কোন পুরাতন প্রাণের টানে

ছবি: পুরাতন

পরিচালনা: সুমন ঘোষ

অভিনয়ে: শর্মিলা ঠাকুর, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত, বৃষ্টি রায়, একাবলী খন্না

দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৪২ মিনিট

RBN রেটিং ★★★★★★☆☆☆☆

শহরের উপকণ্ঠে, গঙ্গার ধারে জরাজীর্ণ একটি বাড়ি। তার গা থেকে খসে পড়েছে বালি সিমেন্টের পরত। কোনও চাকচিক্য নেই। ইটের পাঁজর বেয়ে বেড়ে উঠেছে বট-অশ্বত্থেরা, জড়িয়ে ধরেছে আষ্টেপৃষ্ঠে । যেন বেঁচে থাকার রসদ পেয়েছে ‘পুরনো’ এই বাড়িটিকে ঘিরে। ঠিক তেমনভাবেই ছিঁড়ে যাওয়া রবীন্দ্র রচনাবলি, কাশ্মীরি কাজ করা কাঠের বাক্স, পুরীর লাঠি, অচল রেডিও, ১৯৭৪ সালের পুজোর চাঁদার বিল, সাদাকালো রঙের রিড উপড়ে যাওয়া হারমোনিয়াম আর ছোট্ট মামনির পুরনো স্মৃতি আঁকড়ে ওই বাড়িতেই দিন কাটাচ্ছেন অশীতিপর এক বৃদ্ধা। মামনির মা। আর সর্বক্ষণের সঙ্গী হীরা। না কি অর্চনা?



নাম ভুলে যান বৃদ্ধা। মনে পড়ে না। সবকিছু কেমন গুলিয়ে যায়। অতীতের কিছু ঘটনা স্পষ্ট, কিন্তু ঝাপসা বর্তমান। শরীরের বয়স বাড়লেও স্মৃতিতে তা ধরা পড়ে না। ফেলে আসা জীবনের নির্দিষ্ট কিছু ঘটনা আবর্তিত হতে থাকে বর্তমানে, থেমে যায় ঘড়ির কাঁটা। পাতার পর পাতা ক্যালেন্ডার উল্টে গেলেও মায়ের চোখে ছোট্ট মামনি বড় হয় না। সেই মামনিকে নিয়ে মায়ের উৎকণ্ঠা, স্কুলের পড়া, স্টিলের টিফিন বাক্স গোছানো চলতে থাকে। চলতে থাকে অতীতের সঙ্গে বর্তমানের বোঝাপড়া। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই ‘বোঝাপড়া’র অবশ্য অন্য ব্যাখ্যা আছে। মেডিকেল সায়েন্স বলছে এই ধরনের উপসর্গগুলি ডিমেনশিয়া, পার্কিনসন্স বা অ্যালঝাইমার্স আক্রান্তদের মধ্যে দেখা যায়। একটি আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্ব জুড়ে ডিমেনশিয়া রোগীর সংখ্যা প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পাবে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা এই রোগ অচিরেই প্রবীনদের মধ্যে মহামারীর আকার নিতে পারে।

সুমন পরিচালিত ‘পুরাতন’ ছবির প্রেক্ষাপট যতটা মস্তিষ্কের স্নায়ুর এই জটিল রোগ নিয়ে, ততটাই পুরনো স্মৃতির সঙ্গে সহবাস নিয়ে। বিভিন্ন প্রজন্মের, বিভিন্ন স্তরের মানুষ এবং তাদের অতীত স্মৃতি ঘিরে থাকা যাপন নিয়ে। আবার, প্রবাসী মেয়ে এবং একাকিত্বে ভোগা এক মায়ের সম্পর্কের রসায়ন নিয়েও।

আরও পড়ুন: ফেলুদা সিরিজ়ে চিরঞ্জিৎ

মামনি অর্থাৎ ঋতিকা সেন (ঋতুপর্ণা) বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত, প্রবাসী। মায়ের দেখাশোনার কোনও ত্রুটি সে রাখেনি। চিকিৎসক-বন্ধু গৌরিকার (একাবলি) সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। তা সত্ত্বেও মামনি জানতে পারেনি তাঁর মায়ের রক্তমাংসের শরীর, শিরা-উপশিরা, স্নায়ু বেয়ে কখন এই রোগের শিকড় পাকাপাকিভাবে বাসা বেঁধেছে।

মামনির মা (শর্মিলা) এই গল্পের নায়ক। তাঁকে ঘিরেই গল্পের সুতো বুনেছেন পরিচালক। মামনির মায়ের ৮০তম জন্মদিন। সেই উপলক্ষেই মামনির বাড়ি ফেরা। সঙ্গী প্রাক্তন স্বামী রাজীব (ইন্দ্রনীল)। জরাজীর্ণ ওই বাড়িতে থাকা প্রবীণার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের রসায়নটা আবার অন্যরকম। তবে গল্পের মুখ্য চরিত্র তিনটির মধ্যে অদ্ভুত একটি মিল রয়েছে। তিনজনের বর্তমান, অতীতের সুতোয় বাঁধা।

আরও পড়ুন: বিশিষ্ট বাঙালির চরিত্রে সইফ, শুটিং শুরু শীঘ্রই

নস্টালজিয়া নিয়ে বাঙালির পিছুটান চিরকালীন। অপ্রয়োজনীয় জেনেও তাকে পরম যত্নে, লালন করার অভ্যাস থেকে এখনও বেরোতে পারেননি অনেকে। চেনা সেই ছকেই ঘুঁটি সাজিয়েছেন সুমন। আর স্ট্রাইকার হিসেবে বেছে নিয়েছেন শর্মিলাকে। ১৪ বছর পর বাংলা ছবিতে ‘স্বপ্নো কি রানি’র প্রত্যাবর্তন বাণিজ্যিকভাবে কতটা সফল হবে তা বলা মুশকিল। তবে শর্মিলার কণ্ঠে রবি ঠাকুরের ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ গানটির একটি কলিই বাঙালি হৃদয় থেকে ভালোবাসা আদায় করে নেবে।

মামনির চরিত্রে ঋতুপর্ণা আলাদা করে নজর কাড়তে পারেননি। উল্টে এমন পোড় খাওয়া অভিনেত্রীর মুখে জড়িয়ে যাওয়া সংলাপ শুনে দর্শক অবাক হতে পারেন। রাজীব অর্থাৎ ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তের সঙ্গে চুম্বন দৃশ্যও ঠিক জমল না। তবে উপরি পাওনা হিসেবে মেঘালয়ের বেশ কিছু পর্যটনস্থল দর্শক উপভোগ করবেন। সে দিক থেকে প্রযোজক ঋতুপর্ণা কিন্তু দরাজ।

আরও পড়ুন: আবারও একসঙ্গে জন-অক্ষয়?

পর্দা হোক বা বাস্তব, ব্যক্তিগত জীবন প্রসঙ্গে ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত অনেকটা শরতের আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘের মতো। এইমাত্র ছিলেন, কিন্তু এখন নেই। কোটিগেহর ডান্সিং ফ্রগের ছবি দেখিয়ে পর্দার রাজীব ঋতিকার মন জয় করতে পেরেছিলেন। কিন্তু অভিনয় দক্ষতা দিয়ে ইন্দ্রনীল দর্শকের মন জয় করতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে। তবে মেঘালয়ের ওই অপরূপ দৃশ্যের আবহে অলকানন্দা দাশগুপ্তের সঙ্গীত পরিচালনায় শ্রেয়া ঘোষালের কণ্ঠে সুন্দর একটি গান দর্শকের মন ভিজিয়ে দেবে।

ওদিকে মা মরা গ্রামের মেয়ে হীরা (বৃষ্টি)। মামনির মায়ের ছায়াসঙ্গী। বৃদ্ধার চোখে কখনও সে অর্চনা, কখনও আবার হীরা। তাঁর অভিনয় অনবদ্য। খিটখিটে, বদমেজাজি, ভুলোমনা ঠাম্মির ব্যবহারে সে কষ্ট পায়। এমনকী চোর বদনামও জোটে। তবু নিজের সবটুকু দিয়ে সে আগলে রাখতে চায় তার ঠাম্মিকে। বয়সের ভারে ভুলে যাওয়া আর ডিমেনশিয়া যে এক নয়, সে সম্পর্কে জ্ঞান নেই হীরার। এই ধরনের রোগীর দেখাশোনার ক্ষেত্রে গৃহসহায়িকা বা কেয়ারগিভারের শিক্ষা এবং সচেতনতা কতটা জরুরি এই বিষয়টিও তুলে ধরেছেন পরিচালক সুমন।



ছোট্ট চরিত্রে একাবলী মানানসই। মামনির মায়ের স্মৃতিতে ফিরে আসা মামনির বাবার চরিত্রে শুভ্রজিৎ দত্তকেও ভালো লাগে। মামনির কুট্টিকাকুর চরিত্রটির অস্তিত্ব নামের মতোই ছোট্ট।

রবি কিরণ আয়াগিরির সিনেমাটোগ্রাফির দৌলতে ‘পুরাতন’ নতুন করে দর্শককে হলমুখী করতে পারে। তবে আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত একটু বুঝেশুনে কাঁচি চালালে পারতেন। তাহলে হয়তো মামনির মায়ের ‘গুপ্ত’ বাক্সের রহস্য উদ্ধার করা যেত। মস্তিষ্কের স্নায়ুর জটিল রোগে আক্রান্ত মামনির মা স্বরলিপি অনুযায়ী হারমোনিয়ামে ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ বাজাতে পারবেন না। হারমোনিয়ামের রিডের উপর শর্মিলার আঙুল চালনা স্বাভাবিকভাবেই অন্যরকম হবে। তা সত্ত্বেও শব্দ পরিকল্পক দীপঙ্কর চাকি ওই দৃশ্যের আবহে কেন সাবলীলভাবে হারমোনিয়াম বাজানোর শব্দ শোনালেন বোঝা গেল না। এমন ছোটখাটো ত্রুটি চোখে না পড়লে শর্মিলা এবং ঋতুপর্ণার উপস্থিতি দর্শকের ভালোই লাগবে।




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Ankeeta

Sleep, travel, eat, repeat! Anchor, presenter, news reader, editor by profession. Long drives and exploring life are my favorite options. Stuck between food and fitness. Intoxicated by music. Painting, singing, photography and Rabindranath are my soulmates

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *