প্রজাপতির ডানায় স্বতন্ত্র উড়ান

ছবি: শান্তিলাল ও প্রজাপতি রহস্য

পরিচালনা: প্রতিম ডি গুপ্ত

অভিনয়ে: ঋত্বিক চক্রবর্তী, পাওলি দাম, গৌতম ঘোষ, অলকানন্দা রায়, অম্বরীশ ভট্টাচার্য

দৈর্ঘ্য: ১ ঘন্টা ৪৩ মিনিট

RBN রেটিং: ৩.৫/৫

সুন্দর রঙিন প্রজাপতির জন্ম হয় কালো কুৎসিত শুককীট থেকে, যাকে সহজ বাংলায় বলা হয় শুঁয়োপোকা। গুটির ভিতর থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে পিউপা, সেখান থেকে কীট। তারপর ডানা মেলে উড়তে থাকে রঙিন প্রজাপতি। কিন্তু সৌন্দর্যের আবির্ভাবের পর প্রজাপতি কি তার কুৎসিত অতীত মনে রাখে? অতীত মেটানো কিন্তু বড়ই কঠিন। ‘শান্তিলাল ও প্রজাপতি রহস্য’র কথা বলতে গেলে এই ভূমিকাটুকু না দিলেই নয় কারণ প্রতিমের ছবির গতিপথ নির্ধারিত হয়েছে এই প্রজাপতির জন্ম ঘিরেই।




বর্তমানে বাংলা ছবির জগতে থ্রিলার বানানোর যে নতুন ধারা তৈরি হয়েছে, ‘শান্তিলাল ও প্রজাপতি রহস্য’ তার থেকে কিছুটা হলেও ব্যতিক্রমী। বাংলায় এই ধরণের গল্প সম্ভবত এই প্রথম।

ছবির গল্প শুরু হয় ‘দ্য সেন্টিনেল’ নামক পত্রিকার আবহাওয়া রিপোর্টার শান্তিলাল ভট্টাচার্যকে (ঋত্বিক) দিয়েই। সকালে ঘুম থেকে উঠে মায়ের (অলকানন্দা) হাতের রুটি আর কুমড়োর তরকারি খেয়ে অটো চেপে অফিস যায় সে। অফিসে গিয়ে বসের চোখ রাঙানিকে সহ্য করে তার কথামত মিথ্যে খবর লিখে ক্লান্ত শান্তিলাল। দিনের শেষে বিরক্ত হয়ে মদ্যপান করতে করতে অফিসের আর এক সহকর্মীর কাছে নয় বছর ধরে এই এক জাঁতাকলে পিষতে থাকার কাঁদুনি গেয়ে দিনযাপন হয় তার। সংবাদমাধ্যমের এই ভাঁওতাবাজি মানতে পারে না শান্তিলাল। অবিবাহিত, তিরিশোর্ধ এই অতি সাধারণ সাংবাদিক তার কামুক মনোভাব নিবৃত্ত করে রাতে নিষিদ্ধ ছবি দেখে। একঘেয়ে এই রাত্রিযাপণ করতে গিয়েই সে জড়িয়ে পড়ে এক অদ্ভুত রহস্যে যা কেরাণীসুলভ শান্তিলালকে বানিয়ে তোলে এক তীক্ষ্ণ চরিত্রের গোয়েন্দা। নিষিদ্ধ ছবির এই জগত থেকেই সে পেয়ে যায় তার জীবনের সব থেকে বড় ‘স্টোরি’।

আরও পড়ুন: পদাবলীর হাত ধরে মঞ্চে ফিরল ‘ক্ষুদিরাম’

ছবির প্রথমার্ধে শুধুই মাকড়শার মত জাল বুনতে থাকে রহস্য যা সমাধানের জন্য দ্বিতীয়ার্ধে অধীর অপেক্ষায় বসে থাকতেই হয়। ‘শান্তিলাল ও প্রজাপতি রহস্য’র অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্ৰ চলচ্চিত্র জগতের মহাতারকা নন্দিতা (পাওলি)। এই গ্ল্যামার কুইনের অতীত জীবন ঘিরেই রহস্যের গন্ধ পায় শান্তিলাল। কলকাতা থেকে সংগৃহীত তথ্যের সত্যতা বিচার করতে সে পৌঁছে যায় চেন্নাই তারপর সেখান থেকে সিঙ্গাপুর, যেখানে এই রহস্যের আসল চমক অপেক্ষা করে থাকে। কলকাতা ফিরে এই ‘স্টোরি’ সে তার সম্পাদককে বিক্রি করে কাগজের প্রথম পাতায় বড় বড় হেডিংসহ তার বাইলাইন বেরোনোর স্বপ্ন দেখে।

আর এখানেই ঘুরে যায় গল্প।

নন্দিতা ও শান্তিলালকে কেন্দ্র করেই এগিয়েছে প্রতিমের ছবি। একজনের জীবন ঘিরে রহস্যের সৃষ্টি এবং অন্যজনের সেই রহস্য উন্মোচনের প্রচেষ্টা। এই প্রথম কোনও গোয়েন্দা চরিত্রে অভিনয় করলেন ঋত্বিক। বাঙালির চিরকালীন আইকন ফেলুদা বা ব্যোমকেশ নয়, একজন নিতান্তই নিরীহ বঙ্গসন্তানের বুদ্ধিদীপ্ত উপস্থিতি গোয়েন্দা শান্তিলালকে সবার থেকে আলাদা করে দেয়। বরাবরের মত তাই এই নতুন চরিত্রেও ঋত্বিক অনবদ্য।

আরও পড়ুন: বিশ্বনাথের বারাণসী, বারাণসীর বিসমিল্লাহ

প্রশংসার দাবি রাখে পাওলির অভিনয়। রাজনীতির জগতে এই গ্ল্যামারাস অভিনেত্রীর পদার্পণ নিয়ে এক সাংবাদিককে অস্বস্তির মুখে ফেলে নন্দিতা তার দৃপ্ত কণ্ঠে জানিয়ে দেয়, এই সমাজের পুরুষরা চায় না ‘অব দ্য ওম্যান, ফর দ্য ওম্যান, বাই দ্য ওম্যান।’ তাই একজন পুরুষের রাজনীতিতে আসা নিয়ে কোনও প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হয় না যতটা একজন মহিলার ক্ষেত্রে হয়। জীবনে বড় হওয়ার রাস্তায় অনেক বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছে নন্দিতা। তার ভাষায়, সে বারংবার ‘নির্যাতিত, ব্যবহৃত, পুনঃব্যবহৃত’ হয়েছে। অতীত জীবনের ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে কোথাও যেন ক্লান্ত অথচ দৃঢ় এই নায়িকার চরিত্রটি সুনিপুণভাবে বুনেছেন পাওলি। কোথাও কোনও খুঁত নেই।

খবরের কাগজের সম্পাদকের চরিত্রে গৌতম ঘোষ যে একজন তুখোড় অভিনেতা, তার প্রমাণ আরও একবার পাওয়া গেল। এছাড়া অলকানন্দা ও রকেট রঞ্জনের ভূমিকায় অম্বরীশ যথাযথ। দুটি বিশেষ চরিত্রে রয়েছেন পরিচালক অভিজিৎ গুহ এবং সৃজিত মুখোপাধ্যায়।

আরও পড়ুন: খেল দিখা সকোগে না?

তবে সবকিছুর মধ্যে একটা খটকা। হঠাৎ করে চেন্নাইতে রকেট রঞ্জন কোথা থেকে উদয় হল এবং কেনই বা সে শান্তিলালকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল, এই ধন্ধটা রয়েই গেল।

ছবিতে ক্যামেরার কাজ দুর্দান্ত। কলকাতা, চেন্নাই ও সিঙ্গাপুরের বিশদ দৃশ্যায়ন এই ছবির একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের ভূমিকা পালন করে। আবহসঙ্গীত এবং অর্কপ্রভ মুখোপাধ্যায়ের সুরে দুটি গান শুনতে ভালো লাগে। কলকাতার একটি প্রথম সারির দৈনিকে দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করার সুবাদে সংবাদ জগতটা খুব কাছ থেকে দেখেছেন প্রতিম। ছবিতে তার ছাপ স্পষ্ট। পরিচালনার ক্ষেত্রে আরও একবার মুন্সিয়ানার প্রমাণ দিলেন তিনি। ছবির দৈর্ঘ্য অহেতুক না বাড়িয়েও যে একটি টানটান থ্রিলার বানানো যায়, তার উদাহরণ ‘শান্তিলাল ও প্রজাপতি রহস্য’।

বাংলায় সাহিত্যনির্ভর গোয়েন্দাদের ভিড়ে মৌলিক গোয়েন্দা শান্তিলালের আবির্ভাব সত্যিই অন্যধারার।

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Gargi

Travel freak, nature addict, music lover, and a dancer by passion. Crazy about wildlife when not hunting stories. Elocution and acting are my second calling. Hungry or not, always an over-zealous foodie

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *