রেহাই পেল না কোনও রঙই
ছবি: ভবিষ্যতের ভূত
পরিচালনা: অনীক দত্ত
অভিনয়ে: বরুণ চন্দ, কৌশিক সেন, সুমন্ত মুখোপাধ্যায়, চন্দন সেন, চান্দ্রেয়ী ঘোষ, বাদশা মৈত্র, দেবলীনা দত্ত, কৌশিক সেন, পরাণ বন্দোপাধ্যায়, খরাজ মুখোপাধ্যায়, সব্যসাচী চক্রবর্তী, সুমিত সমাদ্দার
দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ১১ মিনিট
RBN রেটিং: ৩/৫
ছবির শুরুতেই বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয় যে এটি তৈরি করতে কি পরিমাণ ঝড় ঝাপটা সহ্য করতে হয়েছে। মনে পড়ে গেল ফেব্রুয়ারী মাস থেকে কলকাতা শহর একটা ছবি মুক্তি নিয়ে যে বিরাট প্রহসন দেখল তার খুঁটিনাটি। নানান বাধা বিপত্তি পেরিয়ে অবশেষে দ্বিতীয়বার শহরে মুক্তি পেল ভবিষ্যতের ভূত।
না, এটা ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এর সিক্যুয়েল নয়, এ কথা ট্রেলারেই বলা হয়েছিল। ছবিতেও বলা হল একাধিকবার। এতবার না বললেও বোধহয় চলত। বাঙালি এত বোকা নয়, আর তার প্রমাণ পরিচালক এই ছবির প্রায় ৯০ শতাংশ সংলাপেই রেখেছেন। এই ছবির মানে বুঝতে হলে দর্শককে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতেই হবে। না হলে এ ছবির মর্মোদ্ধার করা অসম্ভব।
ছবির শীর্ষসঙ্গীতে সাম্যবাদ, পুঁজিবাদ, এনআরআই, সাফ সুতরো, গরীব গুরবো, মধ্যবিত্ত, সাদাকালো, এই নানারকম ভূতেদের কথা জানা যায়। এই ক’বছরে বাংলার ভূতের দল কিভাবে পাল্টে গেছে তা বলার জন্য গানটি বেশ শ্রুতিমধুর।
যে জন থাকে মাঝখানে
এবার আসা যাক বিষয়ে। বাদশা মৈত্রকে অনেকদিন পর বাংলা ছবিতে দেখা গেল। বাদশার অভিনীত পরিচালক চরিত্রের মুখে জানা গেল যে তার ‘ভীতুরাম’ ছবির নাম পাল্টে ‘ভীতু’ করতে হয়েছে, কারণ রামকে ভীতু বলা যাবে না। খুব সহজভাবে শুরুতেই বর্তমান সমাজের নকশাটা পরিষ্কার করে দিলেন অনীক। ‘যদিও ফিল্মটা ঠিক খাওয়ার জিনিস নয়,’ তবু প্রযোজকের উদ্দেশ্য যে সেটাই থাকে, অর্থাৎ পাবলিক কি খাবে এবং সেটাই একমাত্র বিচার্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, তাও প্রথম দৃশ্যেই বোঝা গেল। এরপর শুরু হয় চরিত্রের ভিড়।
একটি বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা যেভাবে রাতারাতি রঙ পাল্টায় ও রাজনৈতিক খবর করতে চাওয়া তরুণ সাংবাদিককে একরকম জোর করেই বিনোদনের পাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়, সেই দৃশ্য পরিচিত ও শ্লেষাত্মক। অনীক আমাদের চেনা পথঘাট থেকেই এমন অনেক ইঁট পাটকেল কুড়িয়ে এনেছেন বাঙালি সমাজব্যবস্থার আপাত স্বচ্ছ কাচে ছুঁড়ে মারার জন্য। ছবি তো বন্ধ হবেই। লাল, সবুজ, গেরুয়া, সাদা, কাউকেই রেয়াত করেননি তিনি। উন্নয়ন থেকে ‘ভাঙাগড়’, ‘ঘণ্টাখানেক সঙ্গে সুমনা’ থেকে ‘আহা কি আনন্দ’ চ্যানেল, সবই এসেছে একের পর এক। গোমাতার প্রতি অগাধ ভক্তি এবং মার্ক্সকে বাদ দিয়ে যে মতবাদ রাজ্যের ভবিষ্যৎ ঝরঝরে করে দিয়েছে, তারাও রেহাই পায়নি। পুরনো পার্টি অফিস বন্ধ হয়ে যাওয়া থেকে সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমা হল, সবই যেন সেই বাতিল হয়ে যাওয়া জ্যান্ত ভূতের সাক্ষর বহন করে।
তিন মূর্তি ও পায়ের তলায় সরষে
‘ছিন্নমূল’ পার্টি যাদের স্লোগান হল ‘মা মাটি মাফিয়া’, তার নেতা অম্ববুচি দত্ত (কৌশিক) কোনও একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের নেতার প্রতিনিধিত্ব করেন না কিন্তু এখানে। আসলে ক্ষমতায় যিনিই থাকেন তিনি ওই একই রাস্তায় হাঁটেন। আর থাকে কিছু নাছোড়, আপোষহীন সাংবাদিক যারা সারদা নারদা থেকে শুরু করে কিছু না কিছু নিয়ে সরকারের ঘুম কেড়ে নিতে সদা তৎপর। এদের সরিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিই বা করণীয় থাকতে পারে শাসক দলের? খুব কি ভুল দেখিয়েছেন পরিচালক? বোধহয় না।
এর মধ্যে আদর্শবাদী বাম নেতা (সুমন্ত), রায়বাবুর ‘প্রতিবন্ধী’ ছবিতে কাজ পাওয়া নায়িকা মিস রূপালি (চান্দ্রেয়ী ঘোষ) থেকে শুরু করে অতীতের যাত্রা দলের তারকা নটসূর্য (পরাণ), আধাসাহেব হ্যারি এস রায় ওরফে হরিসাধন রায় (বরুণ), এই সমস্ত চরিত্রেরা ভিড় জমান পর্দায়। ভিড় বলছি এই কারণে যে চরিত্রের ভিড় ছবিতে একটু কম হলেই বোধহয় ভালো হত। বহু দল, বহু স্টিরিওটাইপ ও বহু মতবাদের প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে এত চরিত্র এসেছে ছবিতে যে একটা সময় দর্শক একটু ধাঁধায় পড়ে যান কোনদিকে ফোকাস করবেন।
শব্দ যখন ছবি আঁকে
তবে যে উদ্দেশ্য নিয়ে ভবিষ্যতের ভূত ছবিটি তৈরি হয়েছে, সেই রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্রটি পরিচালক সফলভাবে পর্দায় তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। সংলাপ বরাবরই অনীকের জোরের জায়গা। সেটাকে তিনি পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছেন এই ছবিতেও। প্রতিটা সংলাপ কিছু না কিছু মনে করাবেই। খুব নিরীহ সংলাপও যথেষ্ট ইঙ্গিতবহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন ভোটের তালিকা ছাড়া যে আর কোথাও ভূতেদের অস্তিত্ব নেই তা এই রাজ্যের জনগণ বিলক্ষণ জানেন, হয়ত কেউ কেউ তা স্বীকার করবেন না। আবার রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি থেকে গান্ধীজীকে ফলের রস খাইয়ে অনশন ভাঙানো কোন ঘটনার ইঙ্গিত দেয় তাও সকলেই বুঝবেন।
ব্যঙ্গ করতে গেলে তো এসব প্রসঙ্গ আসবেই। স্বাধীনতা উত্তর ভারতে রাজনীতিটা যে চিরকালই ব্যঙ্গ করার উপযুক্ত বিষয় সে নিয়ে বিশেষ সন্দেহ নেই। সঙ্গে সঙ্গে তা সমান স্পর্শকাতরও। তাই এই ছবি এ রাজ্যে, বা বলা ভালো এ দেশে কোথাও না কোথাও বাধা পেতই সেটা বুঝতে বিশাল কিছু পণ্ডিত হতে লাগে না। গদিতে লাল, সাদা, কালো, নীল যে রঙই থাকুক, এ ছবি তাদের আঁতে ঘা দেবার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী অস্ত্র বলেই প্রতিপন্ন হত। তবে রাজনৈতিক চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে ছবির গল্প বেশ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শেষের দিকে দৈর্ঘ্য আর একটু কমালে ভালো লাগত।
তাশি গাঁওয়ে একদিন
অভিনয়ে প্রত্যেকেই তার জায়গায় যথাযথ। ছোট চরিত্রে সুমিত, দেবলীনা, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, খরাজ, সকলেই তাঁদের নামের প্রতি সুবিচার করেছেন। তবে স্বস্তিকার লিপে আইটেম নম্বরটির তেমন দরকার ছিল না।
অনীকের অন্যান্য ছবির তুলনায় এই ছবিতে গানের ব্যবহার একটু বেশি হলেও দেবজ্যোতি মিশ্রর সুরে কিছু গান একবার শুনেই বেশ ভালো লেগে যায়। অতীতের সঙের আঙ্গিকে ‘বাজে কাই নানা’ গানটি শুনতে বেশ লাগে। ‘আমরা সবাই বাতিল’ গানটিও ইতিমধ্যেই জনপ্রিয় হয়েছে। যদি ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’কে অনীকের মাপকাঠি বলে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে এ ছবি প্রত্যাশা পূরণে অক্ষম হয়েছে অনেকটাই। তবে রাজনৈতিক প্রহসন হিসেবে এমন ছবি বাংলায় আগে হয়নি এ কথাও অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই।