কুয়াশায় মেখে একাকীত্ব

ছবি: নীহারিকা

পরিচালনা: ইন্দ্রাশিস আচার্য

অভিনয়ে: অনুরাধা মুখোপাধ্যায়, শিলাজিৎ মজুমদার, মল্লিকা মজুমদার, অনিন্দ্য সেনগুপ্ত

দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ৭ মিনিট

RBN রেটিং ★★★★★★★★☆☆

একটি বালিকা বা কিশোরীর নারী হয়ে ওঠার পর্যায়গুলো নিছক শারীরবৃত্তীয় নয়, বরং অনেকটাই মানসিক এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে যন্ত্রণাদায়ক কিছু অভিজ্ঞতা। বহু মেয়ের ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠা এইভাবেই হয়ে থাকে। তার চারপাশের সমাজ তাকে আর কিশোরী হয়ে থাকতে দেয় না। জোর করেই বড় করে দেয়। দীপার মুখে এই সত্যেরই প্রতিধ্বনি শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল তার ছোটমামা। বাস্তব সেই প্রাচীনকাল থেকেই একরকম।



তবে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভয়’ উপন্যাসে দীপার অভিজ্ঞতা ছিল এর থেকেও ভয়ঙ্কর। অস্থির ছোটবেলা, সন্ধের পর বাড়ির নোংরা পরিবেশ, প্রতিদিন মায়ের প্রতি বাবার চরম দুর্ব্যবহার, সব মিলিয়ে ক্রমাগত কোণঠাসা হয়ে বেড়ে ওঠে দীপা। একসময় কলকাতা ছেড়ে প্রকৃতির কোলে নির্জনতার মধ্যে দীপা যেন আরও বেশি করে নিজেকে উপলব্ধি করে।

বয়ঃসন্ধির সময়ের নিগ্রহ আজীবন সঙ্গে থেকে যায়। আর সেই নিগ্রহ যদি আসে কাছের মানুষের থেকে তবে তার দাগ মোছা অসম্ভব। সেই যন্ত্রণা থেকে নিজেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করলেও অন্য এক ভীতি, একাকীত্ব যেন জড়িয়ে ধরতে চায় দীপাকে। চেনা কলকাতা তার কাছে যেমন অসহ্য ঠেকে তেমনই অচেনা অজানা মালভূমি অঞ্চল শিমূলতলা যেন তাকে দু’হাত বাড়িয়ে স্বাগত জানায়। এখানে এসে সে নিশ্চিন্ত আশ্রয় পায় নীহারিকায়। মামীর শান্ত সাহচর্য, মামার বন্ধুত্ব এবং অভিভাবকত্ব সবদিক থেকে আগলে রাখে দীপাকে। তবু দুর্ভাগ্য দীপাকে তাড়া করে বেড়ায়।

আরও পড়ুন: “আর ভালো লাগছে না”

ইন্দ্রাশিসের ছবিতে একাকীত্ব বারবার ঘুরেফিরে আসে। ছোটবেলায় মা, তারপরে ছোটমামা এবং তারও পরে মেঘাকে অবলম্বন বেঁচে থাকতে চাইলেও দীপার জার্নিটা শেষ পর্যন্ত তার একারই থেকে যায়। কুয়াশায় মেখে দীপার একাকীত্ব যেন রূপ পায় শিমূলতলার প্রকৃতির ছায়ায়। আলাদা-আলাদা ঋতুতে সেজে উঠে প্রকৃতি দীপার অন্তরের জল হাওয়া ঝড়কেই যেন বুঝিয়ে দিয়ে যায়। উচ্চাকাঙ্ক্ষী রঙ্গনের এমন জনমানবহীন জায়গা ভালো লাগে না। কারণ এখানে কোনও উন্নতি নেই। তার মতে হাওয়া বদলের জন্য ক’দিন থাকতে এলে ভালো লাগতে পারে, সবসময় নয়। তবু মামীর মতোই দীপাও ক্রমশ সেই নিস্তব্ধতাকেই আপন করে নেয়।

কুয়াশায় মেখে

প্রকৃতি আর সম্পর্কের ভেতরের না বলা এক বন্ধন ছবি এগোবার পাশাপাশি দর্শককে জারিত করতে থাকে। ভালোবাসা আর না-ভালোবাসা দুটোই দীপা চরিত্রকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ যখন বহুজন পরিবৃত হয়ে থাকে তখন সে নিজেকে সেভাবে জানতে পারে না। তাই প্রকৃতি আর নীহারিকা দীপাকে এতটা প্রভাবিত করেছিল। তার নিজের সম্পর্কে উপলব্ধি—সে যতই সমাজ অনুমোদিত নিয়মের বাইরে হোক না কেন—খুব সৎ ও স্বাভাবিক ছিল। নিজের সঙ্গে ভন্ডামি করে মুখোশ পরার মতো মেয়ে ছিল না দীপা।

আরও পড়ুন: ফেলু-ব্যোমকেশের পর এবার কি হোমসের ছড়াছড়ি?

ছবির কয়েকটি দৃশ্য বেশ লম্বা, যেমন রুক্ষ প্রান্তরের ভেতর একফালি রাস্তা ধরে গাড়ি চলে যাওয়া, বা বারান্দায় কারও দাঁড়িয়ে থাকা। তবে ‘নীহারিকা’র কাহিনি আর চরিত্রদের মানসিক গভীরতা যেন এই সময়টুকুই দাবি করে। ছবির গতি ধীর হলেও দেখার আগ্রহ কমে না। দীপা চরিত্রের ভেতরে একাধিক স্তর ছবি শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও রেশ রেখে যায়। কোথাও যেন চরিত্রটাকে সম্পূর্ণ না বুঝতে পারার কাঁটা খচখচ করে।

মৃত্যু এ ছবিতে অন্যভাবে এসেছে। দুটি মৃত্যুর ক্ষেত্রেই সরাসরি সে দৃশ্য পরিচালকের চোখ দিয়ে আমরা দেখতে পাই না। ফলে আবেগ কম হলেও সে ঘটনার অভিঘাত বেড়ে যায় অনেকটাই। একজন মানুষ এই ছিল আবার এই নেই হয়ে গেল। এটা যেন মৃত্যু দৃশ্যের চেয়ে অনেক বেশি অর্থবহ হয়ে ওঠে। দীপার ভেতরের শূন্যতাকে আরও বেশি করে প্রকট করে তোলে।

আরও পড়ুন: ‘মাসুম’-এর সিক্যুয়েল করবেন শেখর?

প্রকৃতির স্বাভাবিক শব্দ যেমন বৃষ্টি পড়া, ঝর্নার বয়ে যাওয়া থেকে জলে ঢিল ছোঁড়া দৃশ্যগুলিকে জীবন্ত করে তোলে। জয় সরকারের আবহ সঙ্গীতের পরিমিতিবোধ কানকে আরাম দেয়। অনুরাধার লিপে ‘মলয় বাতাসে’ গানটি শুনতে ও দেখতেও মধুর লাগে। তাঁর গানের সঙ্গে ঠোঁট মেলানো প্রশংসার দাবি রাখে। বস্তুত এর আগে কোনও ছবিতে অনুরাধা এভাবে নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ পেয়েছেন কিনা জানা নেই। দীপা চরিত্রের জন্য তিনি নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ নির্বাচন। কোথাও তাঁকে চরিত্রের থেকে আলাদা করে ভাবা যায়নি।

শুধু দীপা নয়, তার ছোটমামা এবং মামী দুজনের চরিত্রই গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে। আসলে এই ছবির বেশিরভাগ চরিত্রই নিজের ভেতরে বিপুল পরিমাণে নীরবতা ও আবেগ লুকিয়ে রাখে।

আকাশের চরিত্র যেমন গভীর তেমনই জটিলও। একদিকে ব্যস্ত ডাক্তারের তৎপরতা অন্যদিকে মা-হারা ভাগ্নির প্রতি কর্তব্য, কোনওদিকেই আকাশের নজর কম ছিল না। এর মধ্যেও নিজের আদিম ইচ্ছাকে লালন করে এক পাহাড় সমান অপরাধবোধে ভুগতে থাকা চরিত্র আকাশ। অনেকাংশেই বাস্তব এই চরিত্রে শিলাজিৎ অনবদ্য অভিনয় করেছেন। অসামান্য তাঁর অভিব্যক্তি এবং সংলাপ বলার স্বাভাবিকতা। কোথাও পরিণত, স্নেহময় আবার কোথাও উচ্ছ্বল, উদ্দাম, প্রতিটি দৃশ্যে মুগ্ধ করেন তিনি। বলিষ্ঠ চরিত্রাভিনেতা রূপে শিলাজিৎকে নিয়ে বাংলা ছবির পরিচালকরা আর একটু ভাবতে পারতেন।



এ ছবির আর এক উজ্জ্বল আবিষ্কার মল্লিকা। নিঃসঙ্গতায় মোড়া ধীর স্থির অথচ স্পষ্টবক্তা কেয়ার উপস্থিতি এ ছবিতে বিবেকের মতোই শক্তিশালী। সে থেকেও নেই, অথচ তার চোখ আর শরীরীভাষা বুঝিয়ে দেয় সবটাই। আবার তার না থাকা কোথাও যেন প্রায়শ্চিত্তের আগুনে ঝলসে দেয় অন্যদের। মল্লিকা অবাক করেছেন নিঃসন্দেহে। ছোট চরিত্রে অনিন্দ্য মানানসই। দীপার সঙ্গে রঙ্গনের চরিত্রের যে কনট্রাস্ট, তাকে দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি।

শান্তনু দে’র চিত্রগ্রহণ অসাধারণ। প্রকৃতিকে ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে পরিণত করেছেন তিনি। বিভিন্ন ঋতুতে শিমূলতলার রূপকে তিনি অসামান্যভাবে পেশ করেছেন। লুব্ধক চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনা যথাযথ। বর্ষার আমেজ গায়ে মেখে প্রেক্ষাগৃহে দেখার মতোই ছবি ‘নীহারিকা’। ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকৃতিকে এভাবে উপলব্ধি করার সুযোগ পাওয়া যাবে না।




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *