দুর্গ রহস্যের দ্বন্দ্ব নাশ?

শ্রীকান্ত গুপ্ত: এক দুর্গ রহস্যে আর এক দুর্গ রহস্য! স্বয়ং লেখক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় দেখলে শিউরে উঠতেন। এমনিতেই তাঁর সৃষ্ট সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী যে একদিন বিপুলভাবে প্রযোজক পাড়ায় অর্থান্বেষী হয়ে উঠবে, তা তিনি মনে হয় দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করে যেতে পারেননি। ব্যোমকেশ, অজিত, সত্যবতীকে নিয়ে টানাপোড়েনের টক্করে নতুন সংযোজন ‘দুর্গ রহস্য’। শরদিন্দুর এই ঐতিহাসিক রহস্য উপন্যাসটিকে নিয়ে একই ইন্ডাস্ট্রির দুই হেভিওয়েট শিবির রীতিমতো তাঁবু ফেলেছে বক্স অফিসের আশেপাশে। শত্রুদের মুখে ছাই দিয়ে দেব ‘ডিটেকটিভ’ ব্যোমকেশের ভূমিকায় সত্যবতী রুক্মিণী মৈত্র ও অজিত অম্বরীশ ভট্টাচার্যকে নিয়ে বিরসা দাশগুপ্তের পরিচালনায় প্রেক্ষাগৃহে আসছে ১১ আগস্ট। অন্যদিকে, সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ওয়েব সিরিজ়ে ‘সত্যান্বেষী’ আসছে আর কিছুদিনের মধ্যেই। সেখানকার হুজ় হু’রা হলেন হালে ‘ব্যোমকেশ’ হিসেবে বাজারে নামডাক হওয়া অনির্বাণ ভট্টাচার্য, রাহুল বন্দোপাধ্যায় (অজিত) ও সোহিনী সরকার (সত্যবতী)। তবে সৃজিতের ভাষায় এ নাকি ব্যাভিচারিনী সত্যবতী। কারণ সোহিনী এর আগে আবির-ব্যোমকেশেরও সত্যবতী সেজেছিলেন। এক সত্যবতীর একাধিক সত্যান্বেষী স্বামী।  

দুই শিবিরের উপজীব্য বিষয়বস্তু এক, ‘দুর্গ রহস্য’। দুই ‘দুর্গ রহস্য’-এর জোড়া ব্যোমকেশ, জোড়া সত্যবতী, জোড়া পরিচালক, জোড়া প্রযোজক ও এক অজিত, সবাই সেদিন শহরের বৃষ্টিমুখর বিকেলে জড়ো হয়েছিলেন বাইপাসের ধারে এক সাততারা হোটেলে। উদ্দেশ্য দুর্গ দখল নয়, দুর্গ সুরক্ষা। ঝগড়াঝাঁটি অনেক হয়েছে। তাতে ক্ষতি দু’তরফেই। তাই এবার সর্বসমক্ষে গলাগলি করে দ্বন্দ্ব নাশ করার লক্ষ্যে ‘হিন্দি-চিনি’। হবে নাই বা কেন? ভাতৃত্ববোধের ভিজ়ুয়াল তুলে ধরে বক্স অফিসের বাঁধন মজবুত করার দিকে নজর দিলে লাভ উভয়পক্ষেরই।

আরও পড়ুন: বাদ পড়লেন তৃণা

“ভীষণ ভালো লাগছে আর এক ব্যোমকেশের ট্রেলার লঞ্চে এসে,” বিনয়ী অনির্বাণের বক্তব্য। ‘আমি অনেকের থেকে জুনিয়র। অনেক পরে এসেছি। আমরাও ‘ব্যোমকেশ ও দুর্গরহস্য’ করেছি। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি নতুন ব্যোমকেশের জন্য।” সত্যবতী সোহিনী শিহরিত, “বাংলা ছবির ইতিহাসেই শুধু নয়, তামাম বিশ্বের যে কোনও ছবির ক্ষেত্রেই এমন সহাবস্থানের ঘটনা ঘটেনি।” সোহিনীর শুভেচ্ছা নতুন সত্যবতী রুক্মিণীকে। সৃজিতের সংকল্প, “আমরা উভয়পক্ষই একই ইন্ডাস্ট্রির। এই বার্তাটা সকলের কাছে পৌঁছনো উচিত। অনেকেই মনে করেন নেগেটিভিটিতেই টিআরপি, তা কিন্তু নয়। পজ়িটিভিটির মধ্যেও অনেক টিআরপি আছে।” শুনে সোহিনী পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, “এই ইভেন্টের মধ্যে দিয়ে আমরা পজিটিভিটির চর্চা শুরু করলাম।“ সৃজিতের সমর্থন, “রাইট। আজ থেকে হ্যাশট্যাগ পাল্টে গেল। #অনমাইওনটার্মস এর বদলে #অনআওয়ারওনটার্মস হয়ে গেল।” 

দেব অভিনীত ছবিটির পরিচালক বিরসা দাশগুপ্তের আহ্বান, “বাংলা ফিল্ম ইডাস্ট্রিকে নিয়ে যদি কোনও সংশয় বা সন্দেহ থাকে, তাহলে এই ছবিটা ছড়িয়ে দিন।” নতুন অজিত অম্বরীশের শ্লেষ মেশানো রসিকতা, “সব বিতর্ক শেষ হয়ে গেল। কী দুঃখ হলো।” রুক্মিণীর বক্তব্য, “দিনের শেষে ডিটেকটিভ হওয়া স্বত্ত্বেও ব্যোমকেশ আদপে একজন ফ্যামিলিম্যান। তার কাছে পরিবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক সেটাকেই রিপ্রেজ়েন্ট করার জন্য আজকে আমরা ‘দুর্গ রহস্য’-এর দুই টিম এক হয়ে পরিবারের মতো আছি। কারণ, প্রতিটি পরিবারের মূল কথা হলো একতাই বল।”

আরও পড়ুন: চেনা ছন্দে গ্যালারি হাঁকালেন করণ

এবার দেব। দেবোচিত বাচনভঙ্গিতে নতুন ব্যোমকেশের বিবৃতি, “যবে থেকে আমরা ছবিটার কথা ঘোষণা করেছি, তবে থেকে দ্বন্দ্ব হচ্ছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়…এতে…ওতে…আমি সবসময় বিতর্ক থেকে দূরে থাকতে চাই। কোথাও যেন মনে হয় এটা সিনেমার ক্ষেত্রে ক্ষতি হবে। সিরিজ়ের ক্ষেত্রেও ক্ষতি হবে। আমরা কোনও দ্বন্দ্ব চাইছিলাম না। আমি চাই ওটিটিতে যখন ব্যোমকেশ আসবে, তখন সেই ব্যোমকেশ যেন আগের সিরিজ়গুলোর সব রেকর্ড ভেঙ্গে দেয়। সেটা যেমন আমার প্রাপ্তি হবে, বড়পর্দায় যখন ‘ব্যোমকেশ ও দুর্গরহস্য’ রিলিজ করবে, অন্যান্য ব্যোমকেশকে সম্মান জানিয়ে বলছি, সেগুলোর থেকে যেন বেশি ভালো হয়। আমি দেখাতে চাই আমাদের মধ্যে কোনও তর্ক বিতর্ক নেই। এটা একটা পরিবার। আমি চাই বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি আরও এগিয়ে যাক। সিনেমা আরও চলূক।” তিনি জানালেন একাধিক শহরে একইসঙ্গে ছবিটি মুক্তি পাবে।



তবে দেব যতই বিতর্ক এড়াতে চান না কেন, তর্কের অবকাশ রয়েই যাচ্ছে নতুন অজিতের অবয়ব নিয়ে। ব্যোমকেশের সঙ্গে এযাবৎ যতগুলো অজিতকে বড়পর্দা, টেলিভিশন বা ওয়েব সিরিজ়ে দেখা গেছে তাঁরা কেউই অম্বরীশের মতো ‘স্বাস্থ্যবান’ নন। এই নিয়ে সমাজ মাধ্যমে ট্রোলের টেমস নদী উত্তাল। সেই গনগুঞ্জনের জবাব দিলেন অম্বরীশ নিজে। “এবার দেখছি আমাকে দেখে মানুষের ভাবনা আচমকা বেড়ে গেছে। অজিত কেন এতো মোটা! আমি জানি না ব্যাক্তি অজিতের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় ছিল কিনা। হয়তো আলাপ ছিল। সত্যি কথা বলতে কী, প্রথমে আমারও একটু অবাক লেগেছিল যখন দেব আমাকে বলল অজিতের চরিত্রে অভিনয় করতে হবে। আসলে আমরা যে অজিতদের দেখে এসেছি, শৈলেন মুখোপাধ্যায় থেকে রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়, কেউই তো ঠিক আমার মতো ছিলেন না, আর সেখানে আমার জোর সবচেয়ে বেশি। অন্যদের মতো আমি নই, একদম আলাদা। তবে আমার মনে হয় কাজটা বা অভিনয়টা দেখার পর কথা বললে ভালো হয়।” আত্মপক্ষ সমর্থন করে অম্বরীশের আত্মবিশ্বাসী আশ্বাস, “আমার মনে হয় আমি খুব ভালো অভিনয় করেছি।”

আরও পড়ুন: বয়স ষাটোর্ধ্ব, সম্পূর্ণ অচেনা লুকে অভিনেত্রী

তাহলে অজিত ভারে ও ধারে দু’দিক থেকেই বেড়েছে নিশ্চয়ই? “সবদিক থেকে বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি, অভিনয়ে দিক থেকে বেড়েছে। ফাটিয়ে দিয়েছি আমি। ভাবতে পারবেন না। ১১ আগস্টের পর কথা বলতে পারবেন না এই অজিতের (নিজেকে দেখিয়ে) পারফরমেন্স দেখে।” স্পষ্ট, চেহারা নিয়ে নিরন্তর সমালোচনায় বিদ্ধ ও বিব্রত অম্বরীশ অন্তরের ক্ষোভ অভিমান উগরে দিলেন শ্লেষমাখা জবাবে। বডি শেমিং নিয়ে অভিনেতার অনায়াস উচ্চারণ, “ওসব পাত্তাই দিই না। চেহারা দিয়ে কী আসে যায়। দিনের শেষে মানুষ আমার অভিনয় নিয়ে কথা বলবেন। আমি মোটা না রোগা, লম্বা না বেঁটে এগুলো কিচ্ছু ম্যাটার করে না।”



অম্বরীশ মনে করেন ট্রোলিংয়ের এর একটা সদর্থক দিকও আছে। হাসতে-হাসতে বললেন, “আমি দেখেছি আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে এমন অনেক অভিনেতা আছেন তাঁরা ট্রোলড না হলে দুঃখে থাকেন। আমি এঁদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, ওঁরা একটুও ভালো থাকেন না। ট্রোলড হওয়া মানে মানুষ তাঁকে নিয়ে ভাবছেন।” অজিত নিয়ে অম্বরীশের বিশ্লেষণ, “আমার শরদিন্দু পড়ে কখনওই মনে হয়নি ব্যোমকেশ-অজিত সমান্তরাল ব্যাক্তিত্ব। আমার বারবারই মনে হয়েছে অজিত এমন একটা চরিত্র যে আসলে অনুসন্ধানী। ব্যোমকেশের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। দর্শক যখন ব্যোমকেশকে হিরো ওয়ারশিপ করে, অজিতও ঠিক সেটাই করে। অজিতের মূল লক্ষ্য একটা গল্পের সন্ধানে ব্যোমকেশের সঙ্গে বেরিয়ে পড়া। একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আছে। অজিত কিন্তু রহস্য, দৌড়দৌড়ি, মারামারি এগুলোর চেয়ে বেশি মানুষ দেখতে পছন্দ করে। ঘটনাগুলো কীভাবে সমাধান করছে ব্যোমকেশ, একজন লেখকের দৃষ্টিকোণ থেকে শরদিন্দু দেখতে চেয়েছেন। কোনওভাবেই অজিত হিরো নয়। আমি বারবারই চেষ্টা করেছি অজিত যাতে ব্যোমকেশের বন্ধু হয়ে থাকতে পারে। দর্শকদের প্রতিনিধি হয়ে থাকতে পারে।”




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *