মা বলেছিলেন এই শহর ছেড়ে চলে যেতে: নাইজেল

২০১২, প্রথম ছবি ‘মুক্তধারা’। তারপর একে একে সৃজিত মুখোপাধ্যায়, রাজ চক্রবর্তী, সুমন মুখোপাধ্যায়ের মতো পরিচালকের সঙ্গে কাজ। সাত বছর পর আবার নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে ফিরছেন নাইজেল আকারা। জন্মাষ্টমীর দিন মুক্তি পেতে চলেছে নন্দিতা-শিবপ্রসাদের পরবর্তী ছবি ‘গোত্র’।

তবে ‘মুক্তধারা’র পূর্ববর্তী জীবনটা একেবারেই মসৃণ ছিল না নাইজেলের। অপহরণের মতো একাধিক অপরাধে দীর্ঘ ন’বছর জেলে থাকতে হয়েছে তাঁকে। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার সময় একদিন নাইজেলের মা আসেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। “মা বলেছিলেন কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে, কেন না আমার কারণে তাঁকে এত অসন্মানের মধ্যে দিয়ে হয়েছে যে তিনি চাননি আমি এই শহরে থাকি,” বললেন নাইজেল। “কিন্তু আমি মা’কে কথা দিয়েছিলাম, থাকলে কলকাতাতেই থাকব, আর এই শহরেই তোমার সন্মান আমি তোমাকে ফিরিয়ে দেব।”




রাজী হয়েছিলেন মা। ছেলেকে দু’মাস সময় দিয়েছিলেন নিজেকে প্রমাণ করার জন্য। জেল থেকে বেরোবার পর অন্য একটি ভাড়া বাড়িতে থাকতে শুরু করেন নাইজেল। মায়ের সঙ্গে থাকতে পারতেন না তিনি। “তখন কাজের জন্য নানান অফিসে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কিন্তু যেখানেই যাই আমার অতীতের কথা শোনার পর আর কেউ আমাকে কাজ দিতে চায় না। কেউ বিশ্বাসও করে না আমাকে। তখন ভাবলাম এমনিতে তো কেউ কাজ দেবে না, তার চেয়ে এই সব অফিসের বাথরুম পরিস্কারের কাজ করব। এভাবে ধীরে ধীরে বিভিন্ন অফিসে গিয়ে কাজ করা শুরু করলাম,” রেডিওবাংলানেট-কে জানালেন নাইজেল।

আরও পড়ুন: রক্তবরণ মুগ্ধকরণ

এই সময় ‘মুক্তধারা’ ছবির জন্য জেলের সংশোধন পদ্ধতি নিয়ে রিসার্চ করছিলেন নন্দিতা- শিবপ্রসাদ। তাঁরা নাইজেলকে নির্বাচিত করেন ‘মুক্তধারা’ ছবির প্রধান চরিত্রের জন্য। নাইজেলের নিজের কথায়, “আমি আসলে সমাজে একটা জায়গা পাওয়ার জন্য লড়ছিলাম। সকলকে বলতে চাইছিলাম যে আমার অপরাধের শাস্তি আমি পেয়েছি। এবার আমি সকলের সঙ্গে থাকতে চাই, মানুষের সঙ্গে মিশতে চাই। সেই সুযোগটুকু অন্তত আমাকে দেওয়া হোক। আমি কোনও জন্তু নই, আমাকে আলাদা করে রেখো না তোমরা। সেই সুযোগটা আমাকে করে দিলেন শিবুদা আর নন্দিতাদি। শিবুদা আমাকে বলেছিলেন ওনার অফিসে গিয়ে কাজ করতে। সেখানে কাজ করতে করতে আরও ভালোভাবে আলাপ হল। ওনাদের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। নন্দিতাদি-শিবুদার জন্যই আমি সমাজে এত তাড়াতাড়ি নিজের জায়গা করতে পেরেছি। ‘মুক্তধারা’ না হলে মানুষ এত সহজে আমাকে আপন করে নিতেন না। রাস্তায় বেরোলে মানুষ আমাকে চিনতে পারছেন, অটোগ্রাফ চাইছেন, এগুলো সবই ওনাদের জন্য সম্ভব হয়েছে। হঠাৎ করেই আমার জীবনটা পাল্টে গেল। তাই এই দুটো মানুষকে আমি খুব শ্রদ্ধা করি। সমাজের কাছে যে স্বীকৃতি আমি চেয়েছিলাম সেটা নন্দিতাদি আর শিবুদার জন্যই পেয়েছি। ‘মুক্তধারা’র পরে এতদিন অপেক্ষা করেছিলাম কবে আবার ডাক পাব।”

আরও পড়ুন: তিন মূর্তি ও পায়ের তলায় সরষে

কীভাবে আলাপ হল পরিচালকদ্বয়ের সঙ্গে?

“২০০৯-এ আমি জেল থেকে বেরোই,” বললেন নাইজেল। “তখন যে করে হোক আমাকে একটা কাজ জোগাড় করতে হবে। কোনও কাজ না পেয়ে আমি একটা ক্লিনিং এজেন্সি খুলি। অফিসে অফিসে গিয়ে তাদের বাথরুম পরিষ্কার করতাম। এই কাজে আরও কয়েকজনকে পেয়ে গেলাম আমার মতই। তাদের নিয়ে তৈরি করলাম নিজের কোম্পানি।”

এই সময় বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী অলকানন্দা রায়ের উদ্যোগে জেলের কয়েদীদের নিয়ে ‘বাল্মিকীপ্রতিভা’ গীতিনাট্য মঞ্চস্থ হয়। নাইজেল এই গীতিনাট্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। “বিড়লা সভাঘরে একটা শো ছিল সেদিন,” স্মৃতি হাতড়ে বললেন ‘গোত্র’র তারেক আলি। “সেখানেই নন্দিতাদি ও শিবুদা আমাকে দেখেন। শিবুদা আমার সঙ্গে দেখা করে বলেন, আমরা ‘মুক্তধারা’ নামে একটা ছবি করছি। জেলের ভেতরের জীবন, সংশোধনের থেরাপি এসবই থাকবে ছবিতে। আমরা চাই ছবির মুখ্য চরিত্রে তুমি অভিনয় করো। আমি বললাম, আমি তো অভিনয়ের কিছুই জানি না, আমি কি পারব? শিবুদা বলেছিলেন, ওয়ার্কশপ করতে হবে। সেটা ৪৫ দিন ধরে খুব মন দিয়ে করেছিলাম । শিবুদা একটা কথা বলেছিলেন, আমাদের যা দরকার আমরা ঠিক তোমার থেকে বার করে নেব, তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না।”

আরও পড়ুন: বিশ্বনাথের বারাণসী, বারাণসীর বিসমিল্লাহ

‘মুক্তধারা’র পর মানুষের সঙ্গে পরিচিতির বাড়ে নাইজেলের। তাঁর ক্লিনিং এজেন্সিও বেড়ে ওঠে ধীরে ধীরে। ২০১৪-তে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট নাইজেলের কোম্পানির বেড়ে ওঠার ঘটনাকে তাদের সিলেবাসের কেস স্টাডিতে অন্তর্ভুক্ত করে। কোম্পানিকে আরও বাড়াতে নতুন কিছু কাজকে কোম্পানির আওতায় নিয়ে আসেন নাইজেল, যেমন ইলেট্রিশিয়ন, কেয়ারটেকার, প্লাম্বার। “তখন যারা জেল থেকে বেরিয়ে কাজ পেত না তাঁরা নিজেরাই ঠিকানা জোগাড় করে চলে আসত। জেলে থাকতে বিশেষ কিছু কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, বাইরে আসার পর যাতে সেই কাজ করে তাঁরা জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। কিন্তু কেউ যদি তাদের কাজই না দেয় তাহলে তারা শোধরানোর সুযোগ কী করে পাবে? আমি এদেরকে জীবনের মূল স্রোতে ফেরানোর কাজটা করি,” বললেন আত্মবিশ্বাসী নাইজেল।



‘গোত্র’তে তারেক আলির চরিত্রটি বাস্তবে নাইজেলের সংস্থারই একটি ছেলেকে করতে হয়েছিল শিবপ্রসাদের বাড়িতে।

সামাজিক কাজেও নিজেদের ব্যস্ত রাখার জন্য গত বছর নাইজেল গড়ে তোলেন কোলাহল নাট্যসংস্থা। শুধু জেলের অপরাধী নয়, সমাজের যারা পিছিয়ে পড়া শ্রেণী, যেমন যৌনকর্মী বা নেশায় আসক্ত মানুষদের নিয়েও নাটক করানো হয় এখানে। “একটা সময় আমি নিজে সমাজে ব্রাত্য ছিলাম। মঞ্চ আমাকে একটা নতুন পথ দেখিয়েছে। আমি চাই এদের সকলের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার পথেও স্টেজের একটা ভূমিকা থাকুক,” বললেন নাইজেল।

ছবি: অর্ক গোস্বামী

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *