সেই একলব্যের ডানহাতের বুড়ো আঙুলটা

ছবি: সুপার থার্টি

দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ৪২ মিনিট

পরিচালনা: বিকাশ বেহল

অভিনয়ে: হৃত্বিক রোশন, ম্রুনাল ঠাকুর, আদিত্য শ্রীবাস্তব, নন্দীশ সান্ধু, পঙ্কজ ত্রিপাঠি, বীরেন্দ্র সক্সেনা, অমিত সাদ

RBN রেটিং: ৪/৫

পাণ্ডব ও কৌরব ছাত্রদের অস্ত্রশিক্ষা দিচ্ছেন গুরু দ্রোণাচার্য। হঠাৎ এক কিশোর ব্যাধ এসে তাঁর কাছে অস্ত্রশিক্ষার আবদার জানায়। কিন্তু রাজগুরু দ্রোণ এক অনার্য ছাত্রকে শিক্ষা দেবেন! প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। এর অনেকদিন পরে যখন পাণ্ডুপুত্র অর্জুন গুরুর পরীক্ষায় সসম্ভ্রমে উত্তীর্ণ, ঠিক সেই সময়েই কালের গতি আবারও একলব্যকে এনে দাঁড় করায় দ্রোণের সামনে। চমকে ওঠেন গুরুশ্রেষ্ঠ। অস্ত্রশিক্ষায় এই ছেলে তো অর্জুনকেও ছাপিয়ে যেতে বসেছে! এমন তো হতে দেওয়া যায় না। রাজার ছেলেকে হারাবে কি না এক ব্যাধপুত্র? সুকৌশলে তাই গুরুদক্ষিণা চাওয়ার অছিলায় একলব্যের ডানহাতের বুড়ো আঙুলটাই চেয়ে বসলেন দ্রোণ।




শুধু একলব্য নয়, যুগ যুগ ধরে যেখানেই সমাজের পিছিয়ে পড়া দরিদ্র সম্প্রদায় একটু মাথা উঁচু করে বাঁচতে চেয়েছে, সেখানেই উচ্চতর সমাজের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তারা। তাদের অবিলম্বে ধমকে, বলপ্রয়োগ করে, প্রয়োজনে প্রাণে মেরে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়াই প্রথমসারির নাগরিকদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অচলায়তন সমাজব্যবস্থাকে একদিন আঙুল তুলে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন অঙ্কবিদ আনন্দ কুমার। 

নিজের অঙ্ক প্রতিভার জোরে সামান্য পোস্টম্যান বাবার ছেলে হয়েও আনন্দের অঙ্ক বিষয়ক প্রবন্ধ ছেপে বেরোয় বিদেশী জার্নালে। কিন্তু গরীব ঘরের ছেলে হওয়ার কারণে বিদেশে পড়তে যাওয়ার সুযোগ পেয়েও শুধুমাত্র টাকার অভাবে আনন্দের স্বপ্নের উড়ান থেমে যায় ডানা মেলার আগেই। তারপর আসে জীবনযুদ্ধে লড়াইয়ের পালা। অনেক টানাপোড়েনের পর অবশেষে লাল্লন সিংয়ের হাত ধরে আবার আকাশ দেখতে পায় সে। কিন্তু সুখের দিনে বাদ সাধে সেই মহাভারতের একলব্যের কাহিনী। বেঁচে থাকতে আনন্দের বাবা স্বপ্ন দেখতেন রাজার ছেলের রাজা হওয়ার দিন শেষ। এবার রাজা সেই হবে যে সিংহাসন জয় করবে।

বড় পর্দার ধাঁচে ‘মুঘল-এ-আজ়ম’ ফিরল নাট্য মঞ্চে

রাতারাতি ভোল পাল্টে যায় আনন্দের। চলার পথে হোঁচট খেয়ে সজাগ হয় সে। এভাবে লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে তো চলবে না। শুরু হয় অন্য এক সাধনা। তিরিশজন গরীব ছাত্রছাত্রীকে বিনামূল্যে শিক্ষা দিয়ে দেশের সব থেকে বড় প্রযুক্তির পীঠস্থান আইআইটিতে পড়ার যোগ্যতা অর্জন করাতে হবে। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থাকে শুধু ক্ষমতার জোরে যারা ব্যবসায় পরিণত করেছে, প্রতিটি ছাত্রছাত্রী পিছু যাদের লাখ দশেক আয় বাঁধা, তারা এক শিক্ষকের পাগলামিতে সায় দেবে কোন দুঃখে? বাধা আসে, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় আনন্দের উচ্চতর সমাজের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে। কিন্তু তার জেদ, এর শেষ দেখে সে ছাড়বে। আনন্দের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় বসতেই যেন না পারে, এমন ব্যবস্থাই করতে চেয়েছিল ক্ষমতাশালী বিপক্ষের লোকজন। দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে একদিন অবশেষে আসল পরীক্ষায় বসার সুযোগ পায় আনন্দের ছাত্রছাত্রীরা। 

গল্পটা সকলেরই জানা। আনন্দ কুমারের জীবনের ঘটনাবলী অবলম্বনেই তৈরি হয়েছে পরিচালক বিকাশ বেহলের ছবি ‘সুপার থার্টি’। চেনা গল্প হলেও যেহেতু আনন্দ কুমার জনগণের কাছে খুব একটা পরিচিত মুখ নন, তাই কোনওরকম ম্যানারিজ়মের ব্যাগেজ ছাড়াই হৃত্বিক স্বমহিমায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এবং বলা বাহুল্য তিনি সসম্মানে উত্তীর্ণও হয়েছেন প্রথম দর্শনেই। দু’বছর আগে ‘কাবিল’-এর পর হৃত্বিককে আর কোনও ছবিতে দেখা যায়নি। শোনা যাচ্ছিল প্রস্তুত হচ্ছিলেন তিনি, গ্ল্যামারবিহীন চরিত্রে নিজেকে মেলে ধরার জন্য। এরপরেও নানান কারণে ছবির মুক্তি বিলম্বিত হয়েছে। তাই ‘সুপার থার্টি’-কে নিয়ে আগ্রহ থাকলেও উচ্ছাস তেমন ছিল না। কেন না হৃত্বিক ছাড়া এই ছবিতে আর কোনও তারকা অভিনেতা নেই। কিন্তু যে ছবির চিত্রনাট্য নিজেই তারকা আর যার জীবনকথা যে কোনও মহাপুরুষের জীবনীর সঙ্গে তুলনীয়, সেখানে আর কোনও তারকার প্রয়োজন যে নেই তা বোধহয় পরিচালক বুঝেছিলেন। 

বিশ্বনাথের বারাণসী, বারাণসীর বিসমিল্লাহ

বাস্তবের আনন্দ কুমার পর্দার আনন্দ কুমার হিসেবে হৃত্বিককেই চেয়েছিলেন, তাঁর মনে হয়েছিল এই চরিত্রের প্রতি সুবিচার করতে পারবেন একমাত্র তিনিই। ভুল ভাবেননি আনন্দ। হৃত্বিক তাঁর অভিনয় দক্ষতার সবটুকু ঢেলে দিয়েছেন এই ছবির জন্য। এতটাই যে ছবিতে কোথাও মনেই হয় না ইনি সেই হৃত্বিক যিনি অসাধারণ নাচতে পারেন, যিনি আকবরের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বা যিনি ‘ধুম’ ছবিতে তুখোড় এক চোরের ভূমিকায় পুলিশের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন। নাহ, সত্যিই ছবি দেখতে বসে এগুলো একটাও মনে আসেনি। এখানে তিনি শুধুই আনন্দ। গ্রাম্য টানে হিন্দি বলা ভাগ্যহীন অসহায় এক শিক্ষিত যুবক। ছবির জন্য হৃত্বিক যেভাবে নিজের এতদিনের ইমেজ ভেঙেছেন ও শরীরী ভাষায় যেভাবে আনন্দকে ফুটিয়ে তুলেছেন তার ভূয়সী প্রশংসা না করে পারা যায় না। নিঃসন্দেহে হৃত্বিক ছাড়া এ ছবি এভাবে আবেগের জোয়ারে ভাসাতে পারত না। 

শিক্ষকের সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করে গেছে তাঁর ছাত্রছাত্রীর দল। যাদের কেউ বা ট্রাক ড্রাইভারের ছেলে, কেউ আবার রান্নার লোকের হেল্পার। কারোর বাবা নুনের কারখানায় শ্রমিক, কারোর বাবা সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন, তো কারোর বাবা সামান্য বেতনের ড্রাইভার। কারোর বাবা দিনরাত মাতাল হয়ে মাকে মারধর করে, তো কেউ আবার ম্যানহোলের পাঁক তুলে দিন গুজরান করে। এই অভিনেতাদের নাম জানা না গেলেও এঁরাই রয়েছেন ছবির অনেকটা জুড়ে। আর প্রত্যেকে দর্শকের মন জয় করে নিয়েছেন ছোট ছোট দৃশ্যের মাধ্যমে।

যে জন থাকে মাঝখানে

ছবির চিত্রনাট্য বেশ লম্বা হলেও কোথাও তা শিথিল হতে দেয়নি সংলাপের জাদু। বারবার হাততালি পড়েছে কথার ধারালো ব্যবহারে। আনন্দের ভাইয়ের ভূমিকায় নন্দীশ, বাবার ভূমিকায় বীরেন্দ্র, শিক্ষামন্ত্রীর ভূমিকায় পঙ্কজ, কোচিং সেন্টারের মালিক লল্লন সিংয়ের ভূমিকায় আদিত্য, সাংবাদিকের ভূমিকায় অমিত, বান্ধবীর ভূমিকায় ম্রুনাল, প্রত্যেকেই তাঁদের চরিত্রের প্রতি সুবিচার করেছেন। অতুল ও অজয়ের সুরে ছবিতে কয়েকটি গান ভাল, তবে এই ছবিতে গান না হলেও তেমন অসুবিধা ছিল না। বরং নেপথ্য সঙ্গীত ছবির মেজাজকে ধরে রাখতে অনেকটা সাহায্য করেছে বলা যায়। 

কিছুদিন আগে পাওয়া খবরে জানা যায় আনন্দ দুরারোগ্য ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত, যা থেকে সেরে ওঠার সম্ভাবনা নিতান্তই কম। তাই তিনি চাইছিলেন সুস্থ থাকতে থাকতে ছবিটি মুক্তি পাক। আনন্দের জীবনকাহিনী নিঃসন্দেহে মন জয় করবে দর্শকের, কেন না মানুষ আজও এমন স্বপ্নপূরণের কাহিনী শুনতে চায়। ভাবতে ভাল লাগে এমন একটা দিন আসবে যখন শিক্ষা শুধুমাত্র পয়সাওয়ালা কিছু মানুষের কুক্ষিগত হয়ে থাকবে না, অধিকার থাকবে সকলের। সেই অপেক্ষায় আপামর দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত ভারতবাসী যেমন থাকবেন, আশা করা যায় সেই দিনটা দেখার জন্যই দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন আনন্দ। 

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *