‘অপর্ণার পরে বাংলা ছবিতে আর কোনও ফ্যাশন আইকন আসেনি’

প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডিজ়াইনার তিনি নন। তবুও প্রায় দুই দশক ধরে বাংলা ছবিতে পোশাক পরিকল্পনা করে চলেছেন সাবর্নী দাস। একসময় কলকাতার নামী সংবাদপত্রের সাংবাদিক ছিলেন, পরে ২০০০ সালে অপর্ণা সেন তাঁকে ‘পারমিতার একদিন’ ছবির পোশাক পরিকল্পনার ভার দেন। সেই শুরু। আজ অবধি অজস্র বাংলা ছবির পোশাক পরিকল্পনা করেছেন সাবর্নী। ২০১৩তে ‘জাতিস্মর’ ছবির জন্য এসেছে জাতীয় পুরস্কারও। সাম্প্রতিককালে ‘এক যে ছিল রাজা’র পর এই বছর সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘গুমনামী’ ছবির পোশাকের দায়িত্বেও তিনি। বাংলা ছবির ফ্যাশন স্টেটমেন্ট থেকে এ বছরের পুজোর ফ্যাশন, এই সবকিছু নিয়ে আড্ডা দিতে রেডিওবাংলানেট পৌঁছে গিয়েছিল সাবর্নীর ডেরায়।

পুজো শেষ হলো। কি ধরণের পোশাক চোখে পড়ল এবার? নতুন কোনও ট্রেন্ড এসেছে কি?

না একেবারে আনকোরা নতুন কোনও ট্রেন্ড এবারে চোখে পড়েনি। এখন যে কোনও জামাকাপড়ের মধ্যে ক্যাজ়ুয়ালটাই চলে। বরং সাধারণ জামাকাপড়কে অন্যরকম কিছুর সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে পরার একটা চল দেখা যাচ্ছে। যেমন ইন্ডিগো শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজ়ের জায়গায় একটা ওয়েস্টার্ন টি শার্ট বা টপ। আবার জিন্সের সঙ্গে আঙরাখা ধরণের পোশাক। মিলিয়ে মিশিয়ে একটা ইন্দো-ওয়েস্টার্ন ফ্যাশন গত কয়েক বছরে খুব চলছে।




আজকাল তো স্টিচ করা শাড়িও পাওয়া যাচ্ছে

হ্যাঁ, আর সেসব মেয়েরা পরছেও খুব। যদিও শাড়ি পরতে জানলে খুব একটা সময় লাগে না, তবু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটাই নতুন ট্রেন্ড। শাড়ির ক্ষেত্রে আমি বলব আমার নিজের পছন্দ হলো একটা বেনারসি শাড়ি পরলে তার সঙ্গে একটা একেবারে অন্যরকম ব্লাউজ়, সঙ্গে খুব অল্প গয়না। হয়তো একটা আংটি আর একটা ঘড়ি, বা শুধু দুটো দুলই যথেষ্ট। বেনারসী মানেই যে খুব জমকালো হতে হবে, এই ভাবনাটা একটু পাল্টানো যেতেই পারে। এখন এই ধরণের সাজই দেখতে ভালো লাগে, আর পরের প্রজন্ম এই সাজকে পছন্দও করছে। 

‘গুমনামী’র কথায় আসি। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ের ঘটনা নিয়ে তৈরি একটা ছবি। এই ছবির রেফারেন্স পেলে কিভাবে?

