অভিমানী সুরযন্ত্রে বেজে ওঠা মিয়া মল্লার

ছবি: অব্যক্ত

পরিচালনা: অর্জুন দত্ত

অভিনয়ে: অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়, অনুভব কাঞ্জিলাল, আদিল হুসেন, অনির্বাণ ঘোষ

দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ২৮ মিনিট

RBN রেটিং: ৩.৫/৫

খোকা মাকে শুধায় ডেকে—
‘এলেম আমি কোথা থেকে,
কোন্‌খেনে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে।’
মা শুনে কয় হেসে কেঁদে
খোকারে তার বুকে বেঁধে—
‘ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে।’

মা ও সন্তানের এক দীর্ঘ কথোপকথনকে ছন্দে লিপিবদ্ধ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘জন্মকথা’ কবিতায়। মা তাঁর সন্তানকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইবেন, এটাই সত্যি। কিন্তু সন্তান যদি সেই সত্যকে ভেঙে চুরমার করে দিতে চায়? মা আর সন্তানের মধ্যেকার কথোপকথন যদি বাস্তবে ছন্দের তাল খুঁজে না পায়, তখন?




অর্জুন দত্তের ‘অব্যক্ত’ দেখতে বসে সেটাই মনে হলো। এক মা ও ছেলের মধ্যেকার না বলা কথার জমে থাকা পাহাড় নিয়ে তাঁর প্রথম ছবি পরিচালনা করেছেন অর্জুন। স্বামীর মৃত্যুর পর বিশাল অট্টালিকায় প্রায় একা থাকে সাথী (অর্পিতা)। কর্মসূত্রে দিল্লীতে থাকা ছেলে ইন্দ্রর (অনুভব) সঙ্গে মায়ের যোগাযোগ বলতে শুধুই মাসে দুটো ফোন। ইন্দ্র যেন চায় না সাথীর কাছে আসতে, মায়ের সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু তাও একদিন তাকে মায়ের মুখোমুখি দাঁড়াতেই হয়। সম্পত্তির আইনি মীমাংসা করতে ইন্দ্র ফেরে নিজের বাড়িতে। কিন্তু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না সে। এক অদ্ভুত অন্ধকার গ্রাস করে দুজনের দূরত্বকে। সাথী নিজের পছন্দগুলো একসময় তার সন্তানের ওপর আরোপিত করায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল ইন্দ্রর ছোটবেলা। এর রেশ এসে পড়ে বড়বেলাতেও। অভিমানী ইন্দ্র চিৎকার করে মাকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে, “You screwed it up.”

ছোটবেলায় মায়ের মতো সাজতে ভালোবাসত ইন্দ্র। খেলনাবাটি সাজিয়ে তার সংসার-সংসার খেলার সঙ্গী ছিল তার বাবা কৌশিক (অনির্বাণ) ও তার প্রিয় বন্ধু রুদ্রকাকু (আদিল)। মায়ের অনুপস্থিতিতে তার শাড়ি পরে খেলা করত ছেলেটি। জন্মদিনে তাই চুপি-চুপি রুদ্রকাকুর কাছে আবদার করেছিল একটি ডল হাউসের। ছেলের এই ‘মেয়েলিপনা’ পছন্দ ছিল না সাথীর। তার তখন একটাই ভয়, ছেলের এই মেয়েলি খেলার সখ যদি থেকে যায় ভবিষ্যতে? তাই জোর করে ইন্দ্রকে মাঠে ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলতে পাঠাত সাথী।

আরও পড়ুন: পাকদণ্ডীর পথে পথে দেওরিয়াতাল

কৌশিক-সাথী-রুদ্র এই তিনজনের ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে নিজের ছোটবেলার স্মৃতিগুলোকে সুমধুর করতে ব্যর্থ হয় ইন্দ্র। আকাশভাঙা বৃষ্টিতে নিজের সেই অব্যক্ত অভিমানকে ভিজিয়ে নেয় কান্নায়। তানপুরার ধুলো ঝেড়ে তাতে সুর তোলে সাথী। গানটা সে বড়ই ভালো গাইত। ছেলের মুখচোরা অভিমানের সদুত্তর দিতে অপারগ সাথীর সুরযন্ত্রে বেজে ওঠে মিয়া মল্লার। এ বড় মন কেমন করা দৃশ্য।

মা ও ছেলের মাঝখানে অব্যক্ত অভিমান সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুললেন অর্জুন গোটা ছবিজুড়ে। প্রথম পরিচালনা হিসেবে লেটার মার্কস পেয়ে পাশ করলেন তিনি। এই ছবিতে সময় এবং স্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ। অতীত এবং বর্তমানকে খুব সুন্দরভাবে ক্যামেরাবন্দী করেছেন সুপ্রতীম ভোল। তাঁর লেন্সে ধরা পড়ে নিঃসঙ্গ সাথীর চাপা কান্না, ইন্দ্রর হারিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন, খড়খড়ির জানলায় বৃষ্টির খেলা, রুদ্রকাকুর ‘ওথেলো’ আবৃত্তি।

আরও পড়ুন: লতার কোলে ভবিষ্যতের তারকা, স্মৃতিতে ডুব দিলেন গায়িকাও

অভিনয়ে প্রত্যেকেই নিজের সেরাটুকু দিয়েছেন এই ছবিতে। প্রস্থেটিকস ছাড়াই পঞ্চাশোর্ধ সাথীর চরিত্রে নজর কাড়লেন অর্পিতা। পাশাপাশি তরুণী সাথীর ভূমিকাতেও তিনি বেশ সুন্দর। অনুভব যথাযথ। মায়ের ওপর অভিমান, রাগ, ক্ষোভ সবকিছুই তিনি ফুটিয়ে তুললেন দারুণভাবে। তবে বেশ কয়েকটি জোরালো দৃশ্যে অর্পিতার পাশে তার অভিনয় কিছুটা হলেও ম্রিয়মান ঠেকে, হয়ত এটা তাঁর প্রথম ছবি বলেই। পরিমিত স্বভাবের রুদ্রর চরিত্রে আদিল অনবদ্য। তাঁর অসাধারণ ইংরেজি উচ্চারণে ইন্দ্রকে শেক্সপিয়রের ‘ওথেলো’ বা ‘ম্যাকবেথ’-এর কিছু লাইন শোনানোর দৃশ্যে চোখ আটকে থাকে পর্দাজুড়ে। মন বলে, কথাগুলো অনুভব করতে, অনুধাবন করতে। প্রতিবাদ করতে না পারা কৌশিকের চরিত্রে অনির্বাণ মানানসই। নিজের আসল স্বত্তার সঙ্গে লড়াইয়ের বৃথা চেষ্টা করে হেরে যাওয়া একটি মানুষ কৌশিক। দুটি বিশেষ চরিত্রে দেখা গেল লিলি চক্রবর্তী এবং দেবযানী চট্টোপাধ্যায়কে। পরিচারিকার ভূমিকায় পিঙ্কি বন্দ্যোপাধ্যায়কে মনে রাখবেন দর্শক। ইন্দ্রর প্রেমিকা অদিতির চরিত্রে খেয়া চট্টোপাধ্যায় যথাযথ। ছোট্ট ইন্দ্রর ভূমিকায় সামন্তক দ্যুতি মৈত্রকে বেশ মিষ্টি লাগে।

সঙ্গীত এ ছবির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বহুদিন পর একটা গোটা ছবির আবহ দাঁড়িয়ে থাকল সেতার, সরোদের সুরে ভর করে। এ যেন এক প্রাণের আরাম। সঙ্গীত পরিচালক সৌম্যঋত নাগকে কুর্নিশ। কোনও পরীক্ষানিরীক্ষায় না গিয়ে শুধুমাত্র তানপুরার সুরে জয়তি চক্রবর্তীর কণ্ঠে ‘কাঁদালে তুমি মোরে’ যেন সাথীর অব্যক্ত অভিমানের বহিঃপ্রকাশ। বহুদিন পর বাংলা ছবিতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও রবীন্দ্রনাথকে একসঙ্গে এত সুন্দরভাবে ব্যবহার করা হলো। ঠিক যেমনটা এককালে করতেন সত্যজিৎ রায়, তরুণ মজুমদার, ঋতুপর্ণ ঘোষ, অপর্ণা সেনের মতো পরিচালকরা।

সরলরেখায় ভর করে মা ছেলের জটিল সম্পর্কের একটি কাব্যিক আখ্যান ‘অব্যক্ত’। এ ছবির শেষে এক অপ্রকাশিত বেদনা রয়েছে যা কাহিনীর আর্তিকে পূর্ণতা দেয়। এমন এক শেষ যা না বলা কথাদের প্রাণ সঞ্চার ঘটায়। এ সমাপ্তি অদ্ভুত সুন্দর। রবীন্দ্রনাথের ‘জন্মকথা’ দিয়ে এই লেখা শুরু করেছিলাম। অর্জুন তাঁর ছবি শেষ করলেন সেই কবিতাকে আশ্রয় করেই। গোটা প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে গ্রাস করে নিস্তব্ধতা। ঘোর কাটে করতালিতে।

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
1

Gargi

Travel freak, nature addict, music lover, and a dancer by passion. Crazy about wildlife when not hunting stories. Elocution and acting are my second calling. Hungry or not, always an over-zealous foodie

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *