শিশুদের গ্ল্যাডিয়েটর বানানোর বিরুদ্ধে
ছবি: হামি ২
পরিচালনা: নন্দিতা রায়, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
অভিনয়ে: ঋতদীপ সেনগুপ্ত, শ্রেয়ান সাহা, অরিত্রিকা চৌধুরী, গার্গী রায়চৌধুরী, অঞ্জন দত্ত, খরাজ মুখোপাধ্যায়, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, শিবপ্রসাদ
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ২০ মিনিট
RBN রেটিং ★★★★★★☆☆☆☆
‘কম্পিটিশনের যুগ’ কথাটা সেই সত্তর-আশির দশক থেকেই বাঙালি সমাজে খুব পরিচিত একটি শব্দবন্ধ। তবে সেই কম্পিটিশন ছিল স্কুল কলেজের বার্ষিক পরীক্ষায়, ভালো ছাত্র-ছাত্রী হওয়ার আশায়। সন্তানের পড়াশোনা বা অন্য কোনও যোগ্যতা নিয়ে গর্ব করার মানসিকতা সে যুগেও ছিল। যেটা ছিল না সেটা হলো লড়ে যাওয়ার বা লড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা। শেষের দশকের শুরু থেকেই এই প্রবণতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। সৌজন্যে অবশ্যই গৃহকোণের গোবেচারা বোকা বাক্সটি। প্রথমে গান, পরে নাচ এবং তারপরে শিশুদের নানা ট্যালেন্ট নিয়ে একটা দুটো থেকে শুরু করে অজস্র অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে ক্রমশ তাদের নিয়ে এক বিরাট ব্যবসা খুলে বসল টেলিভিশন চ্যানেলগুলি। তাদের তোল্লাই দিয়ে সাহায্য করলো স্বয়ং শিশুদের অভিভাবকরাই। উৎসাহ দেওয়ার নামে বাচ্চাদের ট্যালেন্ট নিংড়ে তাদের শৈশব এবং ভবিষ্যত নষ্ট করার নিরন্তর খেলা শুরু হলো, যা হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। সেই সর্বনেশে খেলায় না বুঝেই নিজের সন্তানকে আহুতি দিতে রোজ এগিয়ে আসছেন কত শত বাবা মায়েরা।
গত কয়েকবছর যাবত নানা সামাজিক বিষয় নিয়ে ছবি করতে দেখা গেছে নন্দিতা-শিবপ্রসাদ জুটিকে। সেই বিষয় বৈচিত্রে নবতম সংযোজন ‘হামি ২’। এর আগে ২০১৮ সালে ‘হামি’ ছবিটি ছিল শিশুদের সহজ সম্পর্ক নিয়ে অভিভাবকদের অতি সচেতনতা বিষয়ক।
‘হামি ২’ আবারও ফিরিয়ে আনল শিশুদের জগৎকে। লাল্টু (শিবপ্রসাদ) ও মিতালির (গার্গী) বড় ছেলে সিদ্ধার্থ ওরফে ভেঁপু (ঋতদীপ) ক্লাস থ্রিতে পড়ে। বিভিন্ন বিষয়ে তার আগ্রহ ও জানার পরিধি সকলকে তাক লাগিয়ে দেয়। বিরাট-বিরাট অঙ্ক অনায়াসে মুখে-মুখে করে ফেলতে পারে ভেঁপু। এমনকি উঁচু ক্লাসে সুদের অঙ্ক অবধি সে শিখে ফেলে নিজের আগ্রহেই। বই আর ইন্টারনেট ঘেঁটে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে সে যেমন নিজে শেখে তেমনই শেখায় ছোট্ট ভাই চিনুকেও (শ্রেয়ান)।
আরও পড়ুন: শেষ দৃশ্যে ভাঙা হোল্ডার, সত্যজিতের জয়জয়কার
দুই ছেলেকে নিয়ে লাল্টুর গর্বের শেষ নেই। একদিন এক বইয়ের দোকানে গিয়ে কয়েকটি কঠিন অঙ্কের সঠিক জবাব দেয় ভেঁপু। সেই ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হয়ে রাতারাতি ভেঁপুকে বিখ্যাত করে তোলে। বাড়িতে এসে হাজির হয় বড়-বড় রিয়ালিটি শোয়ে বাচ্চাদের ট্রেনিং দিয়ে তৈরি করে দেওয়া প্রশান্ত (খরাজ)। ক্রমশ সে মিতালিকে তাতিয়ে, বিরাট অঙ্কের টাকার লোভ দেখিয়ে ভেঁপুকে এক ট্যালেন্ট শোতে নিয়ে হাজির করে। সেখানে গিয়ে ভেঁপুর বন্ধুত্ব হয় ছোট্ট রুকসানার (অরিত্রিকা) সঙ্গে, যে তার মতোই প্রতিভাবান। কী হয় তারপর? গোটা ছবি জুড়েই একদিকে যেমন রয়েছে ছোটবেলার অজস্র আনন্দ, তেমনই এক অদ্ভুত কষ্ট গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে যায়।
আরও পড়ুন: বেহিসেবী জীবনযাপন, আজ স্মৃতির অতলে সৌমিত্র
লাল্টু-মিতালির জুটি এর আগে ‘রামধনু’ ও ‘হামি’ ছবিতেও এসেছে। যদিও সেখানে পদবী এবং পারিপার্শ্বিক সবটাই আলাদা ছিল, তবু দুটি চরিত্র ঘুরেফিরে আসে বিভিন্ন ছবিতে। সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ের মতো এবারে এই জুটি শিশুদের মধ্যে দিয়ে বাবা মায়ের স্বপ্ন চরিতার্থ করার অদম্য বাসনার গল্প শুনিয়ে যায়। যে মায়ের কোল শিশুর নিশ্চিন্ত আশ্রয়, সেই মা যখন তার সন্তানকে এক অজানা লড়াইয়ে গ্ল্যাডিয়েটর বানানোর দিকে ঠেলে দিয়ে নিজে দূরে দাঁড়িয়ে হাততালি দেয়, তখন অচিরেই শৈশবের অপমৃত্যু ঘটে। যে প্রতিভার বিচ্ছুরণ শিশুকে তার বন্ধুদের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, আপন ভাইকেও কাছে আসতে দেয় না, শৈশবের সহজ স্বাভাবিক আনন্দ উপভোগ করতে দেয় না সেই প্রতিভা কোন কাজের? প্রশ্ন তুলেছেন পরিচালকদ্বয়। মাস্টারমশাই (অঞ্জন) এই স্বাভাবিক কথাটাই বোঝাতে চেয়েছেন ভেঁপুকে। বেশিরভাগ বিস্ময় বালক বালিকার মেয়াদ খুব স্বল্পদিনের। কারণ নতুন বিস্ময়রা পরের সারিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। অনেকটা হাঙরের দাঁতের মতো। তাই বিস্ময় হওয়ার চেয়ে বিস্মিত হওয়া অনেক আনন্দের।
আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি
রিয়্যালিটি শোয়ের মঞ্চে যেসব শিশুদের অসাধারণ গাইতে বা নাচতে দেখা যায়, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই হারিয়ে যায় কিছুদিনের মধ্যে। হয়তো প্রতিযোগিতার অতিরিক্ত চাপের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে না। আর না হলে একটা সময়ের পর তাদের আর নাচ বা গানের প্রতি আকর্ষণ থাকে না। আসলে সৃজনশীলতার কোনও বিচার হয় না, এ কথা অনেক বাবা মায়েরাই ভুলে যান। প্রত্যেকটি শিশু তার নিজের মতো করে পারদর্শী, নিজের মতো করে গুণী। প্রতিভার কোনও মাপকাঠি নেই, দেওয়া যায় না নম্বরও। রিয়্যালিটি শোয়ের ফরম্যাট ও তার কঠিন শ্যুটিং শিডিউল নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। এই ছবিতে খুব স্পষ্টভাবে দেখানো হয়েছে এই ব্যাপারগুলো। এমনকি প্রতিযোগী অসুস্থ হলেও তার নিস্তার নেই, যদিও সঞ্চালকের ভূমিকায় প্রসেনজিৎকে ছবিতে কিছুটা সহমর্মী লেগেছে, তবু আদতে তারকা সঞ্চালকরা এসব নিয়ে মাথা ঘামান বলে মনে হয় না।
ভেঁপু, চিনু এবং রুকসানার চরিত্রে তিন ক্ষুদে অভিনেতা এই ছবির প্রাণ। তিনজনের অভিনয়ই চমকে দেওয়ার মতো। তিনটি শিশুই এই ছবির মূল চালিকাশক্তি, যারা দর্শককে হাসতে এবং কাঁদতে বাধ্য করবে। লাল্টু এবং মিতালির চরিত্রে শিবপ্রসাদ ও গার্গীকে দেখতে দর্শক অভ্যস্ত। চেনা চরিত্রে ভালো কাজ করেছেন দুজনেই। প্রশান্তর চরিত্রে প্রত্যাশা মতোই মানিয়ে গিয়েছেন খরাজ। স্বল্প পরিসরে অনবদ্য অঞ্জন। গত কয়েক বছরে নানারকম চরিত্রে নিজেকে মেলে ধরছেন প্রসেনজিৎ। এই ছবিতে নিজের চরিত্রে ক্যুইজ মাস্টারের ভূমিকায় তিনি অসাধারণ।
অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের সুরে ছবির গানগুলো শুনতে ভালো লাগে। অনেকগুলো মজাদার গানের মধ্যে ‘দাদাভাই’ গানটি আলাদা করে মনে থেকে যাবে।
আজকের বাচ্চাদের শৈশব হারিয়ে যাচ্ছে বলে প্রতিদিন অজস্র কালি, প্রিন্ট এবং ইন্টারনেট ডেটা খরচ হয়। অন্যদিকে অতি সক্রিয় অভিভাবকেরাই শেষ করে দেয় শিশু মনের কোমলতা, দুর্বিষহ করে তোলে তাদের জীবন। বাবা মায়েদের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা জাগিয়ে তোলার কাজকে আরও গুরুত্ব সহকারে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দরকার, এ কথা বুঝিয়ে দেয় ‘হামি ২’। কচিকাঁচাদের সৃজনশীলতা ভাঙিয়ে চলতে থাকা দেশব্যাপী এই ব্যবসাকে বন্ধ করতে অবিলম্বে সবরকম মাধ্যমের এগিয়ে আসা প্রয়োজন।