চেনা ছন্দে গ্যালারি হাঁকালেন করণ

ছবি: রকি অউর রানী কি প্রেম কহানি

পরিচালনা: করণ জোহর

অভিনয়ে: ধর্মেন্দ্র, শবানা আজ়মি, জয়া বচ্চন, আলিয়া ভট্ট, রণবীর সিংহ, চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়, টোটা রায়চৌধুরী, আমির বশির, ক্ষিতি যোগ, অঞ্জলি আনন্দ, নমিত দাস

দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট

RBN রেটিং ★★★★★★★☆☆☆

আরব সাগরের পারে পারিবারিক গল্প নিয়ে ছবি কম হয়নি। হিন্দি ছবির প্রচলিত সংলাপগুলির মধ্যে অন্যতম হলো, এ দেশে শুধুমাত্র একটি ছেলের সঙ্গে একটি মেয়ের বিয়ে হয় না। বরং দুটি পরিবারের মিলন ঘটে। শুনতে ক্লিশে লাগলেও ভারতীয় সামাজিক প্রেক্ষাপটে এ কথা আজও অস্বীকার করার জায়গা নেই। সেই পারিবারিক মিলন ঘটাতে গিয়ে তৈরি হয় নানা গল্প, যা এতকাল ধরে ভারতীয় দর্শক উপভোগ করে এসেছে। তাহলে করণের ছবিতে নতুন কী পাওয়া গেল?



নিউজ় অ্যাঙ্কর বঙ্গললনা রানীর সঙ্গে পাঞ্জাবি মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী রকির ঘটনাচক্রে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিপরীত দুই মেরুর এই দুজনের কখনও মুখোমুখি হওয়ার কথাই নয়। তবু একজনের দাদু আর অন্যজনের ঠাকুমার পরিচিতির যোগসূত্র খুঁজে বার করতে গিয়ে রানী-রকির দেখা হয়ে যায়। তারপর যা হওয়ার ঠিক তাই হয়। তবু দুই পরিবারের মধ্যে মধুর মিলন না হলে তো আর বিয়ে হতে পারে না। অতএব দুই ভিন্ন রুচি এবং ভিন্ন মেজাজের পরিবারকে খুশি করতে একে অপরের বাড়িতে গিয়ে কিছুদিন কাটাবার সিদ্ধান্ত নেয়। নিতান্ত নিরুপায় হয়ে বাড়ির লোকজন সেই সিদ্ধান্তে সায় দেন।

আরও পড়ুন: এবার টেলিভিশনে ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’

এরপর কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। তবে কীভাবে তা ঘটে, সেটা আন্দাজ করতে গেলে কিঞ্চিৎ ধাক্কা খেতে হবে। কারণ ছবি জুড়ে রয়েছে চমকের পর চমক। তালিকা তৈরি করতে গেলে কত নম্বরে গিয়ে শেষ হবে বলা মুশকিল। এ ছবিতে বিগত শতাব্দীর নায়ক নায়িকারা রয়েছেন পর্দা আলো করে। শুধুই কি তারা রকি আর রানীর দাদু-ঠাকুমা? ধর্মেন্দ্রর লিপে যখন ‘অভি না যাও ছোড়কর’, কিংবা তাঁর নিজের গান ‘আজ মৌসম বড়া বেঈমান হ্যায়’ বেজে ওঠে, সমস্ত দর্শকের কাছে সে বড় নস্টালজিক মুহূর্ত! গোটা প্রেক্ষাগৃহ হাততালিতে ফেটে পড়ে অশীতিপর সুপারস্টারকে সেই পুরনো রোমান্টিক মেজাজে দেখে। শবানার গলায় প্রতিবাদী সুর শুনেছেন অনেকেই। কিন্তু তাঁর নিজের গলায় গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত? কিংবা কবিকন্যার গলায় শায়েরির আমেজ? সেই আশির দশকের চেনা শবানাকে যেন আবার নতুন করে ফিরিয়ে দিলেন করণ, শুধু একটু অন্য রূপে। অন্যদিকে রাজনীতির মঞ্চে তাঁর সযত্নে তৈরি করা ব্যতিক্রমী ইমেজকে কাজে লাগিয়ে আগাগোড়া এক গম্ভীর ও দাপুটে চরিত্রে অভিনয় করে গেলেন জয়া।

ছবিতে বাংলা ব্রিগেড ও পাঞ্জাবি ব্রিগেডকে সাজাতে কোথাও কসুর করেননি পরিচালক। ফলে পাঞ্জাবের রঙিন মেজাজ, পেশীশক্তির গর্ব, উঁচু তারে বাঁধা কোলাহলপ্রীতি এবং সারল্যের সঙ্গেই সমানতালে আছে বাঙালির সংস্কৃতি, রুচি, ভদ্রতাবোধ এবং শিক্ষার পরিচয়ও। বাঙালির স্বাভাবিক ব্যক্তিত্ব, ভাষা কিংবা চালচলনকে বিকৃত না করে এর আগে মূলধারার কোনও হিন্দি ছবিতে এভাবে সন্মান দেওয়া হয়েছে কিনা মনে পড়ে না। সর্বভারতীয় ছবিতে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি দর্শককে শ্রদ্ধাশীল করে তোলার জন্য করণকে ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন: পরমব্রতর পরিচালনায় ঋত্বিক?

তবে চমকের এখানেই শেষ নয়। কারণ সম্ভবত সবচেয়ে বড় চমকটা বাঙালি দর্শকের কথা ভেবেই আস্তিনের ভেতর গুটিয়ে রেখেছিলেন করণ। এ ছবির সবথেকে বড় চমক টোটার স্টেজ পারফরমেন্স। সে যেমন-তেমন নাচ নয়, একেবারে কত্থক! টোটা নাচতে জানেন সেটা বহু আগে বাংলা ছবির দর্শক জেনেছেন। কিন্তু তালিম পেলে তিনি যে শাস্ত্রীয় নৃত্যেও এমন পারদর্শিতা দেখাতে পারেন এটা বোধহয় করণের আগে কেউ ভাবেননি। হিন্দি ছবিতে নাচ, তাও আবার রণবীরের মতো অভিনেতার সঙ্গে, এবং যে-সে গানে নয়। কোন গানে? সেটা না হয় দর্শকের জন্য সারপ্রাইজ় থাকুক। তেমনই চূর্ণী। ভালো অভিনেত্রী মানেই তিনি শুধু সিরিয়াস ছবিতে অভিনয় প্রতিভা দেখাবেন এটা নেহাতই একটা মিথ, প্রমাণ করলেন তিনি।

চেনা ছন্দে

সাত বছর লেগে গেল করণের পরিচালনায় ফিরতে। ২০১৬ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল’। মোটামুটি ব্যবসা করলেও অন্য এক কারণে ছবিটি বিতর্কিত হয়েছিল। অভিযোগ ছিল, চরিত্রদের মুখে বসানো কিছু সংলাপের দ্বারা মহম্মদ রফির মতো সঙ্গীতশিল্পীকে ছোট করা হয়। যদিও সেটা চরিত্রটির অগভীরতা বোঝাতেই করা হয়েছিল, তবু সে সময় এই নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। অবশেষে রকি ও রানীর মাধ্যমে সেই ঘটনার প্রায়শ্চিত্ত করলেন করণ। ছবিতে অজস্রবার ঘুরেফিরে এল রফির বিভিন্ন গান। কখনও আসলের মতো করেই গাওয়া, আবার কখনও রিমিক্স। এমনকি ১৯৬৬ সালের গান ‘সুনো সুনো মিস চ্যাটার্জি’ যে রকি ও রানীর ক্ষেত্রে এমন যুতসইভাবে লেগে যাবে সেটাও চমকে দেওয়ার মতোই ব্যাপার।

আরও পড়ুন: বয়স ষাটোর্ধ্ব, সম্পূর্ণ অচেনা লুকে অভিনেত্রী

চেনা ছন্দে, করণ-সুলভ সংলাপের স্টাইল পর্দায় ভরপুর কমেডি এবং আবেগের বন্যা বইয়ে দিলেও আলাদাভাবে উল্লেখযোগ্য এ ছবির রসায়নের তালিকাও। রণবীর ও আলিয়া এর আগেও একসঙ্গে ছবি করেছেন। কিন্তু এ ছবিতে তাঁদের রোমান্টিক কেমিস্ট্রি আগের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দেবে। যশ চোপড়া ঘরানার রোমান্টিসিজ়মকে ছুঁয়ে করণের নিজস্ব কমেডি ঘরানা অবধি আগাগোড়াই এই জুটির রসায়ন চোখে পড়ার মতো। সঙ্গে উপযুক্ত সঙ্গত করেছে প্রীতম চক্রবর্তীর গান। বহুদিন পর তাঁকেও পাওয়া গেল নিজস্ব মেজাজে। অনেকগুলি ভালো গান রয়েছে ছবিতে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘ঢিন্ডোরা’, ‘ঝুমকা’ এবং অবশ্যই ‘তুম ক্যায়া মিলে’। অরিজিৎ সিংহ এবং শ্রেয়া ঘোষালের গাওয়া শেষোক্ত গানটি নিশ্চিতভাবে ‘গেরুয়া’কে মনে পড়াবে। এ সেই প্রীতম, প্রেক্ষাগৃহে বসে যাঁর কম্পোজ়িশন শুনে কখনওই ক্লান্ত হতে হয় না।

চেনা ছন্দে

তবে শুধু রণবীর-আলিয়া নয়, রসায়নের তালিকায় ধর্মেন্দ্র-শবানা, এবং টোটা-রণবীরও কম যাননি। তেমনই এ ছবির জাঁকজমকপূর্ণ সেট ডিজাইন ও চিত্রগ্রহণ। এবং পোশাক পরিকল্পনাও। সমস্ত বিভাগেই মুগ্ধ করেছেন পরিচালক। প্রায় তিনঘণ্টার কাছাকাছি সময় যে কীভাবে পেরোল, বোঝা গেল না। আলিয়াকে শাড়ি এবং ছোট্ট কালো টিপের সাজে অনবদ্য দেখতে লেগেছে। গোটা ছবি জুড়ে এতটাই সুন্দর তিনি যে চোখ ফেরানো যায় না।

অভিনয়ে কেউ কারও চেয়ে কম যান না। রণবীর-আলিয়া তো বটেই, এছাড়া আমির, ক্ষিতি, চূর্ণী, টোটা প্রত্যেকেই মনে রাখার মতো কাজ করেছেন এ ছবিতে। অভিনয় জীবনের সেকেন্ড ইনিংসে দাঁড়িয়ে যেখানে বাংলায় টোটা আইকনিক গোয়েন্দা চরিত্রে দর্শকের মন জয় করেছেন সেখানে আলিয়ার বাবার চরিত্র করতে রাজি হওয়া নিঃসন্দেহে সাহসী সিদ্ধান্ত। তবে করণ যে কতটা অভিজ্ঞ পরিচালক তার প্রমাণ বাংলা থেকে এই দুই যোগ্য অভিনেতাকে তাঁর বেছে নেওয়া। কারণ এই দুটি চরিত্রে এই মুহূর্তে সুনিশ্চিতভাবে আর কোনও বাঙালি অভিনেতা এভাবে সুবিচার করতে পারতেন না। কেন, সেটা ছবি দেখলেই বোঝা যাবে।

আরও পড়ুন: ফেলু-ব্যোমকেশের পর এবার কি হোমসের ছড়াছড়ি?

এত কিছু সত্ত্বেও সাধারণত বেশিরভাগ বিনোদনমূলক হিন্দি ছবির দুর্বলতা থেকে যায় তার কনটেন্ট কিংবা অর্থহীন সংলাপে। এই ছবিতে সেই আশঙ্কাকেও সত্যি হতে দেননি পরিচালক। ছবিতে এমন কিছু বক্তব্য রয়েছে যা নিঃসন্দেহে অনেকের চোখ খুলে দেবে। হাজার সচেতনতামূলক বার্তা যা বোঝাতে পারে না, ভারতীয় আম জনতাকে এবার সম্ভবত সেটাই বোঝাতে সক্ষম হবেন করণ। আলিয়া এবং চূর্ণীর এমনই কিছু সাহসী সংলাপ হলে হাততালির বন্যা বইয়ে দিল। সঙ্গে রণবীরের বডি শেমিং জাতীয় সংলাপও প্রশংসনীয়।

করোনা উত্তর যুগে দক্ষিণী ছবির দাপটে মুম্বই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ম্রিয়মাণ অবস্থায় ধুঁকছিল। কিছুদিন আগে শাহরুখ খানের ‘পাঠান’ সেই খরা অনেকটাই কাটিয়েছে। দ্বিতীয় ঝড়টা সম্ভবত করণই নিয়ে এলেন। এ ছবির ব্লকবাস্টার হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না।




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *