অভিনব, ভাবায় আভ্যন্তরীণ চিন্তার জটিলতা

সিরিজ়: পবিত্র পাপিজ়

পরিচালনা: দেবালয় ভট্টাচার্য

অভিনয়ে: সোহিনী সরকার, বিক্রম চট্টোপাধ্যায়, সায়নী ঘোষ, সৌরভ দাস, সায়ন ঘোষ, দেবপ্রিয় বাগচী, অঙ্কিতা চক্রবর্তী

দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ২ মিনিট (পাঁচ পর্বে)

RBN রেটিং: ৩.৫/৫

১৯২০ সালে ভয়ানক বিউবনিক প্লেগের কবলে পড়েছিল ইউরোপ ও এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। মানুষ মারা যাচ্ছিল গরু-ছাগলের মতো। মাত্র দেড় মাসের মধ্যে শুধু ইউরোপেই মৃত্যুর সংখ্যা ২.৫ কোটি ছাড়িয়ে যায়। ঠিক একশো বছর পর ২০২০-তে বিশ্ব আবার এক অতিমারীর মুখোমুখি। ভয়াবহ করোনা ভাইরাসের দাপটে ঘরবন্দী সবাই। যে যেখানে ছিল তাকে সেখানেই থেকে যেতে হলো অনির্দিষ্টকালের জন্য। চাইলেও বেরোবার উপায় নেই। কারণ? বাঁচতে হবে। মৃত্যুর আতঙ্ক বদলে দিয়েছে জীবনযাত্রা। চার দেয়ালের মধ্যেই ভোর থেকে রাত অবধি সাজিয়ে নিতে হচ্ছে রোজনামচার ক্যালেন্ডার। 




কিন্তু ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া কেন? কারণ দেবালয়ের ‘পবিত্র পাপিজ়’। লকডাউনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে কাহিনীর মূল সূত্র। লকডাউন না হলে এ সিরিজ় তৈরি হতো না। লকডাউন না হলে হতো না এতগুলো মৃত্যু, থাকত না তার কারণও। কীভাবে? এই সিরিজ় সারপ্রাইজ় গিফটের মোড়ক খোলার মতোই টানটান। শেষ হওয়ার পরেও মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে তার রেশ। 

অর্ণব (বিক্রম), দানিশ (সায়ন), এলফিনা (অঙ্কিতা), ফারুক (দেবপ্রিয়), বিন্নি (সোহিনী), চিত্রলেখা (সায়নী), একসময় কলেজে একসঙ্গে পড়া এই ছয় বন্ধুর চ্যাট গ্রুপের নাম পবিত্র পাপিজ়। লকডাউনের আগে যে যেখানে কাজের জন্য গিয়েছিল, সেখানেই থেকে যেতে হয়। সেভাবেই ফারুক রয়ে গেছে শিকাগোতে, অর্ণব আর এলফিনা মুম্বইতে, আর বাকি তিনজন কলকাতায়। চ্যাট গ্রুপে তারা সারাদিন আড্ডা দেয় আর একসঙ্গে ‘ডেথ জ়োন’ গেম খেলে। বাড়িতে বসে থেকে সকলেই বিরক্ত, যদিও তার মধ্যেই চলছে রান্নাবান্না, সোশ্যাল মিডিয়া ঘাঁটাঘাঁটি, ভালোমন্দ খাওয়াদাওয়া কিংবা মদ্যপান। চলে নিজেদের মধ্যে ছোটখাটো তর্ক, ঝগড়া, মনোমালিন্য, আদর্শের ঠোকাঠুকি। আবার তা মিটেও যায়। তবু সময় কাটে না। তাই ভালো না লাগলেও প্রতিদিন গেম খেলে তারা। এর মধ্যে কারোর-কারোর মধ্যে আবার রয়েছে বিশেষ বন্ধুত্বও। যেমন এলফিনা ও ফারুক, কিংবা এলফিনা ও দানিশ। আবার মোটামুটি স্থায়ী সম্পর্কে রয়েছে অর্ণব আর বিন্নি। কিন্তু চিত্রলেখা? অর্ণবের সঙ্গে তার কিসের সম্পর্ক? এমনই জটিল সমীকরণ নিয়ে এগিয়ে চলে ছয় বন্ধুর জীবন।

আরও পড়ুন: মাস্ক, স্যানিটাইজ়ার সঙ্গী করে শুরু হলো শুটিং

একদিন আলাদা চ্যাটে এলফিনার সঙ্গে কথা বলতে-বলতে দানিশ উঠে যায়। পরেরদিন চ্যাট গ্রুপে দানিশের আত্মহত্যার একটি ভিডিও পোস্ট হয়। সে ফোনের ভিডিও অন করে একটি সুইসাইডাল কোট বলে বিল্ডিংয়ের ট্যাঙ্কে ঝাঁপ দেয়। ঘটনার অস্বাভাবিকতায় বাকরুদ্ধ হয়ে যায় বাকি বন্ধুরা। দানিশ আর যাই হোক আত্মহত্যা করার ছেলে নয়। আর সে যদি মারা গিয়েই থাকে তাহলে তার মৃত্যুর ভিডিও গ্রুপে পাঠালো কে? তার মানে কি সেখানে অন্য কেউ ছিল?

পরেরদিন একইভাবে মারা যায় অন্য এক বন্ধু। এবারও একটি ভিডিও পোস্ট হয় গ্রুপে। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে অন্যান্যরা। এরপর তাহলে কে? পরপর এভাবে মৃত্যু তো আত্মহত্যা হতে পারে না? তাহলে কি খুন? কিন্তু কে? কেন? আর কীভাবে? কেন একইভাবে মারা যাচ্ছে সকলে? লকডাউনে কারোর পক্ষেই তো কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। একটা সময় তাদের মন বলে এই মারণখেলা এখানেই বন্ধ করা দরকার। কিন্তু কোথাও এক অদম্য আকর্ষণ তাদের টেনে নিয়ে যায় সেই খেলায়। এরই মাঝে গ্রুপে ঢুকে পড়ে সম্পূর্ণ অচেনা এক ব্যক্তি (সৌরভ)। কে সে? তার সঙ্গে বাকিদের সম্পর্ক কী?

আরও পড়ুন: বাইপোলার ডিসঅর্ডার থেকে চরম অবসাদ, হোমসে ‘ডুবে’ গিয়েছিলেন জেরেমি

টানটান উত্তেজনায় এই সিরিজ়ের কাহিনী এগোলেও ছোটখাট কয়েকটা অসঙ্গতি চোখ এড়াল না। লকডাউনের কারণে স্মার্টেফোনে শুট করা হয়েছে এই সিরিজ়। সেই জন্যই হয়ত কিছু জায়গায় সংলাপ খুব পরিষ্কার নয়। আলাদাভাবে ডাবিং করা সম্ভব ছিল না। তবে সংলাপের অস্পষ্টতা দর্শকের কাছে সিরিজ়টির গ্রহণযোগ্যতা কমাতে পারে। দ্বিতীয়ত: অর্ণব, এলফিনা, বিন্নি কিংবা চিত্রলেখাকে ফ্ল্যাটের বাইরে যেতে দেখা গেল কয়েকবার। কেউ নীচে গেল, তো কেউ ছাদে। কারোর মুখেই একবারের জন্যও মাস্ক দেখা গেল না। যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে গল্পের সূচনা, তার অনুষঙ্গ হিসেবে মাস্ক দেখালে প্রাসঙ্গিক হতো বলেই মনে হয়। আশেপাশে কেউ নাই থাকতে পারে, কিন্তু গল্প অনুযায়ী প্রত্যেকেই কোনও না কোনও কমপ্লেক্সে থাকেন। সেখানে মাস্ক ছাড়া ঘোরার দৃশ্য অস্বস্তি বাড়ায়। 

আর তৃতীয়ত: মোটিভ। শেষ পর্বে মৃত্যুর পেছনে কারণ জানার পর স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। তবে যতই অভিনব হোক, প্রথম দিকে তা যতটা প্রযোজ্য মনে হয়, শেষের দিকে খুনের কারণ হিসেবে কিছুটা সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়।

আরও পড়ুন: সব কান্নার শব্দ হয় না, বেজে উঠল পটদীপ

অল্প কিছু খটকা থাকলেও গল্পের অভিনবত্বের কাছে তা সহজেই উপেক্ষা করা যায়। যদিও আজকের প্রজন্ম এই ভাষাতেই স্বচ্ছন্দ তবু প্রতি কথায় এক্সপ্লেটিভসের ব্যবহার একটু কানে লাগে। লকডাউনের কারণে দৃশ্যগুলি শুট করেছেন অভিনেতাদের বাড়ির সদস্য বা নিকট বন্ধুরা। এদের প্রত্যেকের কাজের প্রশংসা করতেই হয়। পরিচালকের পক্ষেও কতটা কঠিন ছিল এতজন অভিনেতা ও তাদের আত্মীয় বন্ধুদের বুঝিয়ে কাজটা করানো, তা সহজেই অনুমেয়। অভিনয়ে সকলেই প্রশংসার দাবী রাখেন।

সব মিলিয়ে দুই ঘন্টার বিনোদনের পাশাপাশি বেশ কিছু অনিবার্য প্রশ্নও রেখে যায় ‘পবিত্র পাপিজ়’। ভাবতে বাধ্য করায় দর্শককে। গত কয়েক শতাব্দী ধরে চেষ্টা করেও কি মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে পাল্টানো গেছে? তা কি আদৌ সম্ভব? তবু এই সিরিজ়ের আভ্যন্তরীণ চিন্তার জটিলতা ভাবাবে দর্শককে। একটানা শেষ না করে ওঠা যায় না। সাধারণের তুলনায় থ্রিলারপ্রেমী দর্শক যে এই সিরিজ় বেশি উপভোগ করবেন এ কথা বলাই বাহুল্য। 

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *