গান শেষ আর জান শেষ তো একই কথা রাজামশাই
সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ ছবির বিখ্যাত দৃশ্য। এক সময়ের দাপুটে অভিনেতা, মধ্যরাত্রে এসেছেন উদীয়মান নায়কের বাড়ি কাজ চাইতে। দিনের বেলা লোক দেখাদেখি হয়ে যেতে পারে, সেই জন্য মাঝরাতে আসা। যার হাঁকডাকে একটা সময় শ্যুটিং সেটে পরিচালকও কথা বলার সাহস পেতেন না, সেই অভিনেতাকেই কিনা আসতে হলো যে কোনও ছবিতে একটা ছোট রোল পাবার জন্য, আজকের নায়কের কাছে।
বাস্তবের ঘটনাই সত্যজিৎ লিখেছিলেন তাঁর ছবির চিত্রনাট্যে। এমন ঘটনা সত্যিই ঘটে। নাহলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় স্টুডিয়োর বাইরে এক্সট্রারূপে কাজ করতে আসা অভিনেতাদের মধ্যে পঞ্চাশের দশকের ম্যাটিনি আইডল রবীন মজুমদারকে খুঁজে পেতেন না। তাঁর তখন হতদরিদ্র অবস্থা। সময়ের ফের এমনই যে তখন স্টুডিয়োতে ঢোকারও অনুমতি ছিল না ওই অভিনেতার।
তিন মূর্তি ও পায়ের তলায় সরষে
ঘটনাটি জানা যায় স্বয়ং সৌমিত্রর মুখ থেকেই। সম্ভবত টেকনিশিয়ন্স স্টুডিয়োতে সেদিন ওঁর কাজ ছিল। উত্তমকুমার ততদিনে প্রয়াত। কিন্তু প্রত্যেক স্টুডিয়োতে তাঁর মেকআপ রুম তখনও বিশেষভাবে সংরক্ষিত। যে কেউ সে ঘরে ঢুকতে পারত না। একমাত্র ব্যতিক্রম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সেদিন হাতে সময় থাকায় মেকআপ রুমের চারদিকে টাঙানো নানান বিখ্যাত অভিনেতাদের ছবি দেখছিলেন সৌমিত্র। দেখতে দেখতে হঠাৎ এক জায়গায় চোখ আটকে গেল তাঁর। সমস্ত অভিনেতাদের ফটোগ্রাফ রয়েছে অথচ শুধু একটি ছবিই অয়েল পেইন্টিং-এর পোর্ট্রেট। সেই ছবিটি রবীনবাবুর। ব্যাপারটা সৌমিত্রকে বেশ ভাবালো। এর কোনও কারণ খুঁজে পেলেন না তিনি।
রক্তবরণ মুগ্ধকরণ
ঘটনাচক্রে সৌমিত্র সেদিনই জানতে পারেন যে স্টুডিয়োর বাইরে যে সব এক্সট্রা অভিনেতারা কাজের জন্য অপেক্ষা করছেন, তাদের মধ্যে রবীন মজুমদারও আছেন। কিন্তু কিছুতেই তাঁকে ভেতরে আসতে দিতে চায় না স্টুডিয়োর কর্মচারী। উত্তমকুমারের মেকআপ রুমে কোনও এক্সট্রা অভিনেতা কি করে ঢুকতে পারেন? সৌমিত্র জোর করে তাঁকে ভেতরে নিয়ে এলেন। এমন আপ্যায়নে আপ্লুত হলেন রবীনবাবু। ভেতরে এসে সেই ছবির রহস্য জানতে চাওয়ায় এককালের জনপ্রিয় গায়ক-নায়ক জানালেন, এই ছবিটি যে এখানে আছে তা তিনি নিজেও জানতেন না। ১৯৪২ সালে ‘গরমিল’ ছবিতে তাঁর গাওয়া ‘এই কি গো শেষ দান’ প্রচন্ড জনপ্রিয়তা পায়। সেই ছবিরই একটি দৃশ্যে এই অয়েল পেইন্টিংটি ব্যবহার করা হয়েছিল। পরে কোনওভাবে সেই ছবিটিই উত্তমকুমারের মেকআপ রুমে স্থান পায়।
সৌমিত্র পরে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, এই হলো আমাদের সিনেমার জগত। একটি ঘরে যে মানুষের ছবি সন্মানের সঙ্গে ঝোলানো হয়, সেই ঘরে সেই মানুষটিরই ঢোকার অনুমতি নেই।
Advertisement
সত্যজিতের ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে চরণদাসের ভুমিকায় তাঁর অমর সংলাপ, ‘গান শেষ আর জান শেষ তো একই কথা রাজামশাই,’ এখনও মনে আছে দর্শকের। অত বড় অভিনেতা হয়েও কিভাবে নিজেকে মাটিতে মিশিয়ে চরণদাসের মত এক সাধারণ পল্লীগায়ক হয়ে গিয়েছিলেন, তা ১৯৮০ সালের ছবিটি না দেখলে লিখে বোঝানো কঠিন। সেই ছবিতেই বিশিষ্ট গায়ক অমর পালের কণ্ঠে প্রায় কাল্ট হয়ে যাওয়া গান ‘কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়’-তে লিপ দিয়েছিলেন রবীন মজুমদার। অমরবাবু পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ওনার গানে রবীনবাবুর লিপ দেওয়া তার কাছে এক বিরাট সন্মানের ব্যাপার। রবীনবাবুর বোন গৌরী ঘোষ এই কথা শুনে দাদাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুমি অন্য গায়কের গানে লিপ দিলে?’ অর্থাৎ, গায়ক রবীন মজুমদার অন্য কারোর কণ্ঠে লিপ দিতে পারেন, এ ছিল এক অবিশ্বাস্য ঘটনা।
তাশি গাঁওয়ে একদিন
শুনতে অবাক লাগলেও এ কথা সত্যি যে রবীন মজুমদার সর্বমোট ৭৩টি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। অভিনেতা হিসেবে তিনি ছিলেন প্রভূত জনপ্রিয়। তাঁর প্রথম ছবি ‘শাপমুক্তি’ মুক্তি পায় ১৯৪০ সালে। এরপর একে একে আসে ‘গরমিল’, ‘নন্দিতা’, ‘সমাধান’, ‘কবি’, ‘বন্দিতা’, ‘দর্পচূর্ণ’, ‘ঢুলি’, ‘কড়ি ও কোমল’, ‘তাসের ঘর’, ‘চুপি চুপি আসে’, ‘ভগিনী নিবেদিতা’, ‘মোমের আলো’ ও আরও অনেক ছবি। কবি ছবিতে তাঁর অনবদ্য অভিনয় সেই সময় সাড়া ফেলে দিয়েছিল। তাঁর শেষ ছবি হীরক রাজার দেশে।
জনপ্রিয় নায়ক হওয়ার পাশাপাশি রবীনবাবু গায়করূপেও বাঙালি দর্শকের মন জয় করে নিয়েছিলেন। কমল দাশগুপ্তর সুরে তাঁর গাওয়া ‘এই কি গো শেষ দান’ ও ‘বালুকাবেলায় মিছে কি গড়িস খেলাঘর’ সুপারহিট হয়েছিল। এছাড়াও ‘এই যে এলাম শঙ্খনদীর তীরে’, ‘কালো যদি মন্দ তবে’, ‘নাবিক আমার নাবিক ওগো’, ‘দেখা হলো কোন লগনে’, ‘মোর প্রেমগান’, ‘আমি রজনীগন্ধার মতো’ ও আরও বহু গান গেয়েছেন তিনি।
যে মৃত্যু আজও রহস্য
তাঁকে দিয়ে গান গাওয়ানোর জন্য সঙ্গীত পরিচালকরা মুখিয়ে থাকতেন এক সময়। একবার সুরকার রবীন চট্টোপাধ্যায় গেছেন তাঁকে দিয়ে একটি গান গাওয়াবেন বলে। কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না জনপ্রিয় নায়ক-গায়ক। বার বার বলছেন, ‘এই গান আমি গাইবই না।’ সুরকারও নাছোড়। বলছেন, ‘এই গানের জন্যই মানুষ আপনাকে মনে রাখবে।’ অবশেষে জেদ ভাঙলেন রবীন মজুমদার। গাইলেন ‘আমার আঁধার ঘরের প্রদীপ যদি নাই বা জ্বলে।’ সঙ্গীত পরিচালকের কথা মিথ্যে হয়নি। এত দশক পেরিয়ে গানটি আজও সমান জনপ্রিয়।
নায়করূপে বহু ছবিতে চুটিয়ে অভিনয় করেছেন তিনি। কিন্তু একটা সময়ের পর যখন বাংলা সিনেমার জগতে দখল নিচ্ছেন একে একে বসন্ত চৌধুরী, অসিতবরণ, বিকাশ রায়, উত্তমকুমারের মতো শক্তিশালী অভিনেতারা, তখন ধীরে ধীরে চরিত্রাভিনয়ের দিকে সরে আসেন রবীনবাবু। অসিতবরণের সঙ্গে ‘জয়দেব’ ছবিতে তাঁর অভিনয় বাঙালি বহুদিন মনে রাখবে। এছাড়া আরও বহু প্রথম সারির ছবিতে তিনি সহঅভিনেতা হিসেবে নজর কেড়েছেন।
বাংলাদেশে কাজ করতে আমি আর আগ্রহী নই: অরিন্দম
তবু ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না এককালে জনপ্রিয়তার শিখরে থাকা এই গায়ক-নায়কের। শেষ বয়সে অর্থাভাব গ্রাস করে তাঁকে। শোনা যায় একবার সুরকার নচিকেতা ঘোষ তাঁকে অসুস্থ অবস্থায় রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করান। সামান্য কাজের আশায় বিভিন্ন স্টুডিয়োয় ঘুরে বেড়াতেন অতীত দিনের মেগাস্টার। সত্যজিৎ খুঁজে বার করেছিলেন রবীনবাবুকে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের জন্য। সেই তাঁর শেষ ছবি। ১৯৮০ সাল। এর তিন বছর পর ১৯৮৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর লোকচক্ষুর আড়ালে অন্তিম নিঃস্বাস ত্যাগ করেন রবীন মজুমদার। শেষ হয়ে যায় সাদাকোলা ছবির যুগের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
বাঙালি খুব একটা মনে রাখেনি তাঁকে।
সত্যি এত কিছু জানা ছিল না। সমৃদ্ধ হলাম।
ধন্যবাদ লেখিকাকে