণধার রবিশঙ্ককর আগরওয়াল। তিন পুরুষ কলকাতায় বাস, ঝরঝরে বাংলা বলেন।

real private detective

“টেকনোলজি মানে?”

“যেমন ধরুন লুকোনো ক্যামেরা বা সাউন্ড রেকর্ডার। শব্দ বা লাইভ ভিডিও তুলে নিয়ে গিয়ে মক্কেলদের দিই। অনেক রকম ক্যামেরা আছে আমাদের। পেন, ঘড়ি, গলার লকেট। যে কাজে যেমন লাগে।”

“কি রকম কেস আসে আপনাদের?”

“কর্পোরেট ক্লায়েন্টই বেশি। সবাই প্রায় বাঁধা মক্কেল। তাদের কম্পিটিটরদের খবর জোগার করে দিতে হয়। কে কোন পণ্য বাজারে ছাড়ছে বা অন্য কোনও গোপন খবর যেটা জানতে পারলে আমাদের মক্কেলের ব্যাবসায়িক সুবিধা হবে। প্রাইভেট মক্কেল আমাদের বেশি নেই।”

“খবর জোগার করেন কি করে? কেউ তো আর যেচে খবর দেবে না।”

“না, তা তো নয়ই,” হেসে বললেন রবিশঙ্কর। “বরং ঠিক তার উল্টো। চাকরি যাওয়ার ভয়ে মুখ খোলে না প্রায় কেউই। তখন যাকে বলে পাম গ্রিজ়িং করতে হয়।”

“মানে ঘুষ?”

“ঘুষ। আর তাতেই বেশিরভাগ কাজ হয়ে যায়। অনেকে আবার টাকা নেয় না। ভালো হুইস্কি বা দামী কোনও হোটেলে খাওয়াতে হয়। খরচ অবশ্য মক্কেলরাই দেন। তবে আমাদের পকেট থেকেও যায় মাঝে-মাঝে।”




আমার রিপন লেন-এর গোরস্থানে ফেলুদার ঘুষ দেওয়ার কথা মনে পড়ে গেল।

“তার মানে ক্রাইম আপনারাও কম করেন না,” হেসে বললাম আমি।

“হাঃ হাঃ। না তা তো নয়ই,” বললেন রবিশঙ্কর। “তবে ডাবল ক্রস করি না কখনও। কলকাতার বাইরেও অনেক কাজ করি আমরা। শিলিগুড়ি, পাটনা, আহমেদাবাদ, এমন কি দিল্লী আর মুম্বইতেও আমাদের মক্কেল আছে।”

ফোনে আড়ি পাতা, সন্তানের গতিবিধির ওপর নজর রাখা, নিরুদ্দেশ সম্পর্কে খোঁজখবর আনা, চুম্বকে এই হল বেসরকারী গোয়েন্দাদের জীবন। এই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদের। আসল গোয়েন্দা এরাই। রণদেববাবুরা জানেন মগজাস্ত্র প্রয়োগ করার ডাক এজন্মে আসবে না। তাই পেটের খাতিরে, গোয়েন্দাগিরির নামে যে কাজই আসুক না কেন, সেটাই তাদের করতে হয়। বাছবিচার করা এখানে বিলাসিতা। বরং প্রতিদ্বন্দী সংস্থার খবর এনে দিতে পারলে বেশ টু-পাইস কামানো যায়। আসল বেসরকারী গোয়েন্দা এরাই। রাস্তার মোড়ে যে লোকটাকে নিবিষ্ট মনে লেড়ো বিস্কুট সহযোগে চা খেতে দেখলে কেউ ফিরেও তাকাবে না, তারই হয়ত চোখ রয়েছে উল্টোদিকের ফ্ল্যাটবাড়ির তে’তলার বারান্দায়, যেখানে একটি লোক এক্ষুণি স্নান সেরে উঠে ভেজা তোয়ালেটা মেলে দিল অফিস যাওয়ার উপক্রমে।

প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর বা সত্যান্বেষী, যে নামেই তাদের ডাকা হোক না কেন, উটের পিঠে চড়ে দুষ্টু লোক ধাওয়া করতে তাদের দেখা যাবে না কোনওদিনই।

মগজাস্ত্র ২০১৭ ওয়েব ম্যাগ-এ প্রথম প্রকাশিত

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
5

Prabuddha

Foodie, lazy, bookworm, and internet junkie. All in that order. Loves to floor the accelerator. Mad about the Himalayas and its trekking trails. Forester in past life. An avid swimmer. Also an occasional writer and editor

One thought on “আসল গোয়েন্দা

  • Khub interesting article. Chotobelate amaro iche chilo goenda hobo. Pore asol goendader kajkormer Sharon jene se iche chole gechilo. Recently Budhadeb Dasgupta bodhoy ei dhoroner goendader nie ekta cinema banachilen with Nawazuddin in lead

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *