খেল দিখা সকোগে না?
ধরা যাক মুকুল রাজস্থান গেছে ডাক্তার হাজরার সঙ্গে। এ কেল্লা সে কেল্লা দেখতে-দেখতে তারা যোধপুর সার্কিট হাউস পৌঁছল এবং নকল হাজরার সঙ্গে দেখাও হয়ে গেল। সেও কোনও দুর্বুদ্ধি প্রয়োগ করে মুকুলকে হাতিয়ে নিয়ে জয়সলমীর গিয়ে সোনার কেল্লা খুঁজে বার করল আর ফেলুদা গিয়ে তাকে শায়েস্তা করল। এরকম হলে গল্পটা জমত কি? বোধহয় না।
আসলে মন্দার বোসের উপস্থিতি ছাড়া পুরো ‘সোনার কেল্লা’ ছবিটাই ফিকে। ধর্মতলা থেকে কেনা সস্তার লেদার জ্যাকেট আর বাটার জুতো, তাও আবার পরের দ্রব্য, সেই পরেই আদ্যোপান্ত একটি বর্ণময় চরিত্রকে পর্দায় যিনি জীবন্ত করে তুলছিলেন তিনি কামু মুখোপাধ্যায়। এক অসামান্য অভিনেতা, যিনি যে কোনও চরিত্রে, যে কোনও পরিসরে নিজেকে মেলে ধরতে পারতেন অনায়াসে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তিনি তাঁর সমস্ত অভিনয় জীবনে ছোটবড় নানান চরিত্রের ভিড়ে মাত্র একটি ছবিতেই মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করার সুযোগ পেলেন। এ বোধহয় শুধু ভারতবর্ষেই সম্ভব।
আরও পড়ুন: তিন মূর্তি ও পায়ের তলায় সরষে
চলচ্চিত্রে কামুর আত্মপ্রকাশ সম্ভবত ১৯৫৯ সালে ‘সোনার হরিণ’ ছবিতে, আবদাল্লার চরিত্রে। আগাগোড়াই স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রাণবন্ত এই অভিনেতা তারপর একদিন নাকি নিজেই হাজির হয়ে যান সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে। পরিচয় দিয়ে জানান তিনি সত্যজিতের ছবিতে কাজ করতে চান। ব্যস, এইটুকু বলেই তিনি উধাও। সত্যজিৎ কৌতুহলবশে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, আগন্তুক সিনেমাপাড়ায় যাতায়াত করেন, ছোটখাটো যে কোনও চরিত্র পেলে কাজ করে থাকেন।
সত্যজিতের সঙ্গে কামুর প্রথম কাজ করার সুযোগ মিলল ‘চারুলতা’ ছবিতে, ভূপতির বন্ধুর ভূমিকায় একটিমাত্র দৃশ্যে। শোনা যায় কামু একটু হতাশ হয়েছিলেন এত ছোট চরিত্র পেয়ে। পরিচালক তাঁকে বলেন, ছোট চরিত্রে নিজেকে ফুটিয়ে তোলার মধ্যেই আসল অভিনেতার দক্ষতা রয়েছে। সম্ভবত সেই কথাটিকেই তাঁর জীবনের মূল মন্ত্র করেছিলেন কামু। ভূপতির বাড়িতে এক ঘরোয়া পার্টির দৃশ্যে, চশমা ঠিক করতে-করতে বিশ্ববন্ধু পত্রিকায় চারুলতার লেখা দেখার একটি শট দিয়েছিলেন কামু। জহুরি জহর চিনতে ভুল করেননি। ওই একটি শটেই সত্যজিৎ বুঝে গিয়েছিলেন কী অসামান্য এক অভিনেতার হদিশ পেয়েছেন তিনি।
‘নায়ক’ ছবিতে, রঞ্জিৎ সেনের সঙ্গে
ছোটবড় যে কোনও চরিত্রে কামু ছিলেন অনবদ্য এবং অপ্রতিরোধ্য। এরপর একে-একে তাঁকে দেখা যায় ‘কখনো মেঘ’, ‘কমললতা’, ‘মৌচাক’, ‘স্বয়ংসিদ্ধা’, ‘হংসরাজ’, ‘পাকা দেখা’, ‘গুপি বাঘা ফিরে এলো’ ও আরও অনেক ছবিতে। তবে সত্যজিতের ছবিতেই তাঁর অভিনয় দক্ষতা প্রকাশ পেয়েছিল সব থেকে বেশি। অভিনেতা হিসেবে কাজ করেছেন ‘নায়ক’, ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ও ‘শাখা প্রশাখা’ ছবিতে।
আরও পড়ুন: রক্তবরণ মুগ্ধকরণ
মন্দার বোসের চরিত্র ছাড়া কামুর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিনয় সন্দীপ রায়ের ‘ফটিকচাঁদ’ ছবিতে, যেখানে তিনি ছিলেন মুখ্য ভূমিকায়। তবে কামুর তিনটি সেরা অভিনয় বেছে নিতে হলে ‘ফটিকচাঁদ’ আসবে দু’নম্বরে। একে অবশ্যই মন্দার বোস। ওরকম একটি সাংঘাতিক চরিত্র, যে কী না কাঁকড়া বিছে ধরতে পারে, কনকনে ঠাণ্ডায় চলন্ত ট্রেনের হিমশীতল লোহার হাতল ধরে ঝুলে-ঝুলে এক কামরা থেকে অন্য কামরায় চলে যেতে পারে, আবার ঠাণ্ডা মাথায় একটা লোককে ধাক্কা মেরে পাহাড় থেকে ফেলেও দিতে পারে। এই বেপরোয়া ডাকাতটি আবার ট্রেনে বসে সাপলুডো খেলে, মজার-মজার ম্যাজিক দেখিয়ে যা খুশি ভ্যানিশ করে দিতে পারে। এতরকম রঙে রঙিন একটা চরিত্র, বোধহয় এক কামু ছাড়া আর কারও পক্ষেই পর্দায় ফুটিয়ে তোলা সম্ভব ছিল না। সত্যিই নাকি খালি হাতে কাঁকড়া বিছেটি ধরেছিলেন কামু, যদিও সত্যজিৎ ছবি থেকে সেই দৃশ্যটি বাদ দেন। পরিচালকের যুক্তি ছিল, এতে মন্দার বোস যে ফেলুদার থেকে বেশি সাহসী, সেটা প্রমাণ হয়ে যাবে। তা কখনওই হতে দেওয়া যায় না। বলা বাহুল্য, দৃশ্যটি বাদ পড়ায় আশাহত হয়েছিলেন কামু।
আরও পড়ুন: তাশি গাঁওয়ে একদিন
তেমনই ‘ফটিকচাঁদ’ ছবিতে হারুন-অল-রশিদের ভূমিকায় দক্ষ বাজিকরের চারিত্রিক বলিষ্ঠতা তথাকথিত ভদ্রলোককেও লজ্জায় ফেলে দেয়। বাংলা ছবির ইতিহাসে একেবারেই ব্যতিক্রমী এই চরিত্রে অসামান্য রূপদান করেছিলেন কামু।
এরপরেই আসবে ‘নায়ক’-এ প্রিতীশ সরকারের চরিত্রটি, সে যুগের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী মধ্যবিত্ত বাঙালি যে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছতে চায় যে কোনও মূল্যে। একদিকে মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ অন্যদিকে লাগামছাড়া উচ্চাশা, এই দুইয়ের টানাপোড়েন পরিমিত অভিনয়ের মোড়কে অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্যভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন কামু। এই চরিত্রটিতে শহুরে মধ্যবিত্তের মেজাজ এমনভাবে রয়েছে যেখানে অন্য পরিচালক হলে হয়তো অন্য কোনও অভিনেতার কথা ভাবতেন। কিন্তু এখানেই সত্যজিতের তুরুপের তাস ছিলেন কামু। একেবারেই অন্য ধরণের একটি চরিত্র, যে ভূমিকায় দর্শক তাঁকে সেভাবে দেখেনি, সেখানেই তিনি সুযোগ দিলেন কামুকে। কতটা দক্ষতার সঙ্গে উতরে দিয়েছিলেন তিনি, তা ছবিটি না দেখলে বলে বোঝানো অসম্ভব।
আরও পড়ুন: যে মৃত্যু আজও রহস্য
এছাড়া ‘হংসরাজ’ ছবিতেও তাঁর অভিনয় মনে রাখার মতো। গুপি-বাঘা সিরিজ়ের ছবিগুলিতে একাই পাঁচ-ছয়টি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কামু। ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’-এ সত্যজিৎ তাঁকে দিয়ে গানও গাইয়েছিলেন। ‘হাল্লা চলেছে যুদ্ধে’ গানটিতে প্লেব্যাক করেছিলেন কামু ও জহর রায়। ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে কোষাগারের দ্বাররক্ষীর ভূমিকায় একটি দৃশ্যে তিনি দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় সোজা মাটিতে পড়ে যান, যা সজ্ঞানে করা বেশ কঠিন। এমন সব ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা কামুর কাছে ছিল জলভাত।
আর কেই বা ভুলতে পারবে ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবির একটিমাত্র দৃশ্যে অর্জুনের ভূমিকায় তার নাইফ থ্রোয়িংয়ের খেল। কামুর তখন স্বাস্থ্যবান চেহারা। কিন্তু সত্যজিৎ তাঁকে দিয়ে অভিনয় করালেন এক বৃদ্ধের ভূমিকায়। চাকু ছোঁড়ার খেলা দেখানোর আগে মগনলালের প্রশ্ন, ‘খেল দিখা সকোগে না?’ রোগভারে ন্যুব্জ অর্জুনের নির্লিপ্ত উত্তর, ‘থোড়া বুখার হ্যায়, ফির ভি কোই বাত নেহি।’ এই সংলাপ আর তার পরবর্তী দৃশ্য ভোলার নয়।
আরও পড়ুন: সত্যজিৎ ও রেলভূত
অভিনয় ছাড়াও নানান ব্যাপারে উৎসাহী মানুষ ছিলেন কামু। সত্যজিতের বহু ছবিতে ছোটখাটো চরিত্র করার পাশাপাশি ফিল্ম ইউনিটের একজন অপরিহার্য সদস্য হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কাজ করতেন টেকনিশিয়নদের সঙ্গে। আদ্যন্ত আমুদে মানুষ কামু, শ্যুটিংয়ের ফাঁকে পুরো ইউনিটকে মাতিয়ে রাখতেন তাঁর নিত্য নতুন মজা আর দুষ্টুবুদ্ধি দিয়ে। তাঁর রসবোধ ছিল প্রবল। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে ‘আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে’ গানটির দৃশ্যগ্রহণ হবে। প্রয়োজন একটি রোদ ঝলমলে দিন। কিন্তু শ্যুটিংয়ের সময় দেখা গেল, রোদ তো নেই-ই, উল্টে মেঘ জমতে শুরু করেছে আকাশে। গোটা ইউনিট গালে হাত দিয়ে বসে। সূর্যের দেখা না মিললে শ্যুটিং শুরু করা যাবে না। শোনা যায়, এমন সময় উঠে দাঁড়ালেন কামু। সত্যজিতের কাছে এসে বললেন, ‘মানিকদা, ‘আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে’ এই লাইনটা পাল্টে, আহা কী আনন্দ ফ্যাকাশে আকাশে করে দিন। তাহলেই এক্ষুণি শ্যুটিং চালু করে দেওয়া যাবে।’ গোটা ইউনিটে হাসির রোল উঠল।
যাই হোক, রোদের দেখা মিলেছিল কিছুক্ষণের মধ্যেই, আর গানের কথাও পরিবর্তন করার প্রয়োজন পড়েনি।
‘ফটিকচাঁদ’, হারুন-অল-রশিদের ভূমিকায়
মজা করতে গিয়ে কামু যে কাউকেই রেয়াত করতেন না, তার প্রমাণ পাওয়া যায় আরেকটি ঘটনায়। একদিন সত্যজিতের সঙ্গে কোনও একটি ব্যাপারে আলোচনা করতে তাঁর বাড়িতে গিয়েছেন কামু। সত্যজিতের স্ত্রী বিজয়া রায় দুজনকেই চা বিস্কুট দিয়ে গেছেন। বিস্কুটগুলো মিইয়ে গেছিল। কামু সটান বিজয়াকে প্রশ্ন করলেন, ‘বৌঠান, বিস্কুটে কি সাইলেন্সার লাগিয়ে রেখেছেন নাকি?’
এমনকি রাজস্থানে শ্যুটিং করতে গিয়ে গোটা ইউনিটের সকলের জুতো লুকিয়ে রেখেছেন এমনও ঘটনাও ঘটেছে। কাশীর গলিতে ষাঁড় না পাওয়া গেলে ডাক পড়ত কামুর। নিজের আমুদে স্বভাবের গুণে এমনভাবে সকলের মন জয় করতেন তিনি যে স্বয়ং সত্যজিৎ বলেছিলেন তাকে নিয়ে একটা গোটা বই লেখা যায়। এমন অভিনেতা বিদেশে জন্মালে তার সঠিক মুল্যায়ন হতো হয়তো। কিন্তু এই বাংলায় তাঁর প্রতিভার যোগ্য সমাদর পাননি কামু। সত্যজিৎ ছাড়া আর কেউই তাঁকে সেভাবে ব্যবহার করেননি। শেষ বয়সে অর্থকষ্ট গ্রাস করেছিল তাঁকে। বহু বছর ধরে বাতে পঙ্গু হয়ে শেষ জীবনটা একেবারেই শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন ‘সোনার কেল্লা’র দুর্ধর্ষ ভিলেন। ২০০৩ সালে ৬ ডিসেম্বর ৭২ বছর বয়সে, সিআইটি রোডের বাড়ি থেকে শেষ যাত্রায় পাড়ি দেন নকল গ্লোবট্রটার।