এই ধরণের ছবিতে একটা সুবিধা হয় যে প্রচুর ফটোগ্রাফ পাওয়া যায়। এগুলো তো খুব সাম্প্রতিক ইতিহাস। তবে ডিটেলিং পেতে অসুবিধা হয় এটাও ঠিক। যেমন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু খাকি পোশাক পরে হেঁটে যাচ্ছেন, তাঁর বুকে দুটো ব্যাজ লাগানো। এবার অত পুরোনো ছবি থেকে বোঝা সম্ভব নয় ওই ব্যাজ দুটো কিসের। সেইজন্য পড়াশোনা করতে হয়, ইতিহাসটা জানতে হয়। সমস্যা বলব না, তবে ‘গুমনামী’র ক্যানভাসটা অনেক বড়। এটা তো হিন্দি ছবি নয় যে এক একটা লোকের জন্য আলাদা ডিজ়াইনার থাকবে। এখানে আমি যখন রিনাদি (অপর্ণা সেন) বা সৃজিতের ছবি করি তখন সবটাই আমাকে দেখতে হয়। এত বড় একটা ইউনিট, সেখানে কাজের ভলিউমটা বেড়ে যায় অনেকখানি। পিরিয়ড ছবি হলে সেটা বিরাটাকারে করতে হয়। আরও একটা ব্যাপারও আছে এখানে, সেটা হলো যদি কোনও ভুল হয় তাহলে মানুষ বলতে ছাড়বেন না। কারণ এই ইতিহাসটা অনেকের জানা। 

আরও পড়ুন: পঁচিশে ‘উনিশে এপ্রিল’

এর আগে ‘এক যে ছিল রাজা’ আর ‘রাজকাহিনী’ও পিরিয়ড ছবি ছিল। সেখানে তো এত চেনা ইতিহাস নয়। সেগুলোর রেফারেন্স পেতে অসুবিধা হয়নি?

অসুবিধা বলব না। আমি যেহেতু কাজটা করতে ভালোবাসি তাই এগুলো নিয়ে পড়াশোনা করে সেই সময়টাকে বোঝার চেষ্টা করি। ‘রাজকাহিনী’ তো কাল্পনিক গল্প। ইতিহাসের ছোঁয়া থাকলেও কোনও চেনা চরিত্র সেখানে ছিল না। তাই কিছুটা স্বাধীনতা পাওয়া গিয়েছিল। আমরা রিসার্চ করে সেই সময়ের সাজগোজের ধারাটাকে বুঝতে চেষ্টা করেছি। যেমন সেই সময়ের মেয়েদের চুল কিন্তু এখনকার মতো হতো না। আমাদের মায়েদের আমরা যেমন দেখেছি, রিঠা দিয়ে শ্যাম্পু করতেন, নিয়মিত তেল দিতেন, এখন তো আর তা হয় না। এখন সকলেই চুলে স্পা করেন, তেল লাগিয়ে সেটা ধুয়ে ফেলেন, নানারকম রঙ করেন। কিন্তু ‘রাজকাহিনী’র সময় আমরা সমস্ত অভিনেত্রীদের বলেছিলাম, এগুলো করা যাবে না। আমরা সকলেই তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ যে তাঁরা কেউই ওই সময় অন্য কোনও কাজ নেননি। যেভাবে বলা হয়েছিল সেভাবেই করেছিলেন। ‘এক যে ছিল রাজা’তেও প্রচুর রেফারেন্স ছিল। সেখানেও পড়াশোনা করে ওই সময়ের সাজগোজটা কেমন ছিল সেটা বার করেছিলাম। পরিচালক ছাড়াও ডিওপি, মেক আপ আর্টিস্ট সকলে মিলে বসেই এই ব্যাপারগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়। সেখানে সকলেরই ইনপুট থাকে।

একটু পুরোনো দিনে ফিরে যাওয়া যাক। আশি ও নব্বইয়ের দশকে বাংলা ছবিতে ফ্যাশনের প্রভাব কি আদৌ ছিল বলে মনে হয় তোমার ? 

আমার মনে হয় সেই সময় বাংলা ছবি একটা দুরবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। মানুষ হিন্দি ছবি দেখে অনেক বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন আশির দশকে। আর আমার নিজের মতে বাংলা ছবিতে অপর্ণা সেনের পরে আর কোনও ফ্যাশন আইকন আসেনি যাকে দেখে বাঙালি মেয়েরা সাজগোজ করেছে। ওইরকম তাঁতের শাড়ি, রূপোর গয়না, মাথায় খোঁপা করে ফুল লাগানো, কখনও কালো কারে একটা লকেট, কানে একটা টপ, সুতির ছাপা শাড়ি, কপালে বড় টিপ, এই ধরণের সিম্পল সাজের মধ্যে দিয়ে ফ্যাশনেবল লুক প্রথম অপর্ণাই নিয়ে আসেন। উনি ছবিতে নিজের লুক নিজেই ডিজ়াইন করতেন। আর একটু পিছিয়ে গেলে সুপ্রিয়া দেবীর নিজস্ব স্টাইল স্টেটমেন্ট পাই আমরা, কিছুটা সোফিয়া লোরেনের স্টাইলে। তখন অনেকেই ওঁকে দেখে সাজ নকল করতেন। সুচিত্রা সেনকে দেখেও ওঁর মতো করে শাড়ি, গয়না পরতেন প্রচুর মানুষ। কিন্তু তার পরের সময়টায় আর কেউ উঠে আসেননি সেভাবে যাকে দেখে সাধারণ মানুষের ফ্যাশন স্টেটমেন্ট পাল্টেছে। বরং সারা দেশেই বলিউডকে দেখে ফ্যাশন করার একটা চল ছিল চিরকালই, দক্ষিণকে বাদ দিয়ে। দক্ষিণের চারটি রাজ্য কিন্তু নিজেদের সাজগোজ ও স্টাইলের ধারাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।

আরও পড়ুন: বিশ্বনাথের বারাণসী, বারাণসীর বিসমিল্লাহ

বাংলা ছবিতে মহিলাদের আটপৌরে সাজটা কিন্তু এখনও দেখা যায়

সেটা সাহিত্যনির্ভর সাজ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাসে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েদের সাজ, আবার শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গল্পে আটপৌরে সাজ, এগুলো চিরকালই চলে এসেছে। এখনও এই ধরণের গল্পে কাজ হলে ওই সাজটাই চলে। তাই আমাদের কাজের সময় গল্প মাথায় রেখে কাজ করতে হয়। রাবীন্দ্রিক প্রেক্ষাপটের গল্পে যেমন শিফন শাড়ি চলে না তেমনই এখনকার কোনও শহুরে গল্পে ঢাকাই শাড়ি চলবে না।

বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে এখন যে ধরণের ফ্যাশন চলছে সেটা কি কখনও সাধারণ মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে?

আসলে বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে সাজগোজের ধারাটা এখনও খুব একটা পরিণত নয়। বলতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি, বাংলার নায়িকারা যেভাবে সাজেন সেখানে ফ্যাশন জিনিসটা খুব একটা প্রতিফলিত হয় না। বেশিরভাগই খুব উগ্র সাজেন। সাজ সম্পর্কে ধারণা তাঁদের অনেকেরই বেশ কম। মুম্বইতে যেটা হয়, অনেকেই নিজে না বুঝলে এটা কাউকে দিয়ে করিয়ে নেন। তাদের নিজস্ব ডিজ়াইনার থাকেন। বাংলায় সাজগোজ নিয়ে ভাবনাচিন্তাটা একেবারেই নেই। ফ্যাশন আইকন হতে হলে সবসময় তাকে সচেতন থাকতে হবে।

আরও পড়ুন: যে মৃত্যু আজও রহস্য

কিন্তু হিন্দি ছবিতেও কি সবসময় ঠিকঠাক ফ্যাশন হয়ে থাকে? নামী নায়িকাদের আমরা মাঝেমাঝেই বেশ অদ্ভুত পোশাকে দেখি, কোনও বিখ্যাত ডিজ়াইনার হয়তো সেই পোশাকটা ডিজ়াইন করেছেন। কিন্তু দেখতে লাগছে হাস্যকর। এগুলোকে কি ফ্যাশন বলা যায়?

নিশ্চয়ই ফ্যাশন। আসলে ওইভাবে ফ্যাশনকে ভালো বা খারাপ বলে বিচার করা যায় না। লেডি গাগা একবার একটা কাঁচা মাংসের ড্রেস পরে স্টেজে এসেছিলেন, জানো তো। সেখানে ভালো বা খারাপের প্রশ্ন আসেই না। ওর উদ্দেশ্য ছিল সকলকে চমকে দেওয়া। এবার কে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে সাজবেন সেটা তার রুচির ব্যাপার। এটাকে আমি খারাপ বলতে পারব না। যে কারণে তিনি ওই পোশাক পরেছিলেন সেই উদ্দেশ্য তো সফল হয়েছে। সারা পৃথিবী তার দিকে তাকাতে বাধ্য হয়েছে। তাহলে সেদিক থেকে তো তিনি সফল। তাই ফ্যাশন জিনিসটা আপেক্ষিক, যিনি করছেন তার কাছে এটা যেভাবে অর্থবহ, বাকিদের কাছে সেই একই অর্থ নাও থাকতে পারে।

হিন্দি ছবিতে তো এক একটা গান শ্যুট করার জন্য আলাদাভাবে ডিজ়াইনার পোশাক বানানো হয়। সেট নিয়েও অনেক ভাবনাচিন্তা করা হয়। তো ওখানে ডিজ়াইনারদের যতটা কাজের সুযোগ থাকে সেটা কি বাংলা ছবিতে তুমি বা তোমার সঙ্গে যারা কাজ করেন তারা পান?

দেখো, বাংলা ছবিতে বাজেটটা একটা বড় ব্যাপার। সেটা মাথায় রেখেই আমাদের কাজ করতে হয়। যেমন ওখানে ধরো মাধুরী দীক্ষিত একটা লেহেঙ্গা পরবেন সেটাই কয়েক লাখ টাকা দামের হবে। এটা বাংলা ছবিতে ভাবাই যায় না। হয়তো এখানে ওই লেহেঙ্গার দামটাই একটা গোটা ছবির বাজেট। তাই সেগুলো মাথায় রেখেই আমাদের কাজ করতে হয়। 

আরও পড়ুন: যে জন থাকে মাঝখানে

সিনেমার বাইরেও তো একটা দুনিয়া আছে যেখানে ফ্যাশন নিয়ে রীতিমতো গবেষণা চলে। ফ্যাশন ট্রেন্ড বলে যে জিনিস বা পোশাক আমরা ডিজ়াইনারদের শোগুলোতে দেখি সেগুলো মধ্যবিত্ত মানুষের পোশাক হয়ে ওঠে না কখনওই। তাহলে যে পোশাক কেউ ব্যবহার করতে পারবেন না, সেটা তৈরি করার মধ্যে সার্থকতা কোথায়?

দেখো, ফ্যাশন দু’রকমের হয়। একটা যেটা ওই শো’তে পরার জন্য, আর একটা যেটা রোজ পরা যায়। যে পোশাকটা পরে ওই ফ্যাশন শোতে হাঁটা যায় বা কোনও ছবিতে নায়িকা যে পোশাক পরে গান গাইছেন, সেটা কিন্তু তিনি নিজেও রোজ পরেন না। ওটা ওই জায়গায় মানাচ্ছে, কিন্তু রাস্তায় পরে বেরোলে নাও মানাতে পারে। যেখানে যেটা মানায় আর কি। এটা যিনি পরছেন সম্পূর্ণই তার ওপরে যে তিনি কিভাবে জিনিসটা ক্যারি করছেন। বিয়েবাড়িতে যদি আমি জিন্স আর টি শার্ট পরে চলে যাই সেটা তো ভালো দেখায় না। আবার শ্রাদ্ধবাড়িতে একটা জমকালো শাড়ি পরে গেলে লোকে আমার দিকে তাকিয়ে দেখবে। তাই কোন পোশাকটা কোন জায়গায় পরা যায় সেটা বুঝে নিতে হবে। যেমন মাধুরীর ‘দিদি তারা দেওয়র দিওয়ানা’ যখন এলো, ওই সময় ওই ডায়মন্ড কাটের ব্লাউজের কথা কি আমরা ভাবতে পারতাম? সাধারণ মানুষ তখন ওই পোশাক শুধু কল্পনাতেই দেখতো। তবে এটাও ঠিক যে ইন্টারনেট আসার পরে সাধারণ মানুষও অনেক আধুনিকমনস্ক হয়েছে। আর এখন অনলাইন শপিংয়ের কারণে অনেকরকম পোশাক মানুষ পরছেন, আর সেগুলো অনেকটা হাতের নাগালের মাধ্যেও এসে গেছে।

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *