‘কোনও কিছুর জন্য আফসোস করায় বিশ্বাসী নই’
তাঁর প্রথম ছবি ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’ বক্স অফিসে রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল। তারপর অজস্র ছবিতে নানান ভূমিকায় দেখা গিয়েছে তাঁকে, কখনও সাধারণ মধ্যবিত্ত মেয়ে, কখনও লাস্যময়ী, আবার কখনও বা অতীতের জনপ্রিয় নায়িকার চরিত্রে পর্দায় নিজেকে মেলে ধরেছেন প্রিয়াঙ্কা সরকার। একমাত্র ছেলে সহজকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় মাঝে কয়েকটা বছর কাজ কমিয়ে দিলেও আবারও তিনি ফিরে এসেছেন বড় পর্দায়। অর্ণব মিদ্যার ‘অন্দরকাহিনী’ ছবির জন্য বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসব থেকে পেয়েছেন পুরস্কার। পুজোতেই তাঁকে পাওয়া গেল দক্ষিণ কলকাতার এক ক্যাফেতে, খোলামেলা আড্ডা দিলেন রেডিওবাংলানেট-এর সঙ্গে।
পুজো কিভাবে কাটাচ্ছ?
পরিবার আর বন্ধুদের সঙ্গে। আমার বাড়ির কাছে একটা মণ্ডপে আমি প্রায় সারাদিন কাটাই। ওখানেই আড্ডা দিই। এছাড়া ডায়েটের চাপটা কম থাকে বলে চুটিয়ে খাওয়াদাওয়া চলছে।
এখন তো পরপর ছবি করছ। কিন্তু কিছুদিন আগে একটা বড় বিরতি নিয়েছিলে তুমি। সহজ ছোট থাকার কারণে তোমাকে সেভাবে বড় পর্দায় পাওয়া যায়নি। তারপর যখন কামব্যাক করলে তখন অসুবিধা হয়নি আগের জায়গাটা ফিরে পেতে? অনেক নতুন মুখও তো ততদিনে চলে এসেছে, তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা কতটা কঠিন ছিল?
মাঝখানের সময়টায় একেবারেই যে ছিলাম না তেমন কিন্তু নয়। কখনওই পুরোপুরি গ্যাপ আমি নিইনি, ছোট ছোট কাজ করে গেছি। এটা ঠিক যে পরিবারের কারণে ব্যস্ত থাকায় বেশি সময় দিতে পারিনি তখন। তাছাড়া প্রেগন্যান্সির পরে আমার ওজন বেড়ে গিয়েছিল অনেকটাই। আমার মনে হয়েছিল সেটাকে ঠিক না করে আমি ফিরতে পারব না। অভিনয়ের জগতে থাকতে গেলে ওটা তো একটা বড় শর্ত। তাই একটু সময় দিয়েছিলাম নিজেকে যাতে আবার নতুন করে শুরু করতে পারি। এটা করতে গিয়ে আমার ফিটনেসের প্রতি খুব আগ্রহ জন্মায়, সেটা এখন আমার রোজের রুটিনেও চলে এসেছে। তাই সব মিলিয়ে আমার মনে হয় ভালোই হয়েছে।
‘চিরদিনই তুমি যে আমার’ বাম্পার হিট। তারপরে তোমাকে ও রাহুলকে নিয়ে ওই একই ধরণের কিছু ছবি তৈরি হয় যেগুলো তেমন সফল হয়নি। সেই ছবিগুলো করার জন্য কখনও কি আফসোস হয়?
না, কোনও কিছুর জন্য আফসোস করায় আমি বিশ্বাসী নই। সেই সময় ওই কাজগুলো আমার দরকার ছিল। সেটা কাজের মধ্যে থাকার জন্য হোক, কিংবা আর্থিক দিক থেকেই হোক। ওই কাজগুলোর কারণে প্রচুর মানুষের সঙ্গে চেনাজানা হয়েছে, অনেক গুণী সিনিয়রদের সঙ্গে অভিনয় করেছি, কাজ শিখতে পেরেছি। তবে হ্যাঁ, হয়তো আরও অনেক ভালো কাজ পেতে পারতাম, সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে পারিনি আমরা। আমাদের দুজনকেই তখন গাইড করার কেউ ছিল না। আজকের এই অভিজ্ঞতা নিয়ে যদি ওই জায়গাটায় ফিরতে পারতাম তাহলে নিশ্চয়ই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতাম। কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়, তাই আফসোস রাখি না।
আরও পড়ুন: পঁচিশে ‘উনিশে এপ্রিল’
‘অন্দরকাহিনী’র মুক্তি আটকে গেলেও বিদেশে ও দেশের মধ্যেও নানান চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছে। তুমি নিজেও অনেকগুলো পুরস্কার পেয়েছ। এই ছবিতে তোমাকে আলাদা আলাদা চারটে গল্পে চার রকম ভূমিকায় দেখা যাবে। এই চরিত্রগুলোর জন্য নিজেকে কিভাবে তৈরি করলে?
কিছুটা করেছি আমার বাড়িতে যিনি কাজ করতে আসেন তাঁকে দেখে। আমার পাড়ায় এক মহিলার চায়ের দোকান আছে, তাঁকেও দেখেছি। এরকম বিভিন্ন জায়গায় দেখা কিছু চেনা চরিত্র আমাকে হেল্প করেছে। এছাড়া অর্ণবের চিত্রনাট্যও আমাকে খুব সাহায্য করেছিল চরিত্রগুলোকে বুঝতে। তবে এরকম একটা এক্সপেরিমেন্ট বাংলা ছবিতে এই প্রথম। তাই কাজটা চ্যালেঞ্জিং ছিল, আর আমার করতেও খুব ভালো লেগেছে।
বিরসা দাশগুপ্তর ‘বিবাহ অভিযান’-এ তোমার চরিত্রটা খুবই ছোট ছিল। প্রায় কিছুই করার ছিল না তোমার ওই চরিত্রে। কেরিয়ারের এই সময়ে এরকম একটা ছবি করলে কেন?
করলাম কারণ ওখানে আমি অতিথি শিল্পী হিসেবেই ছিলাম। আর ওইরকম ডাকাবুকো মেয়ের চরিত্রে আমি আগে কখনও অভিনয় করিনি। চরিত্রটা শুনেই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। আর একটা প্রলোভনের জায়গা বলা যেতে পারে অনির্বাণের সঙ্গে কাজ করা। আমার খুব প্রিয় অভিনেতা অনির্বাণ। তাই ওর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়ে আর দ্বিতীয়বার ভাবিনি। আর বিরসাদার সঙ্গে কাজ করতে সবসময়েই ভালো লাগে।
আরও পড়ুন: তাশি গাঁওয়ে একদিন
একটা ছবিতে সই করার সময় কি কি চিন্তা মাথায় আসে? কাজটা করার বা না করার পিছনে তোমার নিজের যুক্তিগুলো কি থাকে?
অবশ্যই প্রথমে দেখি এরকম চরিত্র আগে করেছি কি না, নতুন কিছু হলে তার প্রতি একটা স্বাভাবিক আগ্রহ থাকে। এছাড়া যিনি ছবিটা করবেন, সেই পরিচালকের দৃষ্টিভঙ্গিটাও খুব জরুরী এক্ষেত্রে। তিনি কিভাবে চরিত্রটাকে তুলে ধরছেন সেটার ওপরেই নির্ভর করে আমার কাজটা কেমন হবে। পরিচালকের যদি নিজের কাজটা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকে তাহলে ছবি নির্বাচন করতে অনেক সুবিধা হয়। বিশেষ করে নতুনদের ক্ষেত্রে এটা খুব কাজ করে। তাছাড়া প্রোডাকশন হাউজ় থেকে কতটা সাপোর্ট পাওয়া যাবে সেটাও দেখার বিষয়। তবে সবথেকে আগে চরিত্র ও পরিচালককে দেখি এটাও ঠিক।
কেরিয়ারের প্রথমদিক থেকে তুমি স্বপন সাহা, অরিন্দম শীল, সৃজিত মুখোপাধ্যায়, অঞ্জন দত্ত, রাজ চক্রবর্তী সকলের সঙ্গেই কাজ করেছ। এদের মধ্যে কাদের সঙ্গে আবার কাজ করতে চাও?
প্রত্যেকেই তাঁর নিজস্ব স্টাইলে কাজ করেন। আমার সৌভাগ্য যে আমি এতজনের ছবিতে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। এখন অনেক ভালো ভালো ছবি হচ্ছে। সেগুলোর মধ্যে কোথাও যে থাকতে পারছি সেটাই ভালো লাগার জায়গা। তবে এদের অনেকের সঙ্গেই বড় করে কাজ করা হয়নি সেভাবে। যেমন অঞ্জনদার (দত্ত) সঙ্গে শুধু ‘ব্যোমকেশ সিরিজ়েই কাজ করেছি। কিন্তু যে ধরণের আরবান ছবি উনি করেন, সেগুলোয় কাজ করার ইচ্ছে রয়েছে। এছাড়া রিনাদির (অপর্ণা সেন) ‘আরশিনগর’-এ একটা ছোট চরিত্রে কাজ করলেও বড় করে কিছু করিনি। সেটার ইচ্ছে আছে। সৃজিতদার সঙ্গে ‘হেমলক সোসাইটি’ ও ‘রাজকাহিনী’ করেছি, আরও কাজ করার ইচ্ছে রয়েছে। ‘হেমলক সোসাইটি’ এখনও পর্যন্ত আমার সবচেয়ে প্রশংসিত কাজ। তাই অবশ্যই চাইব সৃজিতদার ছবিতে আবারও যেন সুযোগ আসে। এছাড়া শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায়ের সঙ্গে এখনও কাজ করা হয়নি, সেটা করারও খুব ইচ্ছে। আরও অনেকেই আছেন।
আরও পড়ুন: তিন মূর্তি ও পায়ের তলায় সরষে
তোমার অভিনয় জীবনের প্রথম পর্যায়ে তোমার বয়স অনেকটাই কম ছিল। সেই আগের সময়টার সঙ্গে এখনকার অনেক তফাত। একজন সিঙ্গল মাদার হিসেবে কিভাবে সামলাও সবটা?
আমার কোনও সমস্যাই হয় না। সহজ এখন একটু বড় হয়েছে, আর ও খুব বোঝে আমাকে। কখনওই ওর জন্য আমাকে কোনও অসুবিধায় পড়তে হয়নি। আর আমার পরিবারের কাছ থেকে আমি এত সাপোর্ট পাই যে কোনও সমস্যাই হয় না। আগে সহজ একটু বায়না করতো, তখন ওকে কয়েকবার শ্যুটিংয়েও নিয়ে গিয়েছি। সেখানে গিয়ে ও বুঝেছে ব্যাপারটা খুব বোরিং, তাই আর যেতে চায় না। ও এটা জানে যে কাজ শেষ করে রাতে মাম্মা ঠিক বাড়ি ফিরবে, তাই নিশ্চিন্তে থাকে। ফোনে যোগাযোগ রাখি ওর সঙ্গে সারাদিন। আর আমার বন্ধুরাও জানে আমি কাজ না করলে বাড়িতেই থাকি, পার্টি ইত্যাদিতে আমাকে বিশেষ দেখা যায় না। তাই তারাও চেষ্টা করে বাড়িতেই আড্ডা দিতে। সকলেই এত বেশি সাপোর্ট দেয় আমাকে যে কোনও অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় না।
সোহমের সঙ্গে ‘প্রতিঘাত’-এ কাজ করছ। অনেকদিন পর একটা মূলধারার ছবির মুখ্য চরিত্রে দেখা যাবে তোমাকে। এরকম একটা ছবিতে সই করলে কেন?
সোহমের সঙ্গে এর আগে রাজা চন্দর ‘আমার আপনজন’-এ অভিনয় করেছিলাম। কিন্তু বড় করে কাজ করা হয়নি। তাই সোহম আর আমার দুজনেরই ইচ্ছে ছিল ভালো করে একটা কাজ করার। তবে ‘প্রতিঘাত’ নিয়ে এখনই বেশি কিছু বলা যাবে না। শুধু বলব যে এক একজনের কাছে প্রতিঘাত এক একরকম ভাবে আসে। সব সময় প্রতিঘাত মানেই যে প্রচুর ভায়লেন্স থাকবে তেমন কিন্তু নয়। ছবির চিত্রনাট্যটা আমার পছন্দ হয়েছিল।
আরও পড়ুন: যে জন থাকে মাঝখানে
‘হ্যালো’র দ্বিতীয় সিজ়ন চলছে। এটা তোমার করা একেবারেই অন্য ধরণের একটা চরিত্র। একজন সমকামী মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করতে গিয়ে কোনও রেফারেন্স পেয়েছিলে কি?
প্রথমেই বলি এটা খুব চ্যালেঞ্জিং একটা চরিত্র ছিল। আমার প্রিয় চরিত্রগুলোর একটা হয়ে থাকবে এই নীনা। এরকম কোনও চরিত্রে আমি আগে অভিনয় করিনি। আর অনেকেরই সন্দেহ ছিল যে আমি সাধারণত যেরকম মিষ্টি মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করে করে থাকি, তাতে নীনার চরিত্রে আদৌ আমাকে মানাবে কিনা। ‘হ্যালো’র পরিচালক অনির্বাণ মল্লিক সেই চ্যালেঞ্জটা আমাকে দিয়েছিল, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আর কাজটা যে ভালো হয়েছিল, সেটার প্রমাণ প্রচুর মানুষ দেখেছেন সিরিজ়টা। যে কারণে দ্বিতীয় সিজ়নও এসেছে। আর রেফারেন্স বলতে আমি নীনার জায়গায় নিজেকে রেখে বুঝতে চেয়েছিলাম। দেখো, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে সাদা ও কালো রয়েছে। পুরো সাদা বা পুরো কালো মানুষ খুব একটা দেখা যায় না। বরং ধুসর মানুষই বেশি। তো সেইভাবে দেখলে নীনা ওর জায়গা থেকে যা বলছে সেটা ঠিক। ‘হ্যালো’র প্রথম সিজ়নে আমার চরিত্রটা যেখানে আসছে, তার মুখে যে সমস্ত কথা রয়েছে, দ্বিতীয়বার দেখলে প্রত্যেকটা কথার অন্য একটা মানে পাওয়া যায়। তাই সেগুলো মাথায় রেখেই কাজটা করেছিলাম।
আরও পড়ুন: বিশ্বনাথের বারাণসী, বারাণসীর বিসমিল্লাহ
একটা র্যাপিড ফায়ার করছি। চটজলদি উত্তর চাই। প্রিয় হবি কি?
গল্পের বই, ওয়েব সিরিজ় দেখা। আর সবথেকে পুরনো হবি হলো ছবি আঁকা। সময় পেলে এখনও আঁকি।
প্রিয় রঙ?
কালো ও গ্রে।
প্রিয় পোশাক?
ব্লু ডেনিম, ব্ল্যাক টি শার্ট আর স্নিকার।
প্রিয় বেড়াবার জায়গা?
চেরাপুঞ্জি।
প্রিয় সহঅভিনেতা?
ধুর। এটা খুব বাজে প্রশ্ন। একজনের নাম কি করে নেব? আমার সকলের সঙ্গেই কাজ করতে ভালো লাগে।
আচ্ছা বেশ, মূলধারা না কি অন্যধারার ছবি?
আমার দুটোই ভালো লাগে। অন্যধারার ছবিতে সাধারণ মানুষ তাঁর নিজের ক্রাইসিসকে পর্দায় দেখতে পান। সেখানে নিজেকে রিলেট করার একটা ব্যাপার থাকে। আবার মূলধারার ছবিতে মানুষ দু-আড়াই ঘণ্টা একেবারে লার্জার দ্যান লাইফ একটা দুনিয়ায় থাকেন, যেখানে খারাপ লোকের শাস্তি হয়, হিরোরা জিতে যায়, দারুণ সব লোকেশনে নায়ক নায়িকা গান গায়। তো দুটোর মধ্যেই মজা রয়েছে। দু’ধরনের ছবিই হওয়া দরকার